এক অংশ সুন্দরবন... যা ঘিরে রয়েছে অনেক সত্যি, অনেক গল্প, অনেক আখ্যান আর বনবিবির প্রতি মানুষের অগাধ বিশ্বাস। ঘরের মানুষ বনে গেলে বনবিবির প্রতি তাদের যে অন্ধ ভরসা, দক্ষিণ রায়কে দমন করতে এক নারীশক্তির উত্থান। এমনই এক গল্প নিয়ে আসছেন পরিচালক রাজদীপ ঘোষ।
'বনবিবি' - সেই ভরসার নাম, যার আরাধনা করা কিংবা পুজো করার মধ্যে দিয়ে সুন্দরবন এলাকার প্রতিটি ঘরণী নিজের ঘরের মানুষের ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকেন। বনবিবি এবং দক্ষিণ রায়ের এই সংঘর্ষ সুন্দরবনের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে। বাঘ এবং হিংস্র পশুদের হাত থেকে রেহাই পেতেই বনবিবির উপাসনা। আর, এবার সেই গল্পই ফুটে উঠবে পর্দায়। পরিচালক রাজদীপ ঘোষ, যিনি সুন্দরবনের প্রতি চূড়ান্তভাবে দুর্বল, তাঁরই নির্দেশনায় কাজ করেছেন পার্ণো মিত্র এবং বনবিবির ভূমিকায় রয়েছেন সোহিনী সরকার। বনবিবি তৈরির নেপথ্যের গল্প শুনতেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা যোগাযোগ করেছিল পরিচালকের সঙ্গে। দুই বাংলার সুন্দরবনের গল্প সেই যে শুরু করলেন...
সুন্দরবন এবং বনবিবি, গল্প তো অনেক রয়েছে। কিন্তু গবেষণা কতদূর করলেন এমন একটি ছবি দাঁড় করানোর আগে?
আসলে, সুন্দরবন আমার জীবনের একটা অনবদ্য অংশ। এর আগেও যখন অপারেশন সুন্দরবন আমি শুট করছিলাম তখন দেখেছিলাম যে সুন্দরবনে নানা ধরনের গল্প আছে। একটা না। অনেক রকমের গল্প আছে। আর সেইগুলি নিয়ে সহজে ছবি বানায় না। বাংলাদেশের সুন্দরবনটা অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কাজেই, সুন্দরবন আমার অন্দরে, এবার তো রয়েছেই গবেষণার কাজ।
গবেষণা যখন করেছেন, একটা প্রশ্ন..সত্যিই কি বনবিবির প্রতি অগাধ আস্থা সুন্দরবনের মানুষদের?
হ্যাঁ! অবশ্যই..এটা আমি দেখেছি। শুধু আমাদের দেশে না। বাংলাদশের যে প্রান্তটুকু সেখানেও একই গল্প। আমি দেখেছি যাদের স্বামীরা বনে মধু আনতে যান, তাদের মধ্যে একটা ভয়। আসলে, বনবিবির উত্থান তো দক্ষিণ রায়কে জব্দ করার জন্য। অর্থাৎ, নারীশক্তির উত্থান। আমি দেখেছি গ্রামের মহিলাদের উপস করে পুজো করতে, বিবির উত্থান আসলে আর পাঁচটা মেয়ের জয়ের মতোই।
সোহিনী সরকার, তাও আবার বনবিবি! আপনার কেন মনে হল সোহিনী পারবে?
আসলে, এই চরিত্রটা আমি এমন একজনকে দিয়ে করাতে চেয়েছিলাম যে খুব পাওয়ারফুল। আর সোহিনী আমার চোখে বেশ সুন্দর একজন অভিনেত্রী। শুধু তাই নয়, এটা কোনও লিড চরিত্র না। বনবিবির চরিত্র করতে যে সোহিনী রাজি হয়ে যাবে এটা আমার হাতে চাঁদ পাওয়ার মত। ফলেই, একটা আনন্দ তো ছিলই।
নারীতান্ত্রিক ছবির সংখ্যা দুই বাংলাতেই ক্রমশ বাড়ছে, বনবিবিতে একাধিক নারী চরিত্র, পরিচালক হিসেবে এতে গর্ব হয় নাকি...
আমি, আসলে এই বিষয়টা আমি কোনও বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখি না। যে ত্রিদেব থেকে মা দুর্গার জন্ম, সেই তো অশুভ শক্তিকে দমন করেছিল। এক্ষেত্রেও তাই। সুন্দরবনের অন্দরের গল্প দেখলে এটুকু বোঝা যায় যে সুন্দরবনের প্রতিটা মেয়ে বনবিবি। তাদের মধ্যে একটা ক্ষমতা আছে। আর শুধুই কি ঈশ্বরের ক্ষমতা, নয় তো! মেয়েদের মধ্যে যে শক্তি.. সেটাকে সেলিব্রেট করা। সেই নিয়ে ছবি বানানো আমাদের সকলের উচিত। কাজেই অহংকার বা কিছু রয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু, আমি বিষয়টাকে সমর্থন করি।
একটা ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করি, এই ছবির ট্রেলার দেখে কোথাও যেন মনে হল সন্দেশখালির ঘটনার সঙ্গে মিল রয়েছে..?
মিল বলতে পারি না। আমি এই ছবিতে অনেককিছুই দেখিয়েছি বা দেখানোর চেষ্টা করেছি। বর্তমান, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করলেও, বা যেই জায়গার কথা বলছেন সেটা বিচার করলেও দেখা যায়, আসল কথা হল নারীশক্তির জয়। সেটাই দেখানো হয়েছে এই ছবিতে। আমি এরকম অনেককিছুই দেখিয়েছি যেটা মানুষ কখনও ভাবতে পারেন না।
বিতর্ক তো আসতেই পারে, রিলিজের পর...
আমার মনে হয় না আসবে বলে। আগেকার দিনে যেমন বিধবা পল্লী ছিল। এখন আর নেই। আমাদের সমাজে তাঁদের একটা কোণায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উচিত ছিল, তাদেরকে রক্ষা করা। আমি এই ছবিতে এমন কিছু দেখিয়েছি যেটা কোথাও না কোথাও হয়, শুধু বিষয়টা আমি আলাদা রাখার চেষ্টা করেছি। এই যেমন বিধবাদের রং খেলা। বৃন্দাবনে তাঁরা ফুল দিয়ে রং খেলে, এখানে আমি সেটা দেখানোর চেষ্টা করেছি। গ্রামের কোণায় কোণায় কী কি ঘটেছে সেটা আমার ছবিতে দেখা যাবে।
ছবিতে পার্নো এবং আর্যর প্রেম.. 'অসমপ্রেম' শব্দটায় বিশ্বাস করেন?
না! প্রেমের কোনও অন্য অর্থ হয় না। প্রেম শুধু প্রেম হয়। ভালবাসার কোনও আংশিক অর্থ হয় না। কেউ কাউকে মন থেকে ভালবাসলে আর কোনও শব্দ আদৌ মায়নে রাখে? নিশ্চই না! আর এই ছবিতে পার্নো একজন বিধবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর স্বপ্নগুলো তো অধরা ছিল। সেখানে, একজনকে দেখে তাঁর মনে ধরেছে। এটাই তো স্বাভাবিক। আর আমার মনে হয় ছবির ক্ষেত্রে এটা প্রয়োজন ছিল।
দুই বাংলার পরিচালক হিসেবে কোনও পার্থক্য লক্ষ্য করতে পারেন?
গল্প বলার ধরনের মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। আমাদের একরকম ওদের আরেকরকম। এটা আমি প্রথমে বুঝতে পারতাম না। তারপর, দেখলাম কোনও একটা দৃশ্যে হয়তো অত্যধিক কমেডি দেখানো হয়েছে, যেটা আমার মনে হয় উচিত নয়। কিন্তু, তাদের ক্ষেত্রে ওটা আবার কাজ করে যায়। যদিও, ওদের সিনেমার প্রতি অনেকটা মুক্ত মানসিকতা এখন বাড়ছে। সবই পাল্টায়।
সুন্দরবন নিয়ে আর কোনও ছবি বানানোর ইচ্ছে রয়েছে?
অবশ্যই রয়েছে। এবং আমি বানাবোও। আমার জঙ্গলের প্রতি যে প্রেম, সেটা কিন্তু আজ থেকে না। বেনুদার ( সব্যসাচী চক্রবর্তী ) সঙ্গে আমার প্রথম জঙ্গলে যাওয়া। তারপর যখন, একদম গভীর অরণ্যে যেতে শুরু করলাম, দেখলাম সেখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা। আজও, সুন্দরবনের মানুষদের ৮৫ কিমি লঞ্চে ক্যানিং এসে সিনেমাহলে যেতে হয়। গ্রামের মানুষদের জীবনে অনেক গল্প রয়েছে। দেখেছিলাম, একটা বটতলায় রাত ৭টার পর একটা টিভি, আর তাতে সব বাংলা ছবি দেখানো হত। মানুষের যে বিনোদনের প্রতি ভালবাসা রয়েছে সেটা কিন্তু সত্যি কথা। কিন্তু, তাদের কাছে গিয়ে পৌছায় না শহরের মানুষরা। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।