'ম্যাজিক' মুক্তির আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অঙকুশ (Ankush Hazra) -ঐন্দ্রিলা (Oindrila Sen)। বিয়ের পরিকল্পনা থেকে গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে পড়া রাজনীতি, ধুঁকতে থাকা প্রেক্ষাগৃহ… যাবতীয় বিষয়ে অকপট তারকাজুটি। শুনলেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
হিরোইন হিসেবে ঐন্দ্রিলার ডেবিউ, সেই অভিজ্ঞতাটা শুনব?
ঐন্দ্রিলা- হিরোইন হিসেবে ডেবিউ ঠিকই, তবে দীর্ঘ দিনবাদে বড়পর্দায় ফিরে ভাল লাগছে। উচ্ছ্বসিত তো বটেই। আবার টেনশনেও আছি। কারণ, অতিমারী আবহে হল বন্ধ ছিল। তবে একুশ পড়তেই ঘুরে দাঁড়িয়েছি আমরা। সবথেকে খুশির খবর প্রেক্ষাগৃহে ১০০ শতাংশ দর্শক প্রবেশের অনুমতি। আর এই সময়েই ছবিটা রিলিজ করছে বলে, একটু টেনশনে। দর্শক কতটা আসবেন, দেখবেন, সেটাই ভাবনা।
রিয়েল লাইফ জুটি, রিল লাইফে…
ঐন্দ্রিলা- অনেক বছর আগেই বড়পর্দার সুযোগ এসেছিল। তখন অনেকেই চেয়েছিলেন আমি অঙ্কুশের সঙ্গে কাজ করি। কিন্তু হয়নি। 'ম্যাজিক' সেক্ষেত্রে পূর্বপরিকল্পিত মোটেই নয়। পুরো ক্রেডিটটাই রাজাদার (চন্দ)। ওঁর মাথাতেই অঙ্কুশ-ঐন্দ্রিলা জুটির ভাবনা এসেছে। দুজনেরই গল্পটা ভাল লেগেছিল, তাই একসঙ্গে রাজাদাকে সবুজ সংকেত দিয়েছিলাম।
অঙ্কুশ সেটে কেমন?
ঐন্দ্রিলা- বাড়িতে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় অঙ্কুশ ভীষণই মজা করে থাকে, কিন্তু সেটে একদমই সেরকম নয়। তাই প্রথমটায় আমার চিন্তা ছিল, এই যদি সেটে শুটিংয়ের মাঝেও এরকম ঠাট্টা করে একটা ইমোশনাল সিনে, তাহলে হয়তো আমিও হাসতেই থাকব।! কিন্তু সেটে ঠিক একদম উল্টো। সারাক্ষণ কোনও না কোনও দৃশ্য-সংলাপ নিয়ে ভেবে চলেছে। অঙ্কুশ ডেডিকেটেড। একসঙ্গে কাজ করছি বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা-ঠাট্টা কিছুই হয়নি। একসঙ্গে দৃশ্য থাকলেই স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা হত, নাহলে যে যার ভ্যানিটি ভ্যানে। ও ভীষণই সাপোর্টিভ, হেল্পফুল। একদমই ডিসটার্ব করেনি আমাকে (হেসে)।
ঐন্দ্রিলা প্রসঙ্গে কী বলবে?
অঙ্কুশ- বড়পর্দায় শিশুশিল্পী হিসেবে যেহেতু আগেও কাজ করেছে, তাই শুরু থেকেই ওঁর আত্মবিশ্বাস ছিল। তাছাড়া টেলিভিশনেও বহু বছর ধরে কাজ করেছে ও।
'জুলফিকার'-এর পর আবারও মশালামুভি থেকে বেরিয়ে অঙ্কুশ অন্যরকম চরিত্রে। ট্রেলারই তার প্রমাণ। প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছ?
অঙ্কুশ- কিছু ক্ষেত্রে চরিত্রটাই এতটা ইনটেন্স হয় যে, সেটাকে আত্মস্থ করতে না পারলে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা অসম্ভভব। 'ম্যাজিক'-এর ইন্দ্রজিতের চরিত্রে অভিনয়ের আগে আমাকে ওয়ার্কশপ করতে হয়েছে সুদীপ্তা চক্রবর্তীর কাছে। একজন ম্যাজিশিয়ানের বডি ল্যঙ্গুয়েজ কীরকম হয় কিংবা সে স্টেজে যখন পারফর্ম করে, তখন কীরকম থাকে, সেটার খুঁটিনাটি শিখতে হয়েছে। যেহেতু সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, তাই প্রত্যেকটা চরিত্রতেই কিছু শেড রয়েছে। Be it a typicall film or a very challenging character, ওয়ার্কশপ করাটা দরকার। তৃতীয় ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও দেখা জরুরী। কারণ, অভিনেতা হয়তো কিছু মিস করে যেতে পারে কিন্তু ওয়ার্কশপের মধ্য দিয়ে আসল অভিনয়টা বের হয়ে আসে। একটা চরিত্রকে আরও এক্সপ্লোর করা যায়। কাছ থেকে জানা যায়। আমি, ঐন্দ্রিলা দুজনেই ওয়ার্কশপ করেছি।
রাজা চন্দর ছবি মানেই প্রেম-রোম্যান্স, যাবতীয় বিনোদন উপকরণের সঙ্গে সমাজের জন্য একটা বিশেষ বার্তা। 'ম্যাজিক'-এর ইউএসপি কী?
অঙ্কুশ- 'ম্যাজিক' আমাদের পারিপার্শ্বিক সম্পর্কগুলো নিয়ে ভাবতে শেখাবে। এটাকে রিয়ালিস্টিক কর্মাশিয়াল ছবি বলা যেতে পারে। এখন দর্শক অনেক স্মার্ট, বাস্তবটাকেই সিনেপর্দায় দেখতে পছন্দ করেন। আবার কমার্শিয়াল ছবিও দরকার। 'ম্যাজিক'-ও তাই। A Content driven realistic commercial film.
অঙ্কুশ-ঐন্দ্রিলার সোশ্যাল মিডিয়াতে উঁকি মারলেই বেশ মজার ভিডিও পাওয়া যায়..
ঐন্দ্রিলা- হ্যাঁ, আমরা দুজনেই কার্টুন।
অঙ্কুশ- দিনের শেষে আমরা অভিনেতা, বলা ভাল, এন্টারটেইনার। তাই সোশ্যাল মিডিয়া হোক বা যে কোনও মাধ্যম দর্শক-অনুরাগীদের এন্টারটেইন করাটাই আমাদের কাজ।
ঐন্দ্রিলা- এই তো সেদিন ফোরাম থেকে বেরনোর সময় দুজন এসে আমাদের মজার ভিডিও কথা বললেন। এটাই তো একজন অভিনেতার কাছে বড় পাওনা। আমরা চাই এভাবেই তাঁদের এন্টারটেইন করতে।
অনুরাগীদের কথায় 'মেড ফর ইচ আদার'। নতুন ফ্ল্যাটও কেনা হয়ে গিয়েছে। গোছগাছও কমপ্লিট। কবে বিয়ে করছ?
ঐন্দ্রিলা- আমার সব বন্ধুরা এক এক করে বিয়ে করে নিচ্ছে। বিয়েরও সিজন চলছে। আমাদেরও সময় আসবে।
অঙ্কুশ- ঐন্দ্রিলা সদ্য কাজ শুরু করল। ওঁর জার্নিটা একটু উপভোগ করুক। তবে হ্যাঁ, এই বছরই বিয়েটা সেরে ফেলব।
কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, মার্চেই নাকি চার হাত এক হচ্ছে।… কী বলবে এই প্রসঙ্গে?
অঙ্কুশ- সেটায় কোনও অসুবিধে নেই! তবে এখনই সেই পরিকল্পনা নেই। (হেসে)
ম্যাজিকের ক্ষমতা এলে কোন জিনিস উধাও করবে?
ঐন্দ্রিলা- এই মুহূর্তে করোনা দূর করব। কারণ, ঠিক করে সেজেগুজে ঘুরতে যেতে পারছি না। মাস্ক পরে থাকতে হচ্ছে। লিপস্টিক দেখাতে পারছি না। (হেসে)। হিমাচলে গেলাম, সেটাই কড়া রেস্ট্রিকশনের মধ্যে। সবসময়েই একটা ভয় কাজ করে। এই করোনাআতঙ্ক আর নেওয়া যাচ্ছে না!
অঙ্কুশ- 'ম্যাজিক'-এর সংলাপ ধার করেই বলব, ভগবানের সৃষ্টিকে বেশি নাড়াচাড়া করতে নেই। জীবনে যা পেয়েছি সেটাও অনেক। তাই কিচ্ছু উধাও করতে চাই না। এই অতিমারী আবহটা মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু অনেক কিছু শিখিয়েও গেল।
এখন তো গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রি আর রাজনীতি মিলেমিশে একাকার। তোমার সহকর্মীরাও রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। অঙ্কুশ তোমার এরকম কোনও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে?
অঙ্কুশ- না, এখনই এরকম কোনও প্ল্যান নেই। তবে রং-দল নির্বিশেষে অনেক পলিটিশিয়ানের আদর্শ ভাল লাগে। রাজনৈতিক রঙের উর্দ্ধে গিয়ে ব্যক্তি-মানুষ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই নিজের স্বার্থের জন্য রাজনীতি করেন। তবে যে মানুষের জন্য কাজ করবে, সে যদি কখনও পাশে থাকার কথা বলে, নিশ্চয়ই থাকব।
ঐন্দ্রিলা- অনেকেই আছেন রাজনীতিতে যোগ দেন অর্থ, যশ, খ্যাতির জন্য। লালবাতি জ্বালিয়ে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু মানুষের সেবা করার জন্য পলিটিক্সে নামার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বিক্রম (চট্টোপাধ্যায়) আর ওর বোন সারা বছর রাস্তার কুকুরদের দেখে। প্রত্যেকবছর বিক্রম ওর জন্মদিনে অনেক দুস্থ শিশুদের খাওয়ায়। সেটাও তো একপ্রকারের সেবা। তার জন্য রাজনৈতিক ট্যাগের প্রয়োজন হয় না।
অঙ্কুশ- এক্ষেত্রে আমি সোনু সুদের কথা বলব। কোনওরকম রাজনৈতিক ছায়ার নিচে না থেকেও ও কিন্তু গোটা লকডাউনে আসমুদ্র-হিমাচলের নাড়িয়ে দিয়েছে দুস্থ মানুষদের পাশে থাকার জন্য। ওঁর সামর্থ্যর বাইরে গিয়ে মানুষের সেবা করে চলেছেন।
রাজনীতিতে জড়িয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে যে অসহিষ্ণু পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, সেই বিষয়টিতে ব্যক্তিগতভাবে কী মতামত?
অঙ্কুশ- ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এখন তো দল ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। আমি চাই ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে গৃহযুদ্ধ না বাধুক। শান্তি বজায় থাকুক। মনে রাখা দরকার, আমরা দিনের শেষে সবাই শিল্পী। যখন একসঙ্গে কাজ করব, তখন যেন নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বটা কাজ না করে। যারা রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন কিংবা দেবেন, তাঁদের কাছে আমার এই একটাই আর্জি।
ধরো, আমার ৪ বন্ধুর মধ্যে একে অপরের বিরোধী শিবিরে যোগ দিয়েছে। আর তাঁদের এই ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য আমার হাউজ পার্টিতে তাঁদের একসঙ্গে ডাকতে পারছি না। এরকম পরিস্থিতি যেন কখনও না আসে।
এই পরিস্থিতিটা ইন্ডাস্ট্রিতে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে..
অঙ্কুশ- একদমই তাই। এই কাদা ছোড়াছুঁড়িটা আমার কাছে দুঃস্বপ্ন! একে-অপরের দিকে প্রায়ই আঙুল তোলা হচ্ছে। শিল্পী হিসেবে আমাদের ভালবাসা, টানটা যেন আগের মতোই থাকে, সেটাই চাইব। যদি কোনও দিন রাজনীতিতে যোগ দিই তাহলে, আমি নিজে কতটা মানুষের সেবা করতে পারব, সেটাতেই ফোকাস করব। বিরোধীপক্ষকে চারটে বাজে কথা বলে, দোষারোপ করে সময় নষ্ট করার পক্ষপাতি আমি নই।
অথচ, সহাবস্থান বজায় রাখার শিক্ষা তো আমরা ইন্ডাস্ট্রিতে পেয়েছি। সেটে কিংবা সিনেমার ক্ষেত্রে আমরা সবাই ভীষণ ডিপ্লোম্যাটিক। পছন্দ না হলেও সৌজন্যবার্তা বিনিময় করি। একসঙ্গে ছবি রিলিজ করলেও আমরা একে-অপরের প্রতি ভীষণ সাপোর্টিভ। জানি না, রাজনীতির ময়দানে নামলেই সেটার কেন ব্যঘাত ঘটে! বিতর্কটাই মূল হয়ে দাঁড়ায় তখন।
ঐন্দ্রিলা- এই স্কুলিংটা ইন্ডাস্ট্রির নয়। রাজনীতির।
অতিমারী, লকডাউন, সিনেমা হল বন্ধ.. বাংলা ইন্ডাস্ট্রি কি ধুকছে? ছবির কন্টেটে পরিবর্তন তো এসেইছে। ঘুরে দাঁড়াতে কি আরও বেশি করে বাণিজ্যিক ছবির প্রয়োজন?
অঙ্কুশ- 'দাবাং' কিংবা 'কেজিএফ'-এর মতো একটা মশালা ছবি বানালে কেন চলবে না? কিন্তু আমাদের বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে যে বাজেট থাকে, সেটাতে রিয়েলিস্টিক ছবি বানানোই বুদ্ধিমত্তার কাজ। তাতে বাজেট অনেকটা কমে যায়। এখন যেরকম অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ইন্ডাস্ট্রি, সেক্ষেত্রে আরও কন্টেন্ট ড্রিভেন সিনেমা প্রয়োজন। যাতে অন্যান্য আঞ্চলিক সিনেমার থেকে স্বতন্ত্রতা বজায় থাকে।
হল ব্যবসায়ীরাও ধাক্কা খাচ্ছে এক্ষেত্রে..
অঙ্কুশ- সিঙ্গল স্ক্রিনগুলো আবার খোলা খুব দরকার। রাজাদার (চন্দ) 'ম্যাজিক' কিংবা রাজদার (চক্রবর্তী) 'পরিণীতা', 'ধর্মযুদ্ধ'র মতো সিনেমা আরও দরকার আমাদের এখানে। যেগুলো টিপিক্যাল মশালা ফিল্মও নয়, আবার আঁতেল ছবিও নয়। তাহলেই হয়তো দর্শক ও বাংলা সিনে ইন্ডাস্ট্রির মাঝের দূরত্বটা কোথাও গিয়ে কমবে।
দক্ষিণী সিনেদর্শকরা সিনেমাকে রীতিমতো উদযাপন করে। আমাদের এখানে সেটা নেই। বাংলায় সিনেমার দর্শকদেরও কোথাও গিয়ে এটা মাথায় রাখা দরকার। কারণ, দর্শকরাই তো আসলে শেষ কথাটা বলেন।