সম্পর্কের অসুখ করলেও ‘কুছ পরোয়া নহি…!’ কারণ, প্রেক্ষাগৃহে চলে এসেছে 'টনিক'… তা আট থেকে আশির মন কতটা চাঙ্গা করতে পারল এই 'টনিক' (Tonic)? লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
'টনিক'… শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা টনিক-ই ভরসা… সিনেমার এই সংলাপ আমাদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। অসুখ করলেই আমরা ক্যাপসুল, সিরাপ, টনিকের দ্বারস্থ হই। আর এই ছবির গল্পের মূল চরিত্র মানে টনিক, সেও তাই। মৃতপ্রায় সম্পর্ককে চাঙ্গা করতে তার জুড়ি মেলা ভার! সিনেমার গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এখানেই নামের সার্থকতা। আবেগ, রোমাঞ্চ, ড্রামা-মেলোড্রামা কি নেই? আমাদের প্রত্যেকের সংসারের বাস্তব সমস্যার এক টুকরো দলিল তুলে ধরেছেন পরিচালক অভিজিৎ সেন। এই গল্প আমার-আপনার, আমাদের সবার। ব্যস্তজীবনে আমরা অনেকেই বৃদ্ধ মা-বাবাকে সময় দিতে পারি না। আবার কখনও বা তাঁর শরীর-স্বাস্থ্যের কথা খেয়াল রেখে একটু বেশি সাবধানী হই, কড়া শাসনে রাখি। কিন্তু এক ছাদের তলায় মানুষগুলোর সঙ্গে ডিনার টেবিলে রোজ দেখা হলেও কি কখনও জানতে চাই যে- ওঁরা কী চাইছেন? 'টনিক' সেই প্রশ্নই ছুঁড়ে দিল দর্শকদের সামনে।
এবার আসা যাক, দেব-পরাণ (Dev, Paran Bandopadhyay) জুটির কথায়। একজন তরুণ অভিনেতার সঙ্গে স্ক্রিনস্পেস শেয়ার করে এই বয়সেও যে তাঁকে প্রতিটা দৃশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া যায়, সেটা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই দেখিয়ে দিলেন। 'টনিক'-এর হাত ধরে শেষ বয়সে নিজের সব না-পাওয়া, চাহিদাগুলো মিটিয়ে নেন জলধর (পরাণ)। অবসরপ্রাপ্ত এই ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি বুড়োটি তাঁর সংলাপের মধ্য দিয়েই যেন আমাদের চারপাশে কত-শত বৃদ্ধ, পরিবারের অবহেলায় পড়ে থাকা বাবার কথা বলে উঠলেন- "বাড়িতে বউয়ের ছ্যাঁকা, ছেলের বকা, পেটের অম্বল আর রাতের কম্বলে"-ই যাঁর জীবন সীমাবদ্ধ। এই ছবি যেন বারবার কাতর আর্তি জানায়- বৃদ্ধ বাবা-মাকে সংসারের এককোণায় ফেলে রাখবেন না। যত্ন নিন। যে মানুষগুলো বুকে আগলে বড় করেছে, হাত ধরে চলতে শিখিয়েছে, ওঁরা ভাল আছে কিনা জানতে চান। যে ভূমিকায় পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্ধষ বললেও কম বলা হয়। আশি বছর বয়সেও যে সুপারস্টার যুবকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করা যায়, বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে শেখালেন তিনি।
রিভার ব়্যাফ্টিং কিংবা রক ক্লাইম্বিং, প্যারাগ্লাইডিংয়ের মতো দৃশ্যেও পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিব্যক্তি, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অসাধারণ। তবে 'টনিক' দেবও কম যান না। প্রত্যেকটা ছবির জন্য নিজেকে যেভাবে ভাঙাচোড়া করেন তিনি, সেই কসরতকে বাহবা দিতেই হয়। 'গোলোন্দাজ'-এ নিজের জাত চিনিয়েছেন দেব। আর 'টনিক'-এ আবারও 'সাঁঝবাতি'র কথা মনে করালেন অভিনেতা। বৃদ্ধ দম্পতির স্বপ্নপূরণ করতে, তাদের ভগ্নপ্রায় পরিবারকে জোড়া লাগাতে 'টনিক'-ই মুশকিল আসান। তার সঙ্গে অবশ্য টনিকের ব্যক্তিগত জীবনের অতীতের সম্পর্কও রয়েছে। কী? এই চমকটা দর্শক না হয় সিনেমাহলে গিয়েই দেখুন।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য সিনেমার সংলাপ। গল্পের পরতে-পরতে কমিক এলিমেন্ট জুড়ে দেওয়ার জন্য 'টনিক'-এর সংলাপ লেখক শুভদীপ দাসকে অতিরিক্ত নম্বর দিতেই হয়। কথার ভাঁজে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কিংবা গেরুয়া শিবিরের হয়ে মিঠুনের জনসভাকেও পারদর্শীতার সঙ্গে বিঁধেছেন তৃণমূল সাংসদ-অভিনেতার ছবিতে। রাজা নারায়ণ দেবের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর আর জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মিউজিক সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দর্শক-মনকে ফুরফুরে করে তুলবে।
তবে বেশ কিছু দৃশ্যে এত বিজ্ঞাপনী প্রচার কিংবা ব্র্যান্ড পশিসনিং, তা খানিক দৃষ্টিকটু ঠেকে। স্ত্রীয়ের পাসপোর্ট তৈরি না হওয়ায় রাগের চোটে টনিক দেবকে জলধর পরাণের ছাতা-পেটা করার সিকোয়েন্স বড্ড বেশিই চোখে লাগে। পাশাপাশি, তনুশ্রী চক্রবর্তী স্ক্রিনে এসেই হঠাৎ করে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন। পারিবারিক 'ভিলেন' ছেলে-বউমার ভূমিকায় সুজন-কনীনিকার চরিত্রে আরেকটি গভীরতা আনতে পারতেন পরিচালক। ঠিক খলনায়ক হিসেবে দুই চরিত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে আরেকটু জোড় দিতে পারতেন। তবে সবকিছুর বাইরে এই সিনেমার গল্পই ফিল গুড ফ্যাক্টর। মন চাঙ্গা করতে সত্যিই 'টনিক'।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন