১৯৭০ সালে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বোচ্চ সম্মান বঙ্গ বিভূষণে ভূষিত করেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। আর তারও ১ দশক পেরিয়ে কিনা শেষবেলায় নবতিপর কিংবদন্তী শিল্পীকে পদ্মশ্রী সম্মান দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছে মোদী সরকার! মেনে নিতে পারেননি ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা (Legendary singer Sandhya Mukherjee)। অতঃপর সোমবার বিকেলে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দিল্লি থেকে ফোন আসতেই পত্রপাঠ সেই পদ্ম-সম্মান প্রত্যাখ্যান করে দেন প্রবাদপ্রতীম গায়িকা। সেই প্রসঙ্গে ইতিমধ্যেই শিল্পীমহলে ঝড় উঠেছে। মোদী সরকারের ‘দায়সারা’ প্রস্তাবে বিরক্ত হয়েছেন শিল্পীমহলের একাংশ। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পদ্মশ্রী-প্রত্যাখানে সায় দিল বাংলার শিল্পীমহল। কে কী বললেন দেখুন।
কবীর সুমনের (Kabir Suman) মন্তব্য, "ভারতের বিজেপি সরকারের দেওয়া পদ্মশ্রী খেতাব ফিরিয়ে দিলেন শ্রীমতী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আপনাকে অভিবাদন!" এরপরই তিনি তুলনা টেনে বললেন, "শুনছি রশিদ খান পদ্মবিভূষণ আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় পদ্মশ্রী। এর আগে অজয় চক্রবর্তীও পদ্মভূষণ পেয়েছেন আর গীতশ্রী সন্ধ্যাদেবীকে পদ্মশ্রী দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। যাঁরা এমন ধৃষ্টতা দেখিয়েছে তাদের জুতো পেটা করা উচিত! উনি গোটা বাংলার গর্ব। আর ওঁকে অসম্মান করে গোটা বাঙালি জাতিকে হেয় করল মোদী সরকার।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার তরফে ফোনে ধরা হলে, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গায়ক অনুপম রায়ের (Anupam Roy) অভিযোগ, "বাংলার শিল্পীরা সবসময়ে উপেক্ষিত। আমরা এদেশে আছি কোণঠাসা হয়ে। আমাদের মাঝে মাঝে রুটি ছুঁড়ে দেওয়া হয়, তখন আমরা যাই।" এরপরই অনুপমের মন্তব্য, "এবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো কিংবদন্তী শিল্পী কত দশক ধরে রাজত্ব করেছেন সমূহ সংগীতজগতে, সেটা কী আর দেশের লোক বুঝবে! একজন বাঙালি-ই বুঝবে। আমার জানা নেই বাংলার বাইরে অন্য প্রদেশের ভাষাভাষীর মানুষের কাছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গুরুত্ব কে কতটা বোঝেন! আমাদের দেশে তো আদতে গণ্ডগোলের দেশ আর কী! যার ফলে শিল্পীদের গুরুত্বটাই বুঝে উঠতে পারেনি কেউ। উনিও উপেক্ষিত হয়েছেন দীর্ঘদিন। আর এসব পুরস্কার তো সবই দেখানো। আমার গোটা সিস্টেমের ওপর ঘেন্না ধরে গিয়েছে। অনেকজনকে দেওয়ার পর হয়তো মনে পড়ে গিয়েছে যে, হ্যাঁ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হয়তো বাকি রয়ে গিয়েছেন..! এরকম একটা ব্যাপার। খুবই অসম্মানজনক। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সম্মান বাংলার শ্রোতাদের কাছে এবং যাদেরকে উনি গেয়ে এতকাল ধরে তৃপ্ত করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন, আমাদের গর্ব উনি। ওই সম্মান ওঁর সবসময়ে থাকবে। তাতে কিছু জাতীয় সম্মান পেলেন কি পেলেন না, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আমিও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কোনও শিল্পীর কাজ শিল্প দিয়েই প্রতিফলিত হয়। কেউ মনে রাখে না, কে কোন পুরস্কার পেয়েছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হোন বা মান্না দে, কটা পুরস্কার পেয়েছেন, শ্রোতাদের কাছে কিচ্ছু যায়-আসে না। আমি খুব খুশি হয়েছি যে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান করেছেন।"
<আরও পড়ুন: অভিনয় জীবনে অনন্য সম্মান, পদ্মভূষণ পাচ্ছেন অভিনেতা ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়>
লোপামুদ্রা মিত্রকে (Lopamudra Mitra) ফোনে ধরতেই তিনি বললেন, "বিষয়টা হল সন্ধ্যাদির ৯০ বছর বয়স, এটা আমাদের ভারত সরকারেরই গণ্ডগোল। আজকে নয়, অনেকদিন থেকেই বলছি। গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে যে পদ্ম-পুরস্কার দেওয়া হবে, সেটা আগে কোনওদিন ভাবাই হয়নি। শুধু পদ্মশ্রী নয়, আজকে উনি যে জায়গায় বিরাজ করছেন, উনি গোটা ভারতর্ষের গর্ব। সেক্ষেত্রে পদ্মশ্রীর জন্য সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কিছু যায়-আসে না। উনি বাঙালির মনের মণিকোঠায় রয়েছেন। সেখানে আর পাঁচজনের সঙ্গে ওঁকে পদ্মশ্রী দেওয়া সত্যিই ঠিক নয়। তাই সন্ধ্যাদি যা করেছেন, একদম ঠিক করেছেন। যেভাবে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেটাও অসম্মানজনক। আমার মনে হয়, কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, তার জন্যও হোমওয়ার্ক করাটা জরুরী। আমার জানা নেই, এরপরেও সেই শিক্ষাগত জায়গাটা আসবে কিনা, এভাবে ফোনে প্রস্তাব দেওয়া অন্যায়।"
এরপরই অনুপম রায়ের সুর টেনে গায়িকা বললেন, "বাংলার শিল্পীদের সত্যি সেই জায়গাটা দেওয়া হয় না। অনুপমের সঙ্গে আমি ১০০ ভাগ সহমত। আমরা নিজেরা আত্মসম্মান নিয়ে থাকি বলেই কি এহেন আচরণ? জানা নেই। অন্য প্রদেশের থেকে আমাদের বাংলার শিল্পীদের অপমানজনক জায়গায় রাখা হয়। বাংলার অনেক শিল্পীরই অনেক কিছু পাওয়ার ছিল, যেটা আমরা পাইনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও যে কারণে ১৯৮৭ সালে পদ্ম-পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। উনি তো হিন্দি-বাংলা উভয় ইন্ডাস্ট্রি মিলিয়েই কাজ করেছেন। আসলে যাঁরা নিজেরা তদারকি করেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে এটা হয়েই থাকে।"
স্বল্পভাষায় নচিকেতা চক্রবর্তী (Nachiketa Chakraborty) বুঝিয়ে দিলেন যে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এসব পুরস্কারের অনেক উর্দ্ধে। ফোন ধরেই তাঁর মন্তব্য, "সন্ধ্যাদি জীবন্ত কিংবদন্তী। ওঁর ব্যবহার করা সামগ্রীই পুরস্কার-সম। এটুকুই বলব।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন