চলতি মাসেই ফিলিপিনসের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির শতবর্ষ, বিশ্ব সিনেমায় নিজস্ব গরিমা এখন পাকাপোক্ত, প্রমাণিত বহুদিনই, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রায়-স্থায়ী আসন। গত দুই দশকের বেশি, নামীদামী ফেস্টিভ্যালে ফিলিপিনসের ছবি প্রদর্শিত, পুরস্কৃত। দর্শক-সমালোচকের আদরও কাড়ছে যথেষ্ট। সেই তুলনায় ভারতীয় ছবি ক্রমশ পিছিয়ে।
গত শতকের শেষ পর্বে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (পোশাকি নাম 'বার্লিনাল') ভারত থেকে মূল প্রতিযোগিতায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিই ছিল শেষ, এরপরে এখনও পর্যন্ত আর কোনও ভারতীয় ছবি স্থান পায় নি, তথা মনোনীত হয় নি (প্রতিযোগিতায়)। তবে অন্যান্য বিভাগে, যথা প্যানোরামা, ফোরাম, জেনারেশন, তথ্যচিত্র (ডকুমেন্টারি), ঠাঁই পেয়েছে। এবারও পেয়েছে। চার বিভাগে চারটি। কোনও ছবিই সাড়া জাগায় নি, না দর্শককুলে, না সমালোচক মহলে।
প্রচারণায় যদিও কমতি নেই। ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম মার্কেটে সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের বড় স্টল, ছবি বিক্রির জন্য কাকুতি, সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে সত্যজিতের ছবি দিয়ে ঢাউস পোস্টার, সঙ্গে 'পথের পাঁচালী'র ছবি ও পোস্টার। স্টল উদ্বোধন করেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর। অবশ্য, স্টল উদ্বোধন করতে বার্লিনে আসেন নি, এসেছিলেন জার্মান বিদেশ মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে, ভিন্ন দৌত্যে। ঘটনাচক্রে বার্লিনালের উৎসব ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে, জয়শঙ্কর স্টল উদ্বোধন করলেন ১৯ ফেব্রুয়ারি। তিনি চলচ্চিত্র বোদ্ধা নন, ঘোড়েল কূটনীতিক, কায়দা করে বললেন, "ভারতীয় চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা আমাদের সর্বদাই, সরকারি আনুকূল্যে কোনও বাধা নেই। ভারতের সব ভাষার চলচ্চিত্রই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য।"
আরও পড়ুন: বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব: আছে শীত, সিএএ, গণহত্যা…আছে ছবিও
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ভারতের ছবি কেন পাত্তা পাচ্ছে না, জায়গা পাচ্ছে না, মূলে কী দুর্দশা, সরকারের সেন্সর নীতি, চোখ রাঙানি, কারা মাতব্বর, কী রাজনীতি, হরেকরকম গিঁট, বাধা, শিল্প-সংস্কৃতির নামে কেন উঁচুমহলের দোর্দণ্ড প্রতাপ, এই নিয়ে কোনও প্রশ্ন করে নি কেউ, করলে ঝানু কূটনীতিক কী উত্তর দিতেন, অজানা। জয়শঙ্করকে মনে হয়েছে, অন্তত তাঁর কথায়, বাচনভঙ্গিতে, অতিশয় মৃদুভাষী, নিপাট ভদ্রলোক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, স্টলে ফিতে কেটেই মিনিট চারেক সময় কাটিয়ে দ্রুত প্রস্থান। মনে হলো, ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি।
এবছর বার্লিনালের সত্তর, যতটা জাঁকজমক আশা করেছিলুম, ছিটেফোঁটাও নেই। সবই নর্মাল, গতানুগতিক। তবে রদবদল কিছুটা। এর আগে উৎসবকর্তা ছিলেন একজন। 'সত্তর বছর' থেকে দুজন। একজন মহিলা, একজন পুরুষ, 'নরনারীর সমবণ্টন'। মারিয়েটা রিসানবেক (জার্মান), এবং কার্লো শাত্রিয়ান (ইটালিয়ান)। উৎসবের জুরিপ্রধান ব্রিটিশ অভিনেতা জেরেমি আয়রনস। তাঁকে নিয়ে জুরিতে সাতজন সদস্য, তিনজন নারী, তিনজন পুরুষ। এখানেও ফেমিনিজম,'নারীপুরুষ সমবণ্টন'। এও বাহুল্য। মূল প্রতিযোগিতায় ১৮টি ছবির মধ্যে আটটিই মহিলা পরিচালকের ছবি।
আরও পড়ুন: ৭০ বার্লিনাল – এবার ভিন্ন মেজাজে, চেহারায়
প্রত্যেক মহিলা পরিচালক উত্তম নিশ্চয়ই নন, তবে তাঁদের কয়েকটি ছবি রীতিমত চোখ ধাঁধিয়েছে। আন্দোলিত দর্শক, সমালোচক। ব্রিটিশ পরিচালক স্যালি পটার ('দ্য রোডস নট টেকেন') চমৎকার কাহিনি ফেঁদেছেন, ডিমেনশিয়াগ্রস্ত এক পুরুষের (যিনি স্বামী এবং পিতা) জীবনচরিত। ছবির পরতে পরতে টেনশন। অভিনয়ে বহুখ্যাত হাভিয়ার বারদেম, সালমা হায়েক, এবং এল ফ্যানিং (Elle Fanning)। নতুন অভিনেত্রী এল ফ্যানিং, ব্রিটিশ, বয়স একুশ। 'ফাটাফাটি' অভিনয়। সাংবাদিক সম্মেলনে সালমা বললেন, 'এল ফ্যানিং-এর কাছে আমি ম্লান।"
জার্মান যে তিনটি ছবি প্রতিযোগিতায়, কোনোটিই দর্শকের বাহবা পায় নি। অ্যালফ্রেড ড্যয়েবলিনের বহুল পঠিত উপন্যাস 'বার্লিন অ্যালেক্সান্ডারপ্লাৎস'-এর চিত্রায়ন করেছেন বুরহান কুরবানি, উপন্যাসের খোলনলচে পাল্টে উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে, মূলে গোঁজামিল।
বার্লিনালে বিস্তর দর্শক-প্রিয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রীর ভিড়, কিন্তু ছবির মান আশাব্যঞ্জক নয়। প্রশ্ন সর্বত্র। বিশ্বে ভালো ছবির আকাল, '৭০ বার্লিনালে'ও।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন