মুক্তি পাওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই বক্সঅফিসে শোরগোল ফেলে দিয়েছে 'বল্লভপুরের রূপকথা'। পরিচালক হিসেবে বড়পর্দায় প্রথম ছবি। কী বলছেন পরিচালক-অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য? 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা'র তরফে শুনলেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
'বল্লভপুরের রূপকথা' দারুণ পছন্দ হয়েছে দর্শকদের। বাড়ির সকলে কী প্রতিক্রিয়া দিলেন?
বাড়ির সকলের ভালই লেগেছে। মধুরিমাও উপভোগ করেছে। আবার 'বল্লভপুরের রূপকথা' নিয়ে অনেকেরই কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। কোনও অংশ নিয়ে আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগত মতামতও দিয়েছেন। ফলে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটা সকলেরই ভাল লাগার।
'মন্দার' দেখার পর আপনার কাছ থেকে দর্শকের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গিয়েছে। 'বল্লভপুর..' কী সেটা পূরণ করতে পারল?
আমার মতে, প্রত্যাশার তো কোনও প্যারামিটার নেই। ৭-এর মধ্যে ৪ নম্বর হয়তো দিতে পারলাম! বিষয়টাকে এভাবে দেখি না। দুটো দু রকমের বিষয়। এবং দুটো প্রজেক্টই দু ধরনের প্ল্যাটফর্মে বেড়িয়েছে। একটা বড় পর্দার ছবি। আরেকটা ওটিটি। হ্যাঁ, যেহেতু মন্দার দেখে সকলে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন, তার ফলে যে একটা অতিরিক্ত প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে দর্শকদের, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা যেহেতু গল্পগত দিক থেকে, মাধ্যমগত দিক থেকে সরে এসেছি, মানে ওটিটি থেকে বড়পর্দার জন্য সিনেমা তৈরি করেছি। বিষয়গত মাপকাঠি থেকে বল্লভপুরকে মন্দার-এর মাপকাঠি থেকে বিচার করা যাবে না। মানে সিনেমা হিসেবে বল্লভপুর মৌলিকভাবে বিচার করার বিষয়। সেটা দেখে মানুষ আনন্দ পাচ্ছেন, ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, এটাই বড় প্রাপ্তি।
নাটককে সিনেমায় রূপারন্তরিত করতে গিয়ে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে?
নাটকের চিত্রনাট্য তো মঞ্চের কথা ভেবে লেখা হয়, আর সিনেমার ক্ষেত্রে সেটা অন্যরকম। আমি বা প্রতীক, আমাদের কারোর-ই সিনেমার স্ক্রিন-প্লে লেখার প্রথাগত কোনও প্রশিক্ষণ তো নেই। সেক্ষেত্রে নাটকের চিত্রনাট্যকে সিনেমার মতো সাজানো নিঃসন্দেহে কঠিন। সেটা খানিকটা চ্য়ালেঞ্জিং ছিল বটেই। তবে সময় নিয়েছিলাম ৬-৭ মাস খসড়া প্রস্তুত করতে। তারপর চূড়ান্ত চিত্রনাট্যটা দাঁড়িয়েছে।
'মন্দার' এবং 'বল্লভপুর' করতে গিয়ে কতগুলো স্ক্রিপ্টের ড্রাফট তৈরি করেছিলেন?
'মন্দার'-এর চারটে। 'বল্লভপুরের রূপকথা'র জন্য পাঁচটা ড্রাফট তৈরি করেছি।
সিনেমার থেকে নাটক কী কোথাও এগিয়ে বলে মনে হয়?
আমি যদি রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর কথা ধরি, তাহলে বাংলার নাটক চিরকারলই বাংলা সিনেমার থেকে এগিয়ে রয়েছে। নাটক অনেক সাহসি কিংবা গম্ভীর ইস্যু নিয়ে কথা বলতে পারে। তাছাড়া, নাটকের একটা সুবিধে-অসুবিধে হচ্ছে সেটা সিনেমার মতো অত কমার্শিয়াল আর্ট ফর্ম নয়। ছবি তৈরির ক্ষেত্রে অর্থটা ভীষণ ম্যাটার করে। সিনেমা হচ্ছে মানি ওরিয়েন্টেড একটা ব্যবসা। অন্তত আজকের দিনে। ফলত স্বাভাবিকভাবেই সিনেমা অনেক কিছু বলতে পারে না। থিয়েটার তবুও অনেকগুলো জোনে পাওয়ারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। পলিটিক্যাল হতে পারে। সিনেমায় সেটা সম্ভব নয়।
অভিনয়, স্ক্রিপ্ট, গান, পরিচালনা.. একসঙ্গে এতকিছু সামলান কীভাবে?
হ্যাঁ অনেকরকমের স্ট্রিমে কাজ করেছি সেটা ঠিক। একসঙ্গে করি না (হেসে)। যখন পরিচালনার কাজে ব্যস্ত থাকি তখন অভিনয় করি না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু 'মন্দার'। সেখানে পরিচালনার পাশাপাশি একটা চরিত্রে অভিনয় করেছি। আর গান লেখালেখি মূলত বাড়িতে বসেই হয়। সেটা আলাদা একটা কাজ। একসময়ে একটাই কাজ করি। যখন যেটা করি, তখন সেটাতেই মনোনিবেশ করি।
এগুলোর মধ্যে কোনটা সবথেকে বেশি উপভোগ করেন?
অভিনয়। অভিনয়টাকে সবথেকে বেশি উপভোগ করি।
যেখানে দর্শকদের পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে এতটা পছন্দ, সেখানে আগামী ২ বছর আর ছবি পরিচালনা করবেন না বলেছেন। এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?
আমার ব্যক্তিগত ভাল লাগার মূল্যটাও তো আমাকেই দিতে হবে! (হেসে) আমার অভিনয় করতে ভাল লাগে। আসলে বিষয়টা হচ্ছে, মন্দার কিংবা বল্লভপুর করতে গিয়ে দেখলাম প্রত্যেকটা প্রজেক্টের পিছনে এক বছর করে লাগল। মানে দুটো কাজ ২ বছর সময় নিল। এবার প্রতিবছর যদি একটা করে পরিচালনার কাজ করি, তাহলে তো অভিনয়টাই করা হবে না। আর আগামী ২ বছর চোখের পলকে বেরিয়ে যাবে। তাই এই সময়টা পরিচালনার কাজ না করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই ২ বছর শুধু থিয়েটার, সিনেমায় ফোকাস করতে চাই। পরে আবার পরিচালনা করব।
অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য যখন পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন, অনেকেই কি একটা থ্রেট হিসেবে ভেবেছেন?
এগুলো নিয়ে ভাবিই না। সিনেমা যেমন একটা আর্ট ফর্ম, তেমন একইসঙ্গে একটা ব্যবসাও বটে! সেখানে নিরাপত্তা কিংবা নিরাপত্তাহীনতা তো থাকবেই। এসব হিসেবপত্তর আছেই..! তবে আমি বোকা সাজারও চেষ্টা করছি না যে আমি কিছুই জানি না। কিন্তু সেই বিষয়গুলোয় আমার একেবারেই উৎসাহ নেই। সিনে-ময়দানে ব্যবসায়িক রাজনীতি নিজের মতো চলবেই, সিকিওরিটি-ইনসিকিওরিটি যার যার নিজের মতো চলবে। ওগুলো করতে আমি আসিনি। আমি যতটুকু কাজ পারি আমার সীমার মধ্যে যা সামর্থ্য, আমার যেটা করতে ভাল লাগে, আমি সেটাই করছি। সৎ সাহস নিয়ে নিজের কাজটা করতে পছন্দ করি।
এগুলো সিনে-ব্যবসার একটা অঙ্গ। আর এগুলোকে অন্যায়, অস্বাভাবিক বলে মনে করি না। তবে এসবে মন না দিয়ে কাজে ফোকাস করাটাই শ্রেয় বলে মনে হয় আমার। কাজ খারাপ বা ভাল হতেই পারে কিন্তু কতটা সততা, গভীরতার সঙ্গে কাজ করছি, তাতে যাতে ভাঁটা না পড়ে, সেই চেষ্টাটা আমি চালিয়ে যাব। আমি কাউকে থ্রেট করতে আসিনি। বা কোনও ভাল কাজ কাউকে থ্রেট করতে পারে বলে আমি মনে করি না।
আঞ্চলিক সিনেমার নীরিখে যদি দেখি তাহলে বাংলা সিনেমা বাণিজ্যিকভাবে অনেকটাই পিছিয়ে। এক্ষেত্রে কী বাজেটের সমস্যা বলে মনে হয় না খিদের অভাব?
আমাদের বাজার খুব ছোট। কান্তারা বলে যে দক্ষিণী সিনেমাটা রিলিজ হওয়ার পর এত কথা হচ্ছে, সকলেই বলছেন সেটা অত্যন্ত কম বাজেটের একটা ছবি। সেই কম বাজেটটাও হচ্ছে ১৬ কোটি টাকা। আর বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে অ্যাভারেজ বাজেটই হচ্ছে এক থেকে দেড় কোটি। আমাদের ইনভেস্টমেন্ট কম। তাই বাংলা সিনেমাকে বাংলা সিনেমা বাজারের হিসেবে বুঝতে হবে। তুলনা করে চলতে হলে আমরা ফেঁসে যাব! বাংলা সিনেমার একজন কর্মী হিসেবে বলতে পারি, ওটা আমাদের ফোকাস না হওয়ায় ভাল। বাজার যত বড় হবে, বাজেট তত বেশি হবে।
'বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান..', এপ্রসঙ্গে তো বহু হইচই হয়েছে, আপনার কী মতামত?
এসব হুজুক! বাংলা সিনেমা যার দেখতে ইচ্ছে করবে, তিনি দেখবেন। দর্শকরা বোকা নন। কে কোন ভাষায় সিনেমা দেখবেন, সেই স্বাধীনতা রয়েছে সম্পূর্ণরূপে দর্শকের ওপর। ওরকমভাবে পাশে দাঁড়ান বললেই, পাশে দাঁড়ানো যায় না।
কোনও সিনেমা, চিত্রনাট্য নিয়ে আলোচনা করতে হলে ইন্ডাস্ট্রির কোন বন্ধুকে ফোন করবেন?
ইন্ডাস্ট্রিতে আমার খুব বেশি বন্ধু নেই। তবে সিনেমা বা কোনও চিত্রনাট্য নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমি অবশ্যই সেটা প্রতীকের সঙ্গে করি। কারণ আমরা দু'জন একসঙ্গে লিখি।