বাংলা থিয়েটার এবং নাট্যমঞ্চ নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল শোরগোল। এমন একজন মানুষ যার বিরুদ্ধে নারী শ্লীলতাহানি, ধর্ষনের মত কদর্য অভিযোগ রয়েছে, তাঁকে সুমন মুখোপাধ্যায়, যিনি কিনা নাট্য ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম, তাঁকে মঞ্চে দাঁড়াতে দিলেন?
প্রতিবাদ করতে শুরু করলেন অনেকেই। তাঁর মধ্যে অন্যতম দামিনী বেনি বসু। অভিনেত্রী নিজের কথা বলতে পিছপা হলেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা কথা লিখলেন। সেদিন হলে উৎপল দত্তের 'টিনের তলোয়ার' নাটকের মঞ্চ উপস্থাপনার পর থেকেই নানা আলোচনা। বেনি বসু বহুদিন ধরে এই নিয়ে প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু, সুরাহা কিছুই হচ্ছে না। উল্টে টিনের তলোয়ারের পর, সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় যার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ, একাধিক মেয়েরা যার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ! তাঁকে নিয়ে এসে দাঁড় করালেন তিনি।
বেনি বসু আওয়াজ তুললেন। বললেন, "না, লড়াইটা শুধু সুদীপ্ত এবং লাল দাদার উদ্দেশ্যে না। লড়াইটা এই সিস্টেমের উদ্দেশ্যে যেখানে কিনা ক্ষমতা এবং নাম ভাঙিয়ে দিনের পর দিন মানুষের সঙ্গে হয়ে চলেছে অদেখা এক অত্যাচার।" অভিনেত্রী শুরু থেকে শেষ শুধু এটুকুই বলে গেলেন, "ওরা ভয় না পেলে চলবে না।" পাঁচজন বিখ্যাত মানুষের নামের আড়ালে কী যে ভয়ঙ্কর মানসিক অত্যাচার চলছে সেটাই যেন বিঁধছে বেণীর গায়ে। তাঁর লাল দাদার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করেছেন তিনি। যেগুলি বেশ যুক্তিযুক্ত।
একে তো, অভিনেত্রীর কন্ঠ রোধ করার চেষ্টা। "লালদা শিখিয়েছে অনেককিছু। তাঁকে প্রশ্ন করব না?" অভিনেত্রী আরও বলেন, "লাল দাদা জিনিয়াস। আমাদের পথপ্রদর্শক উনি। আমরা তাজ্জব তাই জিজ্ঞেস করছি। যেখানে আইনি জট এখনও কাটেনি। যেখানে, আর পাঁচটা মানুষজন সুদীপ্তকে দেখে স্তম্ভিত, সেখানে এটা কি করে হতে পারল? তাহলে আইন রাখার অর্থ কী? সুদীপ্তর ঘটনাটার সময় কিন্তু লাল দাদা স্টেটমেন্ট দিয়েছিল তাও বিশদে, সেখানে আমরা তো তাঁকে জিজ্ঞেস করবই। একধরনের লোকজন শুধু এটুকু বলার চেষ্টা করছে যে এইসব মেয়েদের কোনও কাজ নেই। এরা শুধুই ফেমিনিজমের নামে সমাজ বদলানোর চেষ্টা করে।"
এরপরই তিনি প্রসঙ্গ টানলেন তাঁর বাবার। অসিত বসুর কন্যা তিনি। তাই থিয়েটার এবং সিনে দুনিয়ার মানুষগুলোকে বেশ কাছে থেকেই দেখেছেন। কিন্তু, 'বাড়ির মেয়ে' শব্দটার প্রতি তাঁর বেশ আক্ষেপ। কারণ একটাই! লড়াই..প্রতিটা ছেলেমেয়ের স্বার্থের লড়াই। বাড়ির মেয়ে বলে তাঁকে কেউ ছুঁতে পারবেন না, তাঁকে আঘাত করতে পারবেন না একথা যেমন কিছুটা গ্রহণযোগ্য, তেমনই তিনি চান না, আর পাঁচটা সাধারণ নাট্য এবং থিয়েটারপ্রেমী ছেলেমেয়েরা দিনের পর দিন অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করুক। দামিনী আরও বলেন, "এতবছর ধরে তোমরা অন্যায় করে চলেছ, কিছু বলিনি। আমি বললেই অন্যদের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। আমায় ভাতে মারার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি নিজের মত করে, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি সব ক্ষমা করে দিয়েছি। মা সারদা হয়ে গিয়েছি। ওরা অন্যায় করে পার পেয়ে গিয়েছে। মাফ করে দিয়েছি। এবার ফিরে এসে এরা বুক বাজাচ্ছে। ঠাট্টা তামাশা করছে। এটাকে গুন্ডামি বলে। কাদের নিয়ে ঠাট্টা করছে না, যারা নিজেদের কাজে কৃতি। এটা কি লালদার থেকে আশা করা যায়?"
তিনি আরও যোগ করলেন, 'ছোটলোক' দেখে সুমন মুখোপাধ্যায় এর প্রতিক্রিয়ার কথা। অভিনেত্রী বললেন, "আমার সঙ্গে লালদাদার যা সম্পর্ক তাতে, এতটা ফরমাল হওয়ার ওর দরকার ছিল না। এটা কিন্তু এক ধরনের কন্ঠ প্রতিরোধ করা। মানে, এটার অর্থ এটাই...যে আমায় থামিয়ে দেওয়া। এভাবে বলা, যে তুমি না ছোট বাচ্চা মেয়ে! তোমার এসব বলা মানায়? তুমি ছোটর মত ছোট থাকবে। কিন্তু এই যে স্বতন্ত্র ভাষায় আমার এত প্রশংসা করল লাল দা, সেটা তো আমি ছোট থেকেই চাইতাম। তখন তো এসব করত না। পায়ে পায়ে ঘুরতাম। লাল দাদা বলবে ভাল হয়েছে। সেই মানুষটা যখন আমার প্রশংসা করল, তখন আমি তো ভালবেসেই বললাম। দাবি করলাম, যে এই পোস্টে তুমি সহমর্মিতার কথা বলছ, মানুষকে সহানুভূতির কথা বলছ... তাঁর অর্থ এসব তোমার মধ্যে কমেনি।"
অভিনেত্রীর কথায়, "মানুষের স্বার্থে তারা নাকি থিয়েটার করেন। লাল দাদা যে আজকে একজন অপরাধীকে স্টেজে দাঁড় করিয়ে দিলেন তাতে কতগুলো মানুষের মনে দুঃখ হল? কষ্ট হল। এভাবে তো আমরা কাউকে ট্রমা দিতে পারি না। তাহলে, আইনি প্রক্রিয়া এগুলোর অর্থ কী? আমি চুপ ছিলাম, এরম অনেকেই আছে যারা চুপ আছেন। তারা সকাল থেকে আমায় বাহবা দিচ্ছেন কিন্তু, কেউ মুখ খুলতে রাজি নয়। কারণ, তাঁদের মনে হয়েছে এইসব বিষয় খোলাখুলি আলোচনার বিষয় নয়। তাদের এও মনে হয়, যেটুকু সম্মান তারা নাটক করে, থিয়েটারের মাধ্যমে অর্জন করেছেন, সেটা ধুলোয় মিশিয়ে যাবে এসব নিয়ে প্রতিবাদ করলে। সবাই নিজের লড়াই লড়ছে। আমি কাউকে জোর করতে পারি না। ওরা বুঝতে পারছে না, যে এটা অন্যায়! ওদের স্ট্যান্ডার্ড একটা প্রটোকল আছে, ওরা খালি এসব উত্তর দেয়, "এটা কেন করলি না? এখন কেন বলছিস? এক হাতে তালি বাজে না! এদের চরিত্র নিয়ে বলার আছে। এসব তো ফেমনিজমের বিরুদ্ধে হয়েই আসছে।"
"আমি এটাই দেখাতে চাই, যে থিয়েটারের একটা বিরাট অন্ধকার দিক আছে। একটা স্টিরিওটাইপ বিষয় আছে যে এরা টলিউড, এরা বলিউড। আর সবথেকে বড় কথা হল মহিলাদের শরীর সমস্যার কারণ হতে পারে না। যতক্ষন না পর্যন্ত সেটা রাজনীতির পরিসরে ঢুকে পড়ে। পলিটিক্যাল কথাটার অর্থ খুব অন্যরকম। মেয়েদের ওরা কী মনে করে আমি জানি না। আমরা কি ওদের মুড়ি মেখে দেওয়া, ফাই ফরমাস খেটে দেওয়ার জন্য আছি? অভিনেত্রী একটাই আশঙ্কা করছেন, এভাবে যদি তাদের ক্ষমতা চলতেই থাকে তবে, একটা সময় আর কেউ বাঁচবেন না। ছেলে থেকে শিশু সকলের গায়ে হাত পড়ছে।"
থিয়েটার শরীরের জায়গা। অভিনেত্রী হাসতে হাসতেই বাস্তবতা তুলে ধরলেন। শেষ কিছু কথায় বললেন, "আমরা তো অভিনেতা। কাউকে ছুঁতে পারাটা বড় ব্যাপার না। আমরা যে অভিনয় করি সেটাতে সবাই আমাদের শরীরটা দেখে। সেখানে শরীরটা যদি আনসেফ হয়। কিন্তু, আমাদের তো শরীরটাই আসল। সেটা যদি আনসেফ থাকে তাহলে কী করে হবে? দীর্ঘদিন ধরে এটা চলে আসছে। কিন্তু, অনেকে এখন এটাও বলে তাহলে কি ক্ষমা করব না? কীসের ক্ষমা! যে মানুষটা এত এত মানুষের, মেয়েদের মনের রোগের কারণ, যে এত মানুষকে কষ্ট দিয়েছে তাঁকে কীসের ক্ষমা? দরকার নেই তো! আজকে আমার সঙ্গে যা যা হল, আমার কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা করা হল, এর মাধ্যমে আমায় এটাই দেখানো হল যে একজন সব পারে। আমার বক্তব্য ধ্বংস করতে পারে। তাহলে, আমার যদি এই হাল হয়? যাদের সঙ্গে কেউ নেই তাঁরা কী করবে? তাদের সঙ্গে কী করে এসেছে এরা?"
এদিকে, এতকিছুর পরেও সেদিন টিনের তলোয়ার নাটকের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অভিনেতা অমিতাভ ঘোষের কথায়, "আমায় দাদা অভিনয় করতে বলেন শুধু আমি সেটাই করি। আর সেদিন তো হলে কোনও সমস্যা হয়নি। বরং, হলে সকলে বেশ আনন্দ পেয়েছেন। কারণ, যাকে নিয়ে এত অভিযোগ সে তো এখন আর এই দলে অভিনয় করে না। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ করে। বাকি, সোশ্যাল মিডিয়ায় কে কী বলল সেটা নিয়ে আমি বলতে পারব না।"