Actress and acting coach Swagata Mukherjee: প্রায় তিন দশকের অভিনয় জীবন স্বাগতা মুখোপাধ্যায়ের। টেলিপর্দায় দর্শক তাঁকে দেখেছেন একের পর এক লার্জার দ্যান লাইফ খল-চরিত্রে। পর্দার ইমেজ সরিয়ে অভিনেত্রী, শিল্পী এবং অভিনয়-প্রশিক্ষক স্বাগতা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা--
এই যে তুমি টেলিপর্দার সেরা খলনায়িকাদের একজন, এবছর টেলি অ্যাকাডেমি পুরস্কারও পেলে, তোমার কোথাও মনে হয় না যে টেলিভিশন তোমাকে টাইপকাস্ট করে ফেলেছে?
একেবারেই সেটা মনে হয় না। অভিনয়টা তো ভীষণ বড় জায়গা, এক এক ধরনের চরিত্র তার এক একটা অংশ কভার করে। যদি কেউ মনে করেন যে এই মানুষটি নেগেটিভ ভালো করবে, তাহলে সেটা তো ভালো। বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে নিজের অভিনয়ক্ষমতাকে এক্সপ্লোর করা যায়, সেটা যেমন ঠিক, পাশাপাশি এটাও ভাবো, যদি একজনকে বার বার নেগেটিভ চরিত্র করতে হয়, তাহলে সেটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ যে প্রত্যেকটা চরিত্রকেই সে কীভাবে স্বতন্ত্র করে তুলবে। একজন নানা রকম পদ রান্না করেন, আর একজন শুধু পনিরই রান্না করেন। দ্বিতীয়জনকে অনেক বেশি ইনোভেটিভ হতে হয় যে কত রকম ভাবে পনির রান্না করা যায়। তাহলে কার কাজটা বেশি কঠিন বলো? আর আমার অন্য চরিত্রে অভিনয়ের খিদেটা মিটে যায় থিয়েটারে।
তুমি কবে থেকে থিয়েটার শুরু করলে আর পর্দায় কীভাবে এলে, সেই পুরনো গল্পটা একটু বলবে?
আমি কলেজে পড়ার সময় থেকে থিয়েটার করি। সেটা সম্ভবত ৯১ সাল। মেঘনাদ ভট্টাচার্য আমাকে ডেকে পাঠান। সায়ক-এর 'দায়বদ্ধ' নাটকে হঠাৎই একটা রিপ্লেসমেন্ট দরকার পড়েছিল ওদের। যে মেয়েটি করত, তার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয় আর সামনে একটা কল শো ছিল। রিহার্সাল দেওয়ার সময় ছিল না। নাটকটা আমার দেখা ছিল তার আগে পাঁচ-সাতবার। কোনও রিহার্সাল ছাড়াই অভিনয় করেছিলাম, ঈশ্বরের আশীর্বাদে কোনও ডায়ালগ ভুল করিনি। সেই থেকে থিয়েটার করা শুরু। তার পরে 'বাসভূমি' যখন মঞ্চস্থ হল, তখন প্রথম থেকেই ছিলাম। এখনও দেশে বা বিদেশে 'বাসভূমি'-র শো হলে আমার ডাক পড়ে। টেলিভিশনে আমার যতদূর মনে আছে, 'নবীগঞ্জের দৈত্য' ছিল প্রথম কাজ। তার পরে ইন্দ্রাশিস লাহিড়ি একটা মেগার কথা বলেন। ওইভাবেই শুরু হয়ে যায়। আমি কখনও কোনও পোর্টফোলিও বানাইনি। বুদ্ধিও ছিল না যে বানাতে হবে। আসলে এটা নিয়ে আমার কোনও স্বপ্ন ছিল না। কিন্তু যা পেয়েছি তা স্বপ্নের থেকেও বেশি।
আরও পড়ুন: ‘আয়নার সামনে দাঁড়ালে পারফেক্ট, আমাকে নিজেকে লুকোতে হয় না’, অকপট অপরাজিতা
তোমার এত বছরের কেরিয়ারে সবচেয়ে ভালোলাগার বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নিয়ে যদি কিছু বলো।
তেমন বেশ কিছু চরিত্র রয়েছে। 'বহ্নিশিখা'-র কথা প্রথমেই বলতে হয়। দেবাংশু ডেকেছিল। এত ভালো একটা প্রজেক্ট, আর এরকমও যে অভিনয় হয়, এত রিয়্যালিস্টিক। আমার কোনও মেকআপ ছিল না বহ্নিশিখা-তে। প্রথম দিকে একটু টোন ডাউন করা হতো, পরের দিকে আর সেটাও ছিল না। শুধু চুলটা টেনে বেঁধে অভিনয়। আর কী দারুণ মেকিং ছিল। আমি খুব লাকি যে আমার জীবনে এমন একটা প্রজেক্ট এসেছিল। এছাড়া বলব 'তমসারেখা'-র কথা। একটু অন্য ধরনের কাজ ছিল। আর অবশ্যই 'দুর্গা'। এখনও আমাকে অনেকেই দামিনী রায়চৌধুরী বলে ডাকেন। 'ঝাঁঝ লবঙ্গ ফুল'-এর চরিত্রটিও খুব ভালো লেগেছিল। আর এখন 'রানু পেল লটারি'।
তুমি যে টেলিভিশন করার পাশাপাশি থিয়েটার করো, অ্যাকাডেমি-তে সময় দাও, এত কিছুর জন্য সময় বার করো কীভাবে?
আমি রবিবার টু রবিবার কাজ করি। আমার কোনও ছুটি নেই। থিয়েটার, অ্যাকাডেমির ক্লাস, টেলিভিশন, এই সবকিছুর সঙ্গে এখনও গানের নিয়মিত গানের অনুষ্ঠান করি। গানের রেকর্ডিংও থাকে মাঝেমধ্যে। আসলে আমি আর ঋষি, আমরা কেউই ক্যালকুলেটিভ নই। আমরা আনন্দে বাঁচি। ঋষি মেডিকেল কলেজে দুবছর পড়ে ছেড়ে দিয়েছিল। কারণ ওর ভালো লাগছিল না। কোনও কিছু আনন্দের সঙ্গে করলে, ঠিক সময় বেরিয়ে আসে। অনেকে বলেন টেলিভিশনে কাজ করার জন্য থিয়েটার ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু আমরা থিয়েটার এখনও করি। বরাবর করে এসেছি। আর অ্যাকাডেমির কাজটাকে আমার কখনও কাজ বলে মনে হয়নি। আমি আর ঋষি, আমরা দুজনে একই জায়গায় থাকি, হয়তো আলাদা আলাদা ক্লাসে বা আলাদা আলাদা কাজে থাকি। কিন্তু মনে হয় এই যুদ্ধে আমি একা নয়। আমরা আমাদের কাজে কেউ কাউকে আটকাই না। আমরা বিয়ের পরে দুজন দুজনকে দুটো ডানা উপহার দিয়েছি। এতটা লিবার্টি না পেলে আমি কিন্তু কাজ করতে পারতাম না। কারণ আমি একদম ঝগড়া করতে পারি না।
তোমাদের অ্যাকাডেমি অফ পারফর্মিং আর্টস কীভাবে তৈরি হল?
দুবছর হল আমাদের অ্যাকাডেমি হয়েছে। 'ভায়োলিন ব্রাদার্স'-এর জ্যোতিশঙ্কর রায় এই উদ্যোগের সঙ্গে ভীষণভাবে জুড়ে রয়েছেন। আমি আর ঋষি, আমরা অনেকদিন ধরেই ওয়ার্কশপ করাই, গ্রুমিং করাই। উনি আমাদের বললেন, তোমরা একটা নিজস্ব অ্যাকাডেমি করো। তখন ভাবলাম চ্যানেল বা হাউজের হয়ে তো অনেকের গ্রুমিং করছি, আলাদা করে কেন গ্রুমিং করব না। সেই ভাবনা থেকেই শুরু। আর যেখানে আমরা ক্লাস করি, রেন্টে অত সুন্দর জায়গা তো চট করে পাওয়া যায় না। সেই দাদা-বউদির কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের স্টুডেন্টরা আমাদের বন্ধু হয়ে যায়। রাধাকৃষ্ণণের একটা লেখা পড়ছিলাম কিছুদিন আগে, প্রকৃত শিক্ষক তিনিই, যিনি ভাবতে সাহায্য করেন। আমি তো সব চরিত্র বলে দিতে পারব না। কিন্তু বেসিকটা শিখিয়ে দিলে সে ভাবতে পারবে। আমরা ভাবতে শেখাই। আমি আর ঋষি, আমরা নিজেরাই ক্লাস নিই। আর আমরা ছাত্রছাত্রীদের মিথ্যে কাজের গ্যারান্টি দিই না। কাল আমারই কাজ আছে কি না জানি না, ছেলেমেয়েদের ভাগ্য নির্ধারণ করব কী করে? খুব নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় অডিশনে পাঠাই। আমি চাই না এখান থেকে গিয়ে কেউ ভিড়ের দৃশ্যে দাঁড়িয়ে থাকুক। ছোট ছোট স্কিট করে বলি না, যে হিরো হিরোইন করে দিলাম। আর এখন তো প্রায় সব ধারাবাহিকেরই গ্রুমিং আমাদের অ্যাকাডেমি-তে হয়, রিসেন্টলি 'আলোছায়া' পর্যন্ত।
হিয়া অর্থাৎ আমাদের পটল তো তোমার খুব প্রিয় ছাত্রী জানি, খুব প্রিয় আর কারা?
প্রিয় সবাই আর বাচ্চাগুলো বড্ড বেশি প্রিয়। তবে একদম প্রথম যে ব্যাচটা ছিল তাদের সঙ্গে মায়া জড়িয়ে গিয়েছে-- সৌম্যরূপ, রাই, তরুণ, নবনীতা। নিয়মিত আসতে না পারলেও, সরস্বতী পুজোটা এলেই ওরা সব সামলাবে। আমার মনে হয় যতদিন অ্যাকাডেমি থাকবে, ওরাও থাকবে। পরের ব্যাচে অনেককে বিশ্বাস করেছি যারা টাকা দেয়নি। আমি তো চাইতে পারব না। কিন্তু সবাই এমন নয়। কোর্স শেষ হয়ে গেলে বেশিরভাগের মন খারাপ হয়ে যায়। এখন যেমন হিয়া 'আলোছায়া' করছে, ওর খুব মন খারাপ, ক্লাসে আসতে পারছে না। আর একটি বাচ্চা সোহন, সেও খুব ট্যালেন্টেড, যে 'ভিলেন'-এ কাজ করেছে। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ভীষণ ভাবে পাশে থাকে। আমাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনও কথা বললে শুনতে চায় না। এটা একটা বড় পাওনা। আসলে থিয়েটারটা একটা পরিবার, অ্যাকাডেমির সংসারটাও বড় সংসার। তাই ওদের শুধু স্টু়ডেন্ট ভাবলে মুশকিল। মনটাকে মেলাতে হয়, নাহলে না প্রেম হয় না ভালোবাসা হয়, না ক্লাসটা করা যায়।
তুমি ভারি সুন্দর কথা বলো...
আমি তো ফিলজফি-তে এমএ। আমি ওটাও মন থেকে পড়েছি। আমার জীবনের দর্শন খুব পরিষ্কার। কিছু থাকবে না, কিছু নিয়ে যাব না। কিন্তু কথা থেকে যাবে।