ঢাকে কাঠি পড়তে আর মাত্র দিন কয়েকের অপেক্ষা। সময় যতই পাল্টাক, আধুনীকিকরণের ছোঁয়ায় পুরনোকে আঁকড়ে ধরতে চাই আমরা। শিউলি, ছাতিমের গন্ধ.. নতুন জামা, পাটভাঙা শাড়ি, অলি-গলিতে আলোর রোশনাই, জমজমাট মজলিশ। পুজোর কলেবর এখন বদলেছে। এসেছ থিমের চমক। বেশভূষা নিয়েও এখন তটস্থ নবীন প্রজন্ম। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। কোথায় যেন হারিয়ে গেল শিউলি-ছাতিমের গন্ধ, হেঁশেল থেকে ভেসে আসা রকমারি রান্নার সুবাসে ম-ম করা গোটা বাড়ি। চাইনিজ আর কন্টিনেন্টাল-ই এখন 'উদর-বাসা' পায়। প্যান্ডেলের বাদ্যি আর মা-কাকিমা কিংবা জেঠিমুনি, রাঙা পিসি, সেজো মাসিদের সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডাটাও নেই। ব্যস্তজীবনে সেই ফেলে আসা মুহূর্তগুলো যেন আরও বেশি করে মনে পড়ে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার জন্য তেমনই এক নস্ট্যালজিক মুহূর্ত তুলে ধরলেন ডিজাইনার পরমা ঘোষ। সঙ্গী নব্বই দশকের হিট নায়িকা- রিনা-চুমকি।
পরমা বলছেন, "বাড়ির মহিলারা সবাই কিন্তু পুজোর সময়ে ঠাকুর দেখতে বের হন না। আর পুজো মানেই শুধু ৫ দিন নয়। মা চলে যাওয়ার পরও আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব অনেকেরই আনাগোনা লেগে থাকে বাড়িতে। সেই আমেজ থাকে লক্ষ্মীপুজো অবধি। অতঃপর মা-মাসিমা কিংবা পিসিমাদের ব্যস্ততা সেই সময়েও চলে। ঘরদোর গুছিয়ে কখনও নাড়ু, নিমকি বানানো আবার কখনও বা অতিথি আপ্যায়ণ। কালের নিয়মে আমরা অনেকেই ব্যস্তজীবনে দুর্গাপুজোর সেই আমেজটা ভুলতে বসেছি। তবে আধুনিকীকরণের প্রলেপ যতই লাগুক, বাড়ির বড়রা কিন্তু বিজয়া দশমীর সেই আমেজটা এখন খুব মিস করেন। চুমকি চৌধুরি, রিনা চৌধুরিদের নিয়ে সেই নস্ট্যালজিয়াটা ধরারই চেষ্টা করেছি।"
নতুন শাড়ি, আলমারি থেকে বের করা হালকা কিছু গয়নাতেও তাঁরা ঠিক ততটাই স্নিগ্ধ, মোহময়ী। কখনও পাড়ার প্যান্ডেলে দেবীবরণ, আবার কখনও বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ণে ব্যস্ত থাকেন তাঁরা।
নব্বইয়ের দশকের প্রজন্মের হয়তো পুজো রিলিজ নিয়ে মাতামাতি ছিল না। তবে টিপ, হালকা লিপস্টিক আর পাটভাঙা শাড়ি, কাঁধ বেয়ে পড়া ভেজা চুলের নায়িকাদের নিয়ে উন্মদনা থাকত বরাবর। কখনও পুজো ম্যাগাজিনের কভারে আবার কখনও বা বড় রাস্তার মোড়ের হোর্ডিংয়ে তারকাদের সাজ দেখে ভিড় জমত দর্জির দোকানে। সেইসময়কার সিনেমা, গল্পেই রিনা-চুমকিরা তুলে ধরতেন আমাদের ঘরের মহিলাদের প্রতিচ্ছ্ববি।
ডিজাইনার পরমা ঘোষ সেই নস্ট্যালজিক প্রতিচ্ছ্ববি তুলে ধরে বললেন, "অঞ্জন চৌধুরির সিনেমা দেখেই বড় হয়েছে নব্বইয়ের প্রজন্ম। অনেকের কাছেই সেটা আজও 'বাংলা বই'। সেইসময়ে রিনা চৌধুরি এবং চুমকি চৌধুরিকে নিয়ে কী মারাত্মক উন্মাদনা। আমার পিসি বম্বে থেকে এলেও সবাই মিলে বসে সেই সিনেমা দেখতাম। বর্তমানের তথাকথিত গ্ল্যামার জগৎ কিংবা ওই সৌন্দর্যের সেরকম মাপকাঠি ছিল না। ওঁরা নিজেদের মতো করে ট্রেন্ড সেট করেছিলেন। সাদামাটা, ঘরোয়া সেই বিষয়টার সঙ্গে দর্শকরা দারুণভাবে একাত্মবোধ করতে পারতেন। আজও পারেন।"
বাড়ির ছোটরা যখন পাল্লা দিয়ে প্যান্ডেল হপিংয়ে ব্যস্ত, তখন অবসরে পাড়ার মণ্ডপে ঢাকের বাদ্যির ভেসে আসা সুরে পুজো ম্যাগাজিন কিংবা শারদ সংখ্যা পড়ার রেওয়াজ আজও রয়েছে আমাদের মধ্যে। কিন্তু নবীন প্রজন্ম খুব কমই পুজোবার্ষিকীর পাতা ওল্টায়। বাড়ির খুদে সদস্যের সঙ্গে খুনসুঁটি কিংবা বড়দের হাতে হাতে কাজ সেরে আড্ডা জমানোর দিনগুলো আজকের ব্যস্তজীবনে শুধুই স্মৃতি। কারণ, পুজোতেও এখন গোটা দিন চারেকের ছুটি পাওয়া যায় না।
"সিনেমার লার্জার দ্যন লাইফ হিরো-হিরোইন নয়, বরং সংসারের গৃহকর্ত্রী বা কলে যাওয়া চাকুরিরত, পাড়ার দাদা কিংবা ঘরোয়া প্রেমিকাদেরকেই নায়ক-নায়িকা হিসেবে তুলে ধরা হত আট-নয়ের দশকের ছবিগুলোতে। তাই বোধহয় আজও অঞ্জন চৌধুরির 'মেজো বউ' কিংবা 'ছোট বউ' সিনেমাগুলো দর্শকদের মনে এতটা গেঁথে রয়েছে", রিনা-চুমকিদের সাজাতে গিয়ে বলছিলেন পরমা।
হাতে বানানো নাড়ু, মুড়কি নয়, পাড়ার কেকের দোকান থেকে কেক-পেস্ট্রি কিংবা স্যান্ডুইচ এনেই বিজয়া সারা হয়। কারণ নবীন প্রজন্মের অনেকেরই স্বাদকোরক অভ্যস্ত এসব খাবারে। বাড়ির মহিলা মহলের ঝক্কি কমে বটে, তবে কেনা খাবারে সেই ভালবাসা, মায়ার টান আর কই? এবার পুজোয় ফিরিয়ে আনবেন নাকি সেই নস্ট্যালজিয়া? কারণ যা কিছু পুরনো, তার অনেকটাই আজও চিরন্তন। ঠিক যেমন থিম পুজোর ভিড়ে সাবকি সার্বজনীন পুজোগুলো আজও মাথা উঁচু করে গর্বের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে।
মুখ- চুমকি চৌধুরি, রিনা চৌধুরি
পোশাক - পরমা ঘোষ
মেকাপ- চয়ন রায়, হেয়ার স্টাইলিং- বিথি রায়
লোকেশন- ব্যারিস্টারবাবুর বাড়ি (৯২, কবি সুকান্ত সরণী, বেলেঘাটা)
ফুড পার্টনার- ট্রিঙ্কাস