রবিবার রাত আটটা। বাংলা নাট্যজগতের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। এ যেন মাতৃহারা হওয়ার শোক। চিরতরে বিদায় নিয়েছেন শাঁওলি মিত্র। 'নাথবতী'র প্রয়াণে 'অনাথবৎ' বাংলা নাট্যমহল। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেই চিরবিদায় নিলেন কিংবদন্তী নাট্যকারদ্বয় শম্ভু মিত্র ও তৃপ্রি মিত্র-কন্যা। শাঁওলির ইচ্ছেয় একেবারে অনাড়ম্বরভাবেই রবিবার রাতে সিরিটি শ্মশানে পঞ্চভূতে বিলীন হলেন তিনি। শোকস্তব্ধ নাট্যজগতের ব্যক্তিত্বরা।
দেবশঙ্কর হালদার বলছেন, "আমার নাট্যজীবনের শুরু এঁদের থিয়েটার দেখেই। যেমন গিরীশ ঘোষের অভিনয় দেখে শিশির কুমার ভাদুরী বলেছিলেন, উনি আমাকে হাতে ধরে শেখাননি কিন্তু ওঁর অভিনয় দেখে শিখেছি অভিনয় কাকে বলে। তেমনই শাঁওলি মিত্রের অভিনয় দেখে আমাদের মতো শিক্ষানবীশ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারতেন অনায়াসে। এবং সেই কারণেই নিয়মিত শাঁওলিদির অভিনয় দেখতাম। আর ওঁর বাচিক কিংবা শারীরিক অভিনয় হোক আর মস্তিষ্কের অভিনয় হোক বা আবেগের অভিনয়, সর্বত্রই একটা অদ্ভূত শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে পারতেন। সেগুলো আমাদের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের একটা পর্যায় ছিল। এছাড়াও আমার কোনও থিয়েটার দেখে যখনই ওঁর ভাল লেগেছে, সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানিয়েছেন। কোনখানে আরও জোর দিতে হত, কিংবা নাটকের কোন অংশটা বাদ দিলে আরও টানটান হত, এই সমস্ত উপদেশ সবসময়েই পেয়েছি ওঁর কাছ থেকে। আজ সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে।"
শোকস্তব্ধ দেবশঙ্কর আরও যোগ করলেন, "অগাধ জ্ঞান থাকলেও শাঁওলি মিত্রের মধ্যে সবসময়েই একজন পড়ুয়াকে লক্ষ্য করেছি। চারপাশ থেকে জানার আকাঙ্ক্ষা ছিল ওঁর মধ্যে। কথামৃতসমান, নাথবথী অনাথবৎ-এর কথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। এত মায়া এত শক্তি… শাঁওলিদি নেই আমাদের মধ্যে ভাবতেই পারছি না।"
বাংলা নাট্যজগতের অন্যতম অভিভাবক রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের মন্তব্য, বিগত কয়েক বছর ধরেই শাঁওলি স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন। এর মাঝে মঞ্চে কখনও তাঁকে দেখা যায়নি। ওঁর সঙ্গে আবার কাজ করব, এরকমটাই আশা ছিল। সেটা আর হল না। শাঁওলির মধ্যে শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র- দুই নাট্যব্যক্তিত্বের ক্ষমতাই সন্নিহিত ছিল। ওঁর চলে যাওয়াটা আমার একান্ত পারিবারিক ক্ষতি।
শেষ মুহূর্তে শাঁওলি মিত্রকে শেষ মুহূর্তে ছুঁতে পেরেছেন, এইটুকুই সান্ত্বনা নাট্যাকার দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর কথায়, "উনি শেষ মুহূর্তে যাঁদের চেয়েছিলেন কাছে থাকুক, তাঁর মধ্যে আমি একজন। ওঁর এই স্নেহ-ই আমার কাছে অনেক বড় পাওনা। মাথার ওপর একজন অভিভাবক ছিলেন এতদিন। যখনই কিছু লিখেছি, নতুন কাজে হাত দিয়েছি, একবার ওঁর কাছে গিয়ে পরামর্শ নিতাম যে, কেমন লাগল শাঁওলিদি? সেই কথা বলার মানুষটাকে হারিয়ে ফেললাম চিরতরে। একটা যুগের অবসান ঘটল।" কথাগুলো বলতে বলতেই গলা বুজে এল দেবেশের।
নান্দীকার-এর তরফেও প্রয়াত শাঁওলি মিত্রকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করলেন সোহিনী সেনগুপ্ত। রুদ্র-স্বাতী-কন্যা বললেন, "মা চলে যাওয়ার পর শৈশবের অনেক কথা বলতেন শাঁওলি মাসি। বলেছিলাম, কোভিড মিটলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাব। ছোটবেলায় যখন গ্যালিলিওর জীবন হত, মা (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) তখন আমাকে শাঁওলি মাসির জিম্মায় দিয়ে নিজের পার্ট করতে চলে যেত। তো উনি আমাকে কোলে বসিয়ে খাওয়াতেন। ওঁর গায়ে মায়ের গায়ের মতো গন্ধ পেতাম। তৃপ্তি জেঠি, শম্ভু জেঠু ওঁরা সকলে আমার পরিবারেরই অংশ ছিলেন। গত ১ বছরে মা, শাঁওলি মাসি অনেককে হারালাম। যখনই মাধবী নাটকটা করি, তখনই ওঁর কথা ভাবি। ভয় করে মাথার ওপর থেকে বড় গাছগুলো সবাই এক এক করে চলে যাচ্ছে।" ফেসবুকে লিখলেন, "নাট্যজগৎ আবারও মাতৃহারা। শাঁওলি মিত্রের প্রয়াণে আমরা শোকাহত। তাঁর প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম রইল।"
তাঁর 'শাঁওলি পিসি'কে হারিয়ে অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী বললেন, "অনেক আদর পেয়েছি, অনেক ভালোবাসা। অনেক কিছু শিখেছি… মঞ্চাভিনায়ের খুঁটিনাটি। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছি তাঁর অভিনয়, সেই ছোট্টবেলা থেকে। নাথবতী অনাথবৎ, কথা অমৃত সমান… আমার নাটক দেখে ফোন করে খুব প্রশংসা করেছিলেন। আনন্দে কেঁদে ই ফেলেছিলাম। বড় হয়ে একসঙ্গে একটা কাজ করার আর্জি নিয়েও গিয়েছিলাম, সিনেমায়। করেননি। তাই আর একসঙ্গে কাজ করার বা একদম সামনে থেকে অভিনয় দেখার সৌভাগ্য হল না। বেহালার বাড়িতেই শেষ দেখা। কত আদর করে কত কী খাইয়েছিলেন। আমি যে তাঁর বন্ধু বিপ্লবকেতনের মেয়ে। চলে গেলেন আমার শাঁওলি পিসি। বাংলা মঞ্চের নক্ষত্র পতন- একটা যুগের, একটা অভিনয়ের ধারার ধারক ও বাহক। কানে বাজছে সেই সুরেলা গলায় বলা সংলাপ-- মহাভারতের কথা অমৃত সমান…।"
পাঁচ বছর বয়সে চৈতী ঘোষালের সঙ্গে পরিচয় শাঁওলি মিত্রের। স্মৃতির অতল সাগরে ডুব দিয়ে বললেন, "ডাকঘর নাটকের সময় প্রথম পরিচয়। অমলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। শাঁওলিদি আমাকে কোলে করে এনে মঞ্চে বসিয়ে দিতেন। বিরতির মাঝে এসে দুধ, চকোলেট খাইয়ে দিতেন। সেই নাটকে অভিনয় করার সময় ওই বয়সেও কত উচ্চারণ শুধরে দিয়েছিলেন তিনি। মানুষ চৈতী ঘোষালর গড়ে ওঠার নেপথ্যে আজ ওঁর অবদান অনেকটাই। গত কয়েকদিন থেকেই মনটা টানছিল। ভাবছিলাম ফোন করব। কয়েকটা কথা বলার ছিল। সেটা আর হয়ে উঠল না। এটা টেলিপ্যাথি না আত্মীক যোগ, কী বলব জানা নেই। তবে আমার শৈশবের স্মৃতিটা এলোমেলো হয়ে গেল শাঁওলিদির প্রয়াণে।"
এক বছর আগেই জন্মদাত্রী মাকে হারিয়েছেন নাট্যকার অর্পিতা ঘোষ। শাঁওলি মিত্রের প্রয়াণের শোকও তার চাইতে কম কিছু নয় তাঁর কাছে। এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন, "আমার আরেক মাকে হারালাম। কীভাবে শিড়দাঁড়া সোজা রেখে চলতে হয়, ওঁর কাছ থেকেই পাঠ পেয়েছি। উনি শিখিয়েছিলেন জীবনকে দেখতে। আমার কাছে একটা অধ্যায়ের অবসান হল। আমাকে সবসময়ে বলতেন শাঁওলিদি, কারও কথায় কান দিবি না। তুই যেটা ঠিক মনে করবি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেটাই করার চেষ্টা করবি।"
সারা জীবনের মতো শেষযাত্রাতেও প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন। হলও তাই। সকলের অগোচরেই শেষকৃত্যসম্পন্ন হল তাঁর। তবে সোমবার প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব শাঁওলি মিত্রকে শ্রদ্ধা জানাতে রাজ্য সরকারের তরফে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হল। বেলা ১টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত রবীন্দ্র সদনে রাখা শাঁওলির প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করতে পারবেন অনুরাগীরা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন