স্টুডিওপাড়া, বাংলা ছবি, ছোটবেলার চেনা পাড়া সবকিছুকেই পিছনে ফেলে সেই আশির দশকের শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছিলেন আলপনা গোস্বামী। তখন অবশ্য তিনি আলপনা বসু হয়েছেন। তার পরের কয়েক দশক রুপোলি পর্দার প্রাক্তন নায়িকা মনপ্রাণ দিয়ে শুধুই সংসার করেছেন। মাঝখানে ৩০ বছর কেটে গিয়েছে। নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে বাংলা ছবির জগতও। লকডাউনে স্তব্ধ ফ্লোরিডায় বসে সেকাল-একাল কিছু নিয়ে কথা বললেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র সঙ্গে।
অভিনয়ে এসেছিলেন সত্তর দশকের শেষে। তাঁর মেন্টর ছিলেন উত্তমকুমার ও সুপ্রিয়া দেবী। ১৯৭৯ সালের ছবি 'কৃষ্ণ সুদামা'-তে প্রথম নায়িকার চরিত্র পেয়েছিলেন। এর পরের কয়েক বছরে অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন টালিগঞ্জের সবচেয়ে ব্যস্ত অভিনেত্রীদের একজন। সম্প্রতি পরিচালক প্রবীর রায় ঘোষণা করেছেন যে রয়জ এন্টারটেইনমেন্ট প্রযোজিত একটি ছবিতে অভিনয় করবেন আলপনা বসু। সেটাই হবে প্রায় তিন দশক পরে তাঁর কামব্যাক। যদিও লকডাউনে অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গিয়েছে ছবির কাজ।
আরও পড়ুন: ৭টি ক্লাসিক বাংলা ধারাবাহিক! আবার দেখা গেলে মন্দ হয় না
আপনার পর্দার অভিনয়ের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল, সেটা যদি একটু বলেন।
আমার প্রথম অভিনয় থিয়েটারে। রামমোহন মঞ্চে আমার প্রথম অভিনয়। তার পরে আমি 'বিশ্বরূপা'-তেও কাজ করি। বেণুদিই (সুপ্রিয়া দেবী) আমাকে প্রথম মুভিতে আনেন। বেণুদির মেকআপ আর্টিস্ট ছিলেন বশির আহমেদ। তাঁকে দিয়েই আমায় স্টুডিওতে পাঠিয়েছিলেন উত্তমকুমারের কাছে। তখন 'ধনরাজ তামাং'-এর শুটিং চলছিল। সেই প্রথম স্টুডিওতে যাওয়া। প্রথম ক্যামেরার সামনে এসেছিলাম 'সূর্যতৃষ্ণা' ছবিতে। আমার দ্বিতীয় ছবি ছিল 'রবিবার'। তার পরে আস্তে আস্তে আরও বড় চরিত্র এল। নায়িকার ভূমিকায় প্রথম এলাম 'কৃষ্ণ সুদামা' ছবিতে। অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ডিরেক্টর। সেটা ১৯৭৯ সাল। আমি রাধার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। খুব হিট ছিল ছবিটা।
সেই সময়ে বাংলা ছবির জগৎটা কেমন ছিল, আপনি যেভাবে দেখেছেন।
যখন আমরা অভিনয় করছিলাম, তখনও তো উত্তমদা বেঁচে। যদিও খুব বেশিদিন পাইনি। উত্তমদার মারা যাওয়াটা ছিল বিগ লস। তার পরে যেটা দেখেছি, স্টুডিওতে কাজের কোয়ালিটি পড়ে গিয়েছিল। প্রোডিউসাররা ছবি করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই সময়টা সবাই অদ্ভুত একটা ইনসিকিউরিটির মধ্যে চলছিল। কী হবে না হবে, সারাক্ষণ এই সব ভাবনা থাকত। তার পরে অঞ্জন চৌধুরী এসে 'শত্রু' করলেন। ছবিটা দারুণ হিট হল। ওই সময়ে কিন্তু অঞ্জনদা আবার ইন্ডাস্ট্রির হাল ধরেছিলেন। আবার নতুন করে সব কাজ শুরু হল। আমিও অঞ্জনদার অনেক ছবিতে কাজ করেছি।
'বৈদূর্য্য রহস্য' ছবিতে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে যদি কিছু বলেন।
ওই ছবিটা ৮৬-তে রিলিজ করেছিল। অভিজ্ঞতা তো দারুণ ছিল। আমাকে আর মুনমুনকে রিহার্সাল দিতে হতো। শুটিং শুরু হওয়ার আগে আমরা একসঙ্গে অনেক দিন রিহার্সাল দিয়েছি। তপনদা খুব পারফেকশনিস্ট ছিলেন তো। কোথাও কিছু খামতি যাতে না থাকে তার জন্য রিহার্সাল করে তৈরি করে নিতেন। আর শুটিংয়ের সময় তো দারুণ কেটেছে। আমরা বোধহয় ভাগলপুরে শুটিং করতে গিয়েছিলাম। ওখানে কয়েক উইক ছিলাম। আর মুনমুন তো আমার খুব বন্ধু তখন থেকেই, এখনও আছে। দুজনে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা, খুব মজা করে কেটেছে। ছবিটা রিলিজ করার পরেই আমি ইউএসএ চলে আসি। কয়েকটা ছবির কাজ তখন কমপ্লিট করে দিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো তার পরে রিলিজ করেছে।
আরও পড়ুন, বড় ধাক্কা বাংলা টেলিজগতে, বন্ধ হতে পারে চারটি ধারাবাহিক
একেবারে একটা অন্য রকম জীবনে তো চলে এলেন তার পরে। মিস করতেন কি স্টুডিওপাড়া?
প্রথম কয়েকদিন তো সবকিছুর জন্যই মন কেমন করেছে। মাই কেরিয়ার, মাই ফ্যামিলি, বাট ইউ নো ইউ গেট ইউজড টু ইট। কাজের একটা জায়গা তো তৈরি হয়েছিল। যারা কাজ ভালবাসে তারা কাজের জায়গা থেকে চলে এলে মিস করবেই। তবে চলে এলেও আমার সঙ্গে কিন্তু কলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির যোগাযোগটা ছিল। এতদিন কাজ করেছি, এত মানুষ ছিল ওখানে যাদের সঙ্গে এত বন্ধুত্ব ছিল। মুনমুন, দেবশ্রী, মিঠু, শকুন্তলা বড়ুয়া-- ওদের সবার সঙ্গে এখনও আমার খুব ভাল যোগাযোগ। আমি যতবার গেছি, ওরা এসে দেখা করেছে। আবার আমার বাড়িতেও এসে থেকেছে অনেকে। বেণুদি, মাধবীদি, ললিতা, সাবিত্রীদি-- সবাই এসেছে। লাস্ট ইয়ার যখন কলকাতায় গেলাম, সোমার বাড়িতে বেণুদির বাৎসরিক ছিল। অনেকের সঙ্গে দেখা হল। আবার অনেকে তো চলেও গেল। তাপস, সন্তু, চিনুদা...
রানি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আপনার একটা ছবি দেখলাম
ওহ... রানি তো আমার মেয়ের মতো। ওকে ছোটবেলা থেকেই দেখছি। ওর মা আর আমি বেস্ট ফ্রেন্ডস। ওরা এখনও ইউএসএ-তে এসে আমার বাড়িতে থাকে। আবার আমি যখন যাই, ওদের বাড়িতে গিয়ে থাকি।
আপনি তো প্রায় নিয়মিত এসেছেন এদেশে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাওয়ার পরে আবার কাজ করার কথা ভাবেননি কখনও?
আসলে সেই সময়ে আর ইচ্ছে করত না। শুধু তো ছেলেমেয়েদের বড় করা নয়, অনেক কিছু সংসারের দায়িত্ব ছিল। আর সেই সময় বছরে খালি একবার যেতাম, মাসখানেকের জন্য। তখন আর কাজ করতে ইচ্ছে করত না। আমি এখানে চলে আসার পরে কিছু কিছু কাজের প্রস্তাব যে আসেনি একেবারে তা নয়। কিন্তু তখন কলকাতায় গেলে মনে হতো, একটু আড্ডা দিই, সবার সঙ্গে দেখা করি। আর সব সময় সবাই জানতেও পারত না আমি কখন আসছি, চলে যাচ্ছি। লাস্ট ইয়ার ওই সোমার বাড়িতেই প্রবীরের সঙ্গে দেখা হল। প্রবীর আমাকে স্ক্রিপ্টটা পাঠিয়েছিল। ওখানে আমার যে চরিত্রটা, সেটা বেশ ভাল লাগল, গল্পটাও বেশ ভাল। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতিতে আছি আমরা সবাই... হোপফুলি সব ঠিক হয়ে যাবে।
এখনকার বাংলা ছবিগুলো কি দেখেন?
তা দেখি। এই যেমন বুম্বার ছবি 'জ্যেষ্ঠপুত্র' দেখলাম। আর কোয়েলের একটা ছবি দেখতে বলল আমার এক বন্ধু-- 'ছায়া ও ছবি'। আমি যখন কাজ করেছি, কোয়েল তো বেবি ছিল, আমার কোলে বসত। রঞ্জিতদা আমার অনেক ছবিতে হিরো ছিলেন। দীপা বউদি কোয়েলকে নিয়ে আসতেন মাঝে মাঝে। ও তখন খুবই ছোট। ওর বেবি হয়েছে, খবরটা পেয়ে খুব ভাল লাগল। দুজনের জন্য অনেক ভালবাসা।
এই সময়ের অন্য পরিচালকরা যদি ডাকেন, আপনি কাজ করবেন?
নিশ্চয়ই। যদি ছবিটা ভাল হয়, আমার রোলটা ভাল থাকে, নিশ্চয়ই করব। নন্দিতা-শিবপ্রসাদের ছবি যেমন আমার খুব ভাল লাগে।
আপনার অভিনেত্রী হিসেবে কি কোনও আক্ষেপ রয়েছে?
এটা বোধহয় আমি অনেকদিন আগে একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলাম। আমি যে সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে আসি, তখন সব মেয়েই উত্তমকুমার বলতে পাগল। আমার বড় আপশোষ হয় যে আমি ওঁর বিপরীতে নায়িকার চরিত্র পাইনি। দাদার চরিত্রে, বাবার চরিত্রে পেয়েছি উত্তমকুমারকে কিন্তু ওঁর নায়িকা হওয়া আর হল না। আর একটা আপশোষ ছিল, যে সময় ছবি বিশ্বাস অভিনয় করতেন, সেই সময়ে আমি কেন এলাম না! ওনার মতো ব্যক্তিত্ব আর ওই গড গিফ্টেড অভিনয়ের ক্ষমতা... ওনার সাহচর্যটা মিস করেছি খুব, প্রায় এক যুগ পরে কাজে এসে। আর একটা কথা তো বলতেই হবে। ওই সময় যত অভিনেত্রী ছিল, সবার স্বপ্ন ছিল সত্যজিৎ রায়ের ছবির নায়িকা হওয়ার। আমরা যতজন নায়িকা ছিলাম, সবাই মনে মনে চাইতাম। মানিকদার ছবিতে কাজ করা, এটা একটা খুব বড় অপূর্ণ ইচ্ছে বলতে পার।
আপনার এখনকার জীবন নিয়ে কিছু বলুন।
আমার দুই মেয়ে, এক ছেলে। দুই মেয়ের একজন থাকে নিউ ইয়র্কে আর একজন ভিয়েনাতে। আর ছেলে এখন ম্যানেজমেন্ট পড়ছে। আমি এখন ফ্লোরিডাতে থাকি বেশ কয়েক বছর হল। তার আগে নিউ ইয়র্কেই থাকতাম। আমার নাতিও আছে, সে ভিয়েনায় রয়েছে এখন। আমার তো যাওয়ার কথা ছিল ইউরোপ ৩১ মার্চ। কিন্তু সবই বন্ধ হয়ে গেল। ভিডিও চ্যাটে কথা হচ্ছে এখন মেয়েদের সঙ্গে। এই আর কী।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন