Advertisment
Presenting Partner
Desktop GIF

রিমেক লেখার চাপ থেকে বকেয়া টাকা, বাংলার চিত্রনাট্যকারদের ঠিক কী কী চ্যালেঞ্জ?

সিনেমা হোক বা সিরিয়াল, কনটেন্ট ইজ দ্য কিং। অথচ বাংলার চিত্রনাট্যকারদের অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে কাজ করে যেতে হয়। ঠিক কী কী তা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে জানালেন সমসাময়িক লেখকেরা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Challenges and problems faced by Bengali film, television and web screenwriters

প্রতীকী ছবি: শাঁওলি দেবনাথ

খুব কম পরিচালকই চিত্রনাট্য ছাড়াই সিনেমার শুটিং করার কথা ভাবেন। এক্সপেরিমেন্টাল কোনও কাজে সেটা ঘটলেও, যে ছবি বা ধারাবাহিক বা সিরিজ বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত হয়, সেখানে শুটিংয়ের আগে চিত্রনাট্য তৈরি হওয়া প্রয়োজন। একটি ছবি, ধারাবাহিক অথবা সিরিজ কতটা সফল হবে, তার অনেকটাই নির্ভর করে সংলাপ ও চিত্রনাট্যের উপর।

Advertisment

বাংলা ছবির জগৎ, বাংলা টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি এবং সদ্য উদ্ভুত বাংলা ওয়েব সিরিজের পরিসরে যে সমস্ত চিত্রনাট্যকাররা কাজ করছেন, তাঁদের ঠিক কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে অথবা সত্যিই কি কোনও বিশেষ সমস্যায় তাঁরা জর্জরিত? এই প্রশ্নের উত্তরে সমসাময়িক লেখকেরা যা বললেন সেখান থেকে উঠে এল বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের প্রসঙ্গ--

রিমেক বনাম অরিজিনাল

এই মাধ্যমে চিত্রনাট্যকারদের মূল সমস্যা রিমেক লেখার চাপ এবং প্লেজিয়ারিজম। বহু প্রযোজক বাজেট কমানোর প্রয়োজনে রিমেক ছবি বানাতেই বেশি আগ্রহী। তাই ছবি-লেখকদের কোনও উপায় থাকে না। এই প্রসঙ্গে আলোকপাত করলেন 'শিকারি', 'নবাব'-সহ বহু বাণিজ্যিক বাংলা ছবির চিত্রনাট্যকার পেলে ভট্টাচার্য-- ''আমরা নিজের লেখা নিয়ে এগোতে পারি না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রিমেক লিখতে হয় এবং রিমেক লিখি বলে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হতে হয় আমাদের। আসলে শিবপ্রসাদ, কৌশিক গাঙ্গুলি অথবা সৃজিত মুখোপাধ্যায় নিজেদের চিত্রনাট্য নিজেই লেখেন। আমরা যাঁরা ডিরেক্টর-রাইটার নই, শুধু রাইটার, রিমেক ছবির সময় তাঁদেরই ডাকেন প্রযোজকরা। পেশার তাগিদে আমাদের লিখতেও হয়। তাঁদেরও সব সময় দোষ দেওয়া যায় না। দিন বাড়লেই পয়সা বাড়ে। তাই রিমেক ছবি করে কম বাজেটে ফিট করার চেষ্টা। আমাদের নিজেদের গল্প নিয়েও এগোতে পারি না। হয়তো ৭০টা গল্প ভেবে রেখেছি আমি কিন্তু প্রযোজক সে সব না শুনে, তাঁর নিজের ভাবা কোনও প্লট নিয়েই লিখতে বললেন।''

আরও একটি বড় সমস্যা হল কনসেপ্ট চুরি যাওয়া। পেলে ভট্টাচার্যের বক্তব্য, কনসেপ্ট চুরি করা অত্যন্ত সহজ এবং তা আকছার ঘটে থাকে বাংলায়। স্ক্রিন রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনে কোনও কনসেপ্ট রেজিস্ট্রেশন করার পরেও সেটা চুরি যেতে পারে-- ''আমি লিখলাম যে নীলাঞ্জন দুর্গাপুর থেকে কলকাতায় এসে মীরার প্রেমে পড়ল। সেটাকে অন্য কেউ হয়তো এইভাবে বললেন যে অমিত শিলিগুড়ি থেকে হাওড়া স্টেশনে এসে নামলেন। তার সঙ্গে ঊষসীর দেখা হল এবং ওদের মধ্যে প্রেম হল। চুরিগুলো এমন ভাবে হয় যে সব সময় চ্যালেঞ্জ করার সুযোগও থাকে না।''

আরও পড়ুন: টেলি রিভিউ: চেনা ছকের গল্পে প্রাপ্তি নিষ্পাপ প্রেম ও নায়ক-নায়িকার রসায়ন

প্রি-প্রোডাকশন বাজেটই নেই

পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, বাংলা সিনেমার প্রথিতযশা চিত্রনাট্যকার জানালেন, ''বাংলা ছবিতে কোনও প্রি-প্রোডাকশন বাজেট না থাকার জন্য কোনও স্ক্রিপ্ট বা কনসেপ্ট জমা দেওয়ার পরে যদি ছবিটা না হয়, তবে লেখক তাঁর পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হন। টেলিভিশনে এমন বহু রাইটার রয়েছেন যাঁরা ভাল সিনেমা লিখতে পারেন কিন্তু তাঁরা পেমেন্ট-জনিত কিছু সমস্যার জন্য সিনেমা লিখতে চান না। কিন্তু লেখক খসড়া জমা দিলেও বা একটি কনসেপ্ট ডেভেলপ করলেও তার জন্য একটা পারিশ্রমিক তাঁর প্রাপ্য। এটা কিন্তু মুম্বইতে আছে এবং আমাদের এখানেও এই প্র্যাকটিস চালু করা উচিত।''

Challenges and problems faced by Bengali film, television and web screenwriters বাঁদিকে পদ্মনাভ দাশগুপ্ত ও ডানদিকে দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত। ছবি: ফেসবুক প্রোফাইল থেকে

ধারাবাহিক চাপ

সবচেয়ে বেশি চাপের মধ্যে কাজ করতে হয় সিরিয়ালের চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতাদের। সিরিয়াল শুরুর আগে অনেকটা সময় হাতে নিয়ে প্রথম ২০-৩০টি এপিসোড লেখা হয় কারণ প্রথম একমাসে যদি কোনও ধারাবাহিক দর্শককে না টানতে পারে তবে ভবিষ্যতে তার টিআরপি বাড়ানো কঠিন হয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই এপিসোড ব্যাঙ্কিং কিন্তু থাকে না সম্প্রচার শুরু হওয়ার পরে। তখন চ্যানেল প্রতি মুহূর্তে তার স্ট্র্যাটেজি পর্যালোচনা করে মার্কেট স্টাডি অনুযায়ী, সেই অনুসারে ধারাবাহিকের গতি-প্রকৃতি বদলায় এবং তার ফলে শেষ মুহূর্তের চাপ এসে পড়ে লেখকদের উপর।

''একজন সিরিয়াল লেখককে দিনে গড়ে ২০ থেকে ৩০ মিনিটের কনটেন্ট লিখতে হয়। অর্থাৎ প্রত্যেকদিন ৩০ পাতা করে লেখা। কোয়ালিটি ধরে রাখা কঠিন। মেগাসিরিয়াল লেখাটা কোথাও যেন ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের ফাঁদে পড়ে গিয়েছে, বলেন লুকোচুরি, ভুলে যেওনা প্লিজ ধারাবাহিকের চিত্রনাট্যকার অর্কদীপ নাথ।

'নেতাজি', 'সৌদামিনীর সংসার' ইত্যাদি ধারাবাহিকের সহ-চিত্রনাট্যকার অশ্রনু জানালেন, ''আমাদের বাজেট অনুযায়ী চিত্রনাট্য লিখতে হয়। সেটা কাজটা আরও একটু কঠিন করে দেয় কারণ সেট, প্রপস ইত্যাদি কতটা কী পাওয়া যাবে, সেটা মাথায় রেখে লিখতে হয়। আর একটা অসুবিধে হল ধরুন স্ক্রিনপ্লে লিখে ছেড়ে দিলেন। ঠিক আগের দিন জানা গেল, অমুক আর্টিস্ট অসুস্থ। সেই জায়গা থেকে পুরোটা চেঞ্জ করতে হয়।''

আরও পড়ুন: ‘বাংলা সিনেমা দেখা যায় না! বাংলা ওয়েব সিরিজ গারবেজ’

বকেয়া পেমেন্ট ও কম পারিশ্রমিক

প্রায় সব চিত্রনাট্যকারেরাই এই একটি সমস্যার কথা জানিয়েছেন। বেশিরভাগেরই বক্তব্য, সিনেমার ক্ষেত্রে ভেঙ্কটেশ অথবা এসকে মুভিজের মতো বড় সংস্থাগুলিতে পেমেন্টের কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ছোট সংস্থাগুলিতে পেমেন্ট দীর্ঘ সময় বকেয়া থাকার সমস্যা রয়েছে। টেলিভিশনের তুলনায় বাংলা সিনেমা ও বাংলা ওয়েব সিরিজের ক্ষেত্রে পেমেন্ট বকেয়া রাখার সমস্যাটা বেশি, এমনটাই জানালেন কর্কটরোগ ওয়েবসিরিজের চিত্রনাট্যকার দীপাঞ্জন চন্দ। বাংলা ধারাবাহিক ও ছবির চিত্রনাট্যকার দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত এই প্রসঙ্গে বলেন, ''পেমেন্টের ব্যাপারে অদ্ভুত নিরাসক্তি কাজ করে।''

পাশাপাশি যে সমস্যাটা উঠে আসছে তা হল অপেক্ষাকৃত কম পারিশ্রমিকে কাজ করার চাপ। ''কোন কাজের জন্য কত টাকা চাইতে হয় তা এখানকার বেশিরভাগ লেখকেরাই জানেন না। তাই লেখকেরা এক্সপ্লয়েটেড হয়। আর বহু প্রযোজক তার সুযোগ নিয়ে কম টাকা দেওয়ার চেষ্টা করে। হয়তো বলে অমুক বড় রাইটার তো প্রায় অর্ধেক টাকায় লেখে ইত্যাদি'', বলেন 'বোঝেনা সে বোঝেনা' ধারাবাহিকের রচয়িতা দীপাঞ্জন চন্দ।

Challenges and problems faced by Bengali film, television and web screenwriters বাঁদিকে দীপাঞ্জন চন্দ ও ডানদিকে পেলে ভট্টাচার্য।ছবি সৌজন্য: লেখক

ভাল কনটেন্টের অভাব

''বাংলায় সিনেমার চিত্রনাট্যকারদের সবচেয়ে বড় অসুবিধে ভাল কনটেন্টের অভাব। অসাধারণ কিছু বাংলা সাহিত্য রয়েছে যা আমরা এক্সপ্লোর করতে পারি না বাজেটের জন্য। দর্শক হলে গিয়ে রেভিনিউটা কনফর্ম করছেন না তাই বিগ বাজেট ইনভেস্টমেন্টও হচ্ছে না। কনটেন্টের অভাবে প্রচুর রিপিটেশন হয়ে চলেছে, আমরা পাথব্রেকিং কিছু পাচ্ছি না'', বলেন পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, ''আর বাংলা ওয়েবের সমস্যা বাজার ঠিক করে দিচ্ছে ট্রেন্ড। এই মুহূর্তে ওয়েবে হয় খুন নয় সম্পর্কের উষ্ণতা নিয়ে লেখার অনুরোধ আসে বেশি। অথচ আজ যদি তুঙ্গভদ্রার তীরে-র মতো কোনও কনটেন্ট হিট করে যায়, তবে কিন্তু ওই রকম পর পর কনটেন্ট হতেই থাকবে।''

তবুও সিনেমায় ভাল কনটেন্ট লেখার স্বাধীনতাটুকু আছে, এমনটাই মনে করেন দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত-- ''মেগা-তে যা লিখতে হয়, প্রায় অনুলিখনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। যেটুকু টুকটাক লিখছি সিনেমাই ঠিক জায়গা।'' এই কথার সূত্র ধরেই উঠে আসছে আরও একটি দিক, তা হল ঠিকঠাক ওয়েব কনটেন্ট কী, ওয়েব সিরিজে একটি কনটেন্টকে কীভাবে উপস্থাপনা করতে হবে, এই আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে, এমনটাই জানালেন দীপাঞ্জন চন্দ, ''ওয়েবসিরিজের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পর্ক সিনেমার। রিয়্যালিস্টিক ট্রিটমেন্ট, রিয়েল লোকেশন শুট এই সব কিছুই ওয়েবসিরিজে থাকে। তাই আরও বেশি করে বাংলার ওয়েব মাধ্যমের অপারেশনে আসা উচিত আন্তর্জাতিক মানের ফিল্মমেকারদের। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য বা আদিত্যবিক্রমের মতো মেকাররা যদি ওয়েব কনটেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকেন তবে লেখকদের অনেকটা সুবিধে হয়।''

আরও পড়ুন: টেলি রিভিউ: টকঝাল কমেডির সঙ্গে ঘন আবেগ, মন ভরায় ‘সৌদামিনীর সংসার’

স্বীকৃতি ও ঘরানা অনুপস্থিত

প্রত্যেকেই তাঁদের কাজের স্বীকৃতি পেতে চান। চিত্রনাট্যকারেরাও তাই। দেবপ্রতিম দাশগুপ্তের বক্তব্য, বিশেষ করে সিরিয়ালে সংলাপের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অথচ কখনও কোনও টেলি-পুরস্কারে সংলাপ রচয়িতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। অথচ সিরিয়াল মানুষ দেখেন কম, শোনেন বেশি। এর পাশাপাশি আরও একটি বিষয় উঠে এল তা হল চিত্রনাট্য লেখার ক্ষেত্রে উপযুক্ত লালনের অভাব।

''কলকাতায় আমার যেটা মনে হয়, সিনেমার ল্যাঙ্গোয়েজ যাঁরা লিখতেন একটা সময়, তাঁরা এখন অনুপস্থিত। চিত্রনাট্য লেখা অনেকটা ক্লাসিকাল মিউজিকের মতো। নাড়া না বাঁধলে ফিল্ম রাইটিং বা মেকিংয়ের তালিম নেওয়া যায় না। আমরা নাড়া বাঁধার মতো গুরুগৃহই পাই না। আমরা এখন বড্ড ক্লিশে জিনিস নিয়ে কাজ করছি। গিমিক কনটেন্ট দিতে হবে। তামিল ছবি নকল করতে হবে। কিন্তু নকল করলেও সেটা এমনভাবে লেখা উচিত যাতে বাংলার ট্রাডিশন ও ভ্যালু সিস্টেমকে সেলিব্রেট করবে। এই লেখার জন্য যে তালিমটা প্রয়োজন, সেটার অভাব রয়েছে। এছাড়া একটি ভাল চিত্রনাট্য লিখতে গেলে লোকেশনে গিয়ে লেখকের একটু থাকা প্রয়োজন। এখানকার বেশিরভাগ প্রযোজকই সেটা বোঝেন না। তাই লেখকদের লালনও হয় না'', বলেন 'বিবাহ অভিযান' ও 'ভিলেন' ছবির সহ-চিত্রনাট্যকার অর্কদীপ নাথ।

bengali films web series Bengali Television
Advertisment