মেটেলি, উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চল। সেখানেই থাকতেন তরুণ মজুমদারের (Tarun Majumdar Demise) ভাই অরুণ খাসনবীশ। তরুণবাবুদের প্রকৃত পদবী 'খাসনবীশ'। আসলে এই পদবী শুনে তখন তেমন কেউ পাত্তা দিত না, তাই তিনি বদলে 'মজুমদার' পদবী ব্যবহার করা শুরু করেন। মেটেলি উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘ কয়েক দশক শিক্ষকতা করেন তাঁর ভাই অরুণ। প্রধান শিক্ষক পদেও আসীন ছিলেন। খাতায়-কলমে যদিও তাঁর নাম ছিল অরুণ খাসনবীশ। উল্লেখ্য, মেটেলি হাইস্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তরুণ-অরুণের বাবা বীরেন্দ্রনাথ কুমার খাসনবীশ (মজুমদার)। যাঁর স্মৃতিতে আজও প্রতিবছর ২ জানুয়ারি বন্ধ থাকে স্কুল। সেইসূত্রেই তরুণ মজুমদারের সঙ্গে মেটেলির যোগসূত্র দীর্ঘ দিনের।
'কাট টু' ছয়-সাতের দশক... দাদা তরুণ তখন একের পর এক মোড় ঘোরানো সিনেমা তৈরি করছেন টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় বসে। কাজের ফাঁকে একটু অবসর পেলেই ছুটতেন ভাই অরুণের কাছে। কলকাতার পর উত্তরবঙ্গের মেটেলি, পরিচালক তরুণ মজুমদারের কাছে আরেক বাড়ি ছিল বললেও অত্যুক্তি হয় না। স্ত্রী সন্ধ্যাকে নিয়ে বেশ কয়েকবার সেখানে ঘুরতে গিয়েছেন পরিচালক। টালিগঞ্জের নামজাদা পরিচালক। কিন্তু কখনও কোনওরকম তারকাসুলভ হাবভাব ছিল না তাঁর মধ্যে। প্রথমদিকে মেটেলি হাইস্কুলের কোয়াটারে যখন থাকতেন অরুণ খাসনবীশ, তখন সেই স্কুল কোয়ার্টারে গিয়েই উঠতেন তরুণ মজুমদার। সামনেই স্কুল মাঠ। কতবার এরকম হয়েছে, সন্ধ্যা নামতেই সেই মাঠে পায়চারি করতে যেতেন পরিচালক। সেখানেই একবার এক মজার ঘটনা ঘটে।
পরনে ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। সন্ধেবেলা মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হাঁটছেন। অন্ধকার জায়গা। আরেক স্কুলশিক্ষক, যিনি ওই কোয়াটারে থাকতেন, তিনি সেখান দিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখে প্রায় ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়! তখনও মেটেলিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। বেশিরভাগ এলাকাই অন্ধকার থাকত। মাঠেও বৈদ্যুতিন সংযোগ ছিল না। তো ওই অন্ধকারে তরুণবাবুর ধবধবে সাদা পোশাক-আশাক দেখে খানিক চমকেই গিয়েছিলেন তিনি। পরে হাঁক-ডাক করে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তরুণবাবু দিন কয়েক আগে হাওয়া বদলের জন্য মেটেলিতে এসেছেন।
অনেকসময়ে এরকমও হয়েছে, নিজে ব্যস্ততার চাপে মেটেলিতে বেশি যেতে পারতেন না বলে, তাপস পাল বা কেউ উত্তরবঙ্গে শুটিং করতে গেলে তাঁদেরকে ভাই অরুণের সঙ্গে দেখা করে আসতে বলতেন তিনি। তারকারা সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালনও করতেন। ভাই অরুণের থেকেও বেশি আড্ডা দিতে ভালবাসতেন তরুণবাবু। অতঃপর মেটেলিতে গিয়ে কখনও স্কুল কোয়াটারে চেনাপরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলে কথা বলতেন, আবার কখনও বা স্থানীয় লোকদের সঙ্গেও কুশল-মঙ্গল বিনিময় করতেন। পরে স্কুল কোয়ার্টার ছেড়ে মেটেলি বাজার লাগোয়া এক বাড়ি কেনেন তাঁর ভাই অরুণ খাসনবীশ। সেখানেও বছর বারো আগে গিয়ে উঠেছিলেন তরুণ মজুমদার।
তারকাদের মতো গাড়ি নিয়ে নয়, বরং ভাইয়ের সঙ্গে অনায়াসে পায়ে হেঁটেই গোটা মেটেলি বাজার ঘুরতেন দাদা তরুণ। স্থানীয় দোকান থেকে কেনাকাটাও করতেন। শান্তি স্টোর্স থেকে মেটেলি হাট, বাদ যায়নি তরুণের তালিকা থেকে। লোকাল ড্রাইভারদের সঙ্গেও তাঁর আলাপ ছিল। মেটেলিতে গিয়ে কখনও সামসিং আবার কখনও বা মূর্তি নদীতে ঘুরতে চলে যেতেন। আসলে মাটির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করতেন, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন আরও কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারেন। তরুণের ফ্রেমে যার প্রতিফলন ঘটেছে সিনেপর্দাতেও।
উল্লেখ্য, বছর খানেক আগেই ভাই অরুণ খাসনবীশ ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন। সেসূত্রে তরুণের সঙ্গেও মেটেলির যোগাযোগ ছিন্ন ছিল শেষ কয়েক বছরে। মেটেলির সেই বাড়িতে এখন তাঁদের তুতো ভাই-বোন শৈবাল ও সোনালি খাসনবীশ থাকেন। আত্মীয় বিয়োগে ভেঙে পড়েছেন তাঁরা। শৈবালবাবু জানান, "তরুণ মজুমদারের বাবার মৃত্যুর পর আমরা একসঙ্গেই কলকাতায় থাকতাম। কত স্মৃতি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে অসুস্থ দাদাকে দেখতে যেতে পারিনি কলকাতায়।" তরুণ-সন্ধ্যা যখনই যেতেন ভাই অরুণের মেটেলির বাড়িতে, বসত সান্ধ্যাকালীন আড্ডাও। ১৯৮১ সালে মেটেলি উচ্চ বিদ্যালয়ের রজত জয়ন্তী বর্ষেও বিশেষ অতিথি হিসেবে তরুণ-সন্ধ্যা জুটি উপস্থিত হয়েছিলেন। আজ তরুণ মজুমদারের (Tarun Majumdar North Bengal connection) প্রয়াণে সেসব স্মৃতি আঁকড়েই শোকপ্রকাশ করছেন মেটেলির স্থানীয় বাসিন্দারা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন