দক্ষিণ কলকাতার বনেদী বাড়িগুলির মধ্যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য চারুভবন। ওই নামেই পরিচিত বাংলার জাতীয়বাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারের আবাসস্থলটি। এই বছর ৯২ বছরে পড়বে চারুভবনের পুজো। পরিবারের পুত্রবধূ ঈশিতা বিয়ের পরেই শুরু করেন তাঁর অভিনয় জীবন। বাড়ির পুজো এবং অভিনেত্রী হয়ে ওঠা, দুটি গল্পই শোনালেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে।
''আমার বিয়ে হয় ১৯৯৫ সালে। খুবই রক্ষণশীল পরিবার। তখনও নিয়ম ছিল শাড়ি ছাড়া কিছু পরা যাবে না আর সব সময় মাথায় ঘোমটা টেনে থাকতে হবে। সেখান থেকেই পরে অভিনেত্রী হয়ে ওঠা আমার স্বামী ও আমার বাবার উৎসাহে। শ্রী চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে আমার দাদাশ্বশুর। এবাড়ির পুজোর প্রবর্তন করেন তিনি। তবে পুজোটা অভয়চরণ চট্টোপাধ্যায় ফ্যামিলি ট্রাস্ট পরিচালিত। দাদুরা ৪ ভাই ছিলেন, তাঁদের বাবার নামেই ট্রাস্ট, তাঁর নামেই পুজো। আমাদের পুজোতে দাদুর বাকি ৩ ভাইয়ের পরিবারও আসেন'', বলেন ঈশিতা, ''আমাদের পুজো বৈষ্ণব মতে হয় তাই দশমীর বিসর্জন হওয়ার আগে পর্যন্ত শুধুই নিরামিষ। এছাড়া আমাদের বাড়ির গৃহদেবতা হলেন লক্ষ্মী-নারায়ণ। তাঁর নিত্যপূজা হয়।''
আরও পড়ুন: শোভাবাজারের মিত্র বাড়ির বউ সঙঘশ্রী! শোনালেন ৩৭২ বছরের পুজোর গল্প
ঈশিতা জানালেন, চারুভবনের এই পুজোয় ঠাকুরকে পরিবারের সদস্যের মতোই দেখা হয়। যেমন সবাই সকালে উঠে ব্রাশ করেন, তেমনই মা দুর্গাকে এখানে সকালে মুখ ধোয়ার জন্য লেবু ও নুনজল দেওয়া হয়। তার পরে তেল ও গঙ্গামাটি দিয়ে ঠাকুরের স্নান। এই সব কাজই করেন বাড়ির বউরা, ছেলেমেয়েরা। ততক্ষণে মায়ের জলখাবারের আয়োজন করেন অন্যদল। এই বাড়িতে ঠাকুরকে জলখাবারে খেতে দেওয়া হয় ফল, চিঁড়ে-মুড়কি, মিষ্টি দই, লাঞ্চে এক একদিন এক রকম মেনু। সন্ধেবেলা মা দুর্গাকে লুচি-হালুয়া-মিষ্টি দেওয়া হয়, সেটাই ওঁর ডিনার।
ঠাকুরের জলখাবার খাওয়ার পরে তাঁর পুজো এবং অঞ্জলি। সেই সময় আবার শুরু হয়ে যায় লাঞ্চের আয়োজন। ''সপ্তমীর লাঞ্চে থাকে ভাত-কড়াইয়ের ডাল, পোস্ত, নানা রকম ভাজা, চাটনি, পায়েস ও মিষ্টি। অষ্টমীতে হয় খিচুড়ি, নানা রকম ভাজা, তরকারি, চাটনি, পায়েস ও মিষ্টি। নবমীতে হয় পোলাও, নানা রকম ভাজা, পনিরের তরকারি অথবা ছানার ডালনা, আরও অন্য কোনও নিরামিষ তরকারি, চাটনি, পায়েস ও মিষ্টি'', বলেন ঈশিতা।
সন্ধিপুজোতে অপরাজিতার মালা পরানো হয় ঠাকুরকে, সঙ্গে থাকে নিয়মমাফিক ১০৮টি পদ্ম নিবেদন। পরিবারের সদস্যরা, বিশেষত মেয়েরা শাড়ি, সাজের নানা জিনিস, মিষ্টি, এসব দিয়ে পুজো দেন, জানালেন ঈশিতা। সন্ধিপুজোয় শশা-চালকুমড়ো-আখ বলি হয় আর নবমীতে হয় কুমারী পুজো। এই বাড়িতে ঠাকুরকে বাতাস করার জন্য রয়েছে দুটি বিরাট বড় হাতপাখা। পরিবারের সবাই এবং নিমন্ত্রিতরা পালা করে বাতাস করেন।
আরও পড়ুন: ছেলেকে নিয়ে পায়েল-দ্বৈপায়নের প্রথম বিদেশভ্রমণ এই পুজোতে
খুবই অল্প বয়সে এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসেন ঈশিতা। তাঁর দুই ছেলে। বড়ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়মে প্রয়াত রমাপ্রসাদ বণিকের নাটকের ক্লাসে। তখন থেকেই অভিনয় শেখার ইচ্ছা হয়। ''আমি স্যারকে বলেছিলাম, আমাদের বড়দের জন্য কি কিছুই নেই? উনি বলেছিলেন কোথায় পাঠাব, সবই তো বিজনেসের জায়গা। তার একমাসের মধ্যেই স্যার বড়দের জন্য ক্লাস চালু করেন। আমার জীবনকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গিয়েছেন স্যার। আমাদের বাড়ির পুজোতে একবারই এসেছিলেন। ২০১০ থেকে আমার পর্দায় অভিনয় শুরু হয়, ওই বছরই ডিসেম্বরে স্যার চলে গেলেন। আমার অল্প কিছু কাজ দেখে গিয়েছিলেন, যেমন-- রবি ওঝা প্রোডাকশন্সের ওগো বধূ সুন্দরী। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে স্যারের অভাবটা অপূরণীয়'', বলেন ঈশিতা।
এখনও পর্যন্ত ১৬টি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন ঈশিতা, তার মধ্যে রয়েছে 'রোমিও', 'অভিমান', 'বলো দুগ্গা মাই কী'-র মতো ব্লকবাস্টার ছবিও। পাশাপাশি ছোটপর্দার বহু ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন তিনি। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর দুপুর ১টায় জি বাংলা সিনেমা-তে রয়েছে জি বাংলা অরিজিনাল 'চরকি'। মুখ্য চরিত্রের পিসির ভূমিকায় রয়েছেন ঈশিতা। প্রথম প্রথম পরিবারের কিছু সদস্য, আত্মীয়স্বজনদের পর্দায় অভিনয়ের বিষয়টা নিয়ে আপত্তি থাকলেও, এখন আর কাজ করতে কোনও সমস্যা হয় না ঈশিতার। দক্ষ হাতে সংসার সামলানো, ছেলেদের মানুষ করা, অভিনয়, বিজ্ঞাপনের কাজ সবই করছেন। মা দুর্গাকে তো নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, ঈশিতার জীবনেও সেই ক্ষমতায়ন ঘটেছে। এই ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য তিনি বটেই, পাশাপাশি তাঁর নিজেরও একটি অস্তিত্ব গড়ে উঠেছে।