কোন ছবি পুরস্কৃত হতে পারে, বা হবে, এই নিয়ে সাধারণ দর্শক অথবা সমালোচক মহল সর্বদাই দোলাচলে, জুরি তথা বিচারককুল ঘুণাক্ষরেও জানতে দেন না। এটাই রীতি। ছবির ভালোমন্দ গুণাগুণ বিচারের সার্বিক দায় জুরিদের মেনে নিতে হয় আমাদের, দর্শক-সমালোচকদের। মেনে নিলেও অবশ্য দর্শক-সমালোচক ধিক্কারধ্বনি, কুকথা বলতে দ্বিধাহীন।
যেমন শোনা গেল ৭০ বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে, সাত-সদস্যের জুরির বিচারে কোন ছবি শ্রেষ্ঠ, কোন পরিচালক শ্রেষ্ঠ, কোন অভিনেতা-অভিনেত্রী শ্রেষ্ঠ, প্রেক্ষাগৃহে। পুরস্কার ঘোষণার পরেই। জুরিদের কেউই ব্যাখ্যা করেন নি তাঁদের বিচারের মাপকাঠি, জুরিপ্রধান জেরেমি আয়রনস সংক্ষিপ্ত ভাষণে শুধু বললেন, "আমাদের (জুরিকুলের) সর্বসম্মতির ফলাফল এই পুরস্কার। আমাদের বিচারে নাখুশ হলে আমরা নিরুপায়।" এটা ঠিক যে, সব পুরস্কারেই পক্ষপাতিত্ব আছে, বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও আছে, কান ও ভেনিসেও আছে। সবসময়ই দেখি।
আরও পড়ুন: বিশ্ব দরবারে পিছিয়ে পড়ছে ভারতীয় ছবি, প্রমাণ বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব
৭০ বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (যার পোশাকি নাম 'বার্লিনাল') সাতজন জুরি সদস্য, তাঁদের প্রধান হলেন ব্রিটিশ অভিনেতা জেরেমি আয়রনস। জুরিপ্রধান বাদে ছ'জনের মধ্যে তিনজন নারী, তিনজন পুরুষ। এও বাহুল্য। মূল প্রতিযোগিতায় ১৯টি ছবির মধ্যে আটটিরই পরিচালক মহিলা। রেকর্ড সংখ্যক মহিলা পরিচালক। কারণও আছে। ফেমিনিজমের প্রাধান্য। কেন ফেমিনিজম, ব্যাখ্যা এই, সত্তর বছরের 'বার্লিনাল' ইতিহাসে এই প্রথম দুজন উৎসবকর্তা - একজন নারী, একজন পুরুষ। মারিয়েটা রিসানবেক (জার্মান), এবং কার্লো শাত্রিয়ান (ইটালিয়ান)।
বিশ্বজুড়ে বিস্তর মহিলা সিনেপরিচালক, তাঁদের জন্য সব আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব দিলখোলা নয়, ব্যতিক্রম কালেভদ্রে। সেদিক থেকে 'বার্লিনাল' দ্বার উন্মুক্ত করল। ফেমিনিস্টরা মহাখুশি।
জুরিদের বিচারে শ্রেষ্ঠ ছবির ভূষণ পেল 'দেয়ার ইজ নো ইভিল (There is no Evil)', পরিচালক মহম্মদ রাসুলফ। ইরানের ছবি। পরিচালক এখন ইরানে, গৃহবন্দী। পুরস্কার গ্রহণ করেন রাসুলফের কন্যা, তাঁর নিবাস হামবুর্গে। শ্রেষ্ঠ পরিচালক হং সাংসু, ছবি 'দ্য ওম্যান হু র্যান (The Woman who Ran)'। পরিচালক দক্ষিণ কোরিয়ার। ছবিতে রাজনীতি ও প্রেম একাকার।
শ্রেষ্ঠ অভিনেতার শিরোপা পেলেন এলিও জার্মানো, ছবির নাম 'ভোলেভো নাসকনদেরমি (ইংরেজিতে 'Hidden Away')', পরিচালক জর্জিও দিরিত্তি। ছবিতে দ্বৈত ভূমিকায় জার্মানো। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী জার্মানির পাউলা বিয়ার। অভিনয় করেছেন ক্রিস্টিয়ান পেৎসওল্ড পরিচালিত 'উনডিনে (Undine)' ছবিতে। পাউলা বিয়ার ইদানীং জার্মান ছবিতে জনপ্রিয়, এবং পারিশ্রমিকও বেশি পান।
আরও পড়ুন: ‘কাকাবাবু’কে নিয়ে আফ্রিকা পাড়ি সৃজিতের
এবারই প্রথম মূল প্রতিযোগিতার বিকল্প হিসেবে 'এনকাউন্টার' বিভাগ, তাতে ভারতের ছবি 'লায়লা আউর সাত গীত (Laila Aur Satt Geet)', পরিচালক পুষ্পেন্দ্র সিং। অভিনেত্রী নভজ্যোত রানধাওয়া, অভিনেতা সাদাক্কিত বিজরান, শাহনাওয়াজ বাট। মূল কাহিনি রাজস্থানের লোকগাথা হলেও ঘটনার প্রেক্ষাপট কাশ্মীরের পার্বত্য অঞ্চল। শুরুটা রাজনৈতিক, কাশ্মীরের রাজনীতি, হালের রাজনীতি। পুষ্পেন্দ্র সিং জানান, "কাশ্মীর নিয়ে বেশি রাজনীতি ঘাঁটলে বিপদ।"
এরপর কাহিনি ঘুরে যায় নব্বুই ডিগ্রি। নিছকই প্রেমের গল্প। মিষ্টি প্রেম, টানাপোড়েন, নায়িকার শরীর-মন উদ্বেল। শেষ দৃশ্যে একেবারে উদোম। তাঁর দৈহিক সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রকৃতির সঘনতার কাব্যিক সম্মিলন। এতটাই যে, নগ্নতা ছবির শৈল্পিক চারুকলায় ঘনবদ্ধ। দর্শক লুফে নিয়েছেন লায়লাকে। কারণ বোধহয় লায়লাই। নভজ্যোত রানধাওয়া অতীব সুন্দরী যুবতী, অভিনয়ও যাকে বলে 'ফাটাফাটি'।
মহম্মদ রাসুলফের 'দেয়ার ইজ নো ইভিল' ইন্ডিপেন্ডেন্ট জুরি এবং গিল্ড ফিল্ম প্রাইজও পেয়েছে। ছবিটি চার পর্বে বিভক্ত। ছবিতে ইরানের বর্তমান রাজনীতির মুখোশ উন্মোচিত। এই উন্মোচনকেই পছন্দ করে জুরিকুল 'দেয়ার ইজ নো ইভিল'-কে শ্রেষ্ঠ ছবির উপাধি দিয়েছেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন