৮ এপ্রিল বড়পর্দায় মুক্তি পাচ্ছে 'মহানন্দা'। তার প্রাক্কালেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার কাছে মহাশ্বেতা দেবীর ভূমিকায় অভিনয় করার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন গার্গী রায়চৌধুরি। লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
'মহানন্দা'কে মহাশ্বেতা দেবীর বায়োপিক বলব, না তাঁর জীবনকাহিনির আঁধারে সিনেমা বলতে পারি?
এখানে আমরা ওঁর কাজ কিংবা সমাজের প্রতি অবদান তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, তাই 'মহানন্দা'কে মহাশ্বেতা দেবীর জীবন আঁধারিত ছবি বলা ভাল।
কেমন অনুভূতি?
খাবার পাতে পড়ার আগে ঠিক যেমনটা রাঁধুনির বুক ধুকপুকানি থাকে।
ট্রেলারে মহাশ্বেতা দেবীর বিভিন্ন বয়সের লুকে দেখা গিয়েছে আপনাকে, মোট কটা লুক রয়েছে?
পাঁচটি লুক রয়েছে। মহাশ্বেতা দেবীর জীবনের পাঁচটা অধ্যায়ের কথা তুলে ধরা হয়েছে গল্পে- ৩০, ৪৫, ৫৫, ৬৫, ৭৫। পনেরো বছর সময়ের ফারাকে ওঁর জীবনের নানা ঘটনা দিয়ে চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছে। যখন বিয়ে হল.. তারপর যে সময়টা উনি 'হাজার চুরাশির মা' লিখছেন। লেখালেখির পাশাপাশি যখন আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে পড়ছেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর হয়ে প্রতিবাদী আওয়াজ তুলছেন- এহেন তাঁর নানা বয়সের ঘটনা রয়েছে গল্পে।
'মহানন্দা'র জন্য আলাদাভাবে কোনও হোমওয়ার্ক করতে হয়েছে?
মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। সিনেমার অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমি তাৎক্ষণিকতায় বিশ্বাসী। হয়তো কোনও একটা দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে মনে হল একটু অন্যভাবে বিষয়টাকে তুলে ধরি। আমার কাছে ওয়ার্কশপ মানে হল পরিচালক, সহ-অভিনেতার সঙ্গে কমফর্ট জোন বাড়ানো। শুরু থেকেই অরিন্দমদা (শীল) আর গোটা টিমকে নিয়ে বসে চিত্রনাট্য তৈরি করা কিংবা সেটাতে শাণ দেওয়ার মতো কাজগুলো করেছি। তাছাড়া মহাশ্বেতা দেবীর লেখা আমি আগেও অনেক পড়েছি। তবে হ্যাঁ, এই সিনেমাটা করার আগে ওঁর সাক্ষাৎকারগুলো অনেক বেশি করে দেখেছি। কারণ, একটা সাক্ষাৎকারের সময়ে মানুষের ভিতরের কথাগুলো বেরিয়ে আসে। এটা আমার কাছে দারুণ ইন্টারেস্টিং বিষয়! সেখানে তাঁর অভিব্যক্তি, কথা বলার ধরণ খুব ভালভাবে ধরা পড়ে। যে কোনও মানুষকে ভাল করে চেনার জন্য আমি আগে তাঁর ইন্টারভিউ দেখি।
সামাজিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও মহাশ্বেতা দেবীর অবদান অনস্বীকার্য, নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক চরিত্র বলতে পারি, সেরকম ব্যক্তিত্বের ভূমিকায় অভিনয় করা কতটা চ্যালেঞ্জিং মনে হল?
যখন একজন মানুষ বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করেন, তখন তাঁর জীবন আঁধারিত কোনও ছবি করতে গেলে একটা ভাবনা আসে যে, কতটা ফুটিয়ে তুলতে পারব? প্রাথমিকভাবে সেরকম মনে হলেও 'মহানন্দা'র শুট শুরু করার পর আর সেটা মনে হয়নি। আমি এমন ক'জন মানুষের সংস্পর্শে রয়েছি, যাঁরা মহাশ্বেতা দেবীকে খুব কাছ থেকে চিনতেন-জানতেন। সেই জায়গাটা আমাকে খুব সাহায্য করেছে। কারণ আমি কোনওদিন ভাবিনি যে মহাশ্বেতা দেবীর জীবন আঁধারিত ছবিতে আমি অভিনয় করব।
ওঁর জীবন itself একটা সিনেমার মতো। অসম্ভব ক্যারিশ্ম্যাটিক মহিলা। আমার মনে হয়, সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীকে কোথাও গিয়ে অ্যাক্টিভিস্ট মহাশ্বেতা দেবী অনেক বেশি করে আঁকড়ে রাখত। একবার তো নোবেল পুরস্কারের জন্য ওঁর নামও প্রস্তাবিত করা হয়েছিল।
এরকম অনেক ঘটনা শুনেছি, যেখানে বহু প্রশাসনিক স্তরের আধিকারিকরা মহাশ্বেতা দেবীকে যেমন অসম্ভব ভালবাসতেন, আবার ভয়ও পেতেন। উনি যখনই দূর থেকে আসতেন, ওঁরা বলতেন- "এই দিদি আসছেন.. এক্ষুণি টাকা চাইবেন।" যে টাকা তিনি মানুষের সাহায্যে কাজে লাগাতেন। সারাক্ষণ নিজের সমস্ত নির্যাসটুকু দিয়ে অপরের জন্য ভাবা, এই ভাবনাটা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ভীষণ আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। এইজন্যই জীবনে নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী থাকলেও তাঁকে কেউ আটকাতে পারেনি। একেবারে 'মহানন্দা' নদীর মতোই বয়ে গিয়েছেন।
একসঙ্গে ৫টা পুজোবার্ষিকীর জন্য লিখতেন। পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য তাঁর লড়াই, আত্মত্যাগও অনস্বীকার্য। আমাদের সিনেমাতেও ওঁর সমাজকর্মী সত্ত্বা তথা কর্মকাণ্ডকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বেশি। একটাসময়ে উনি বলতেন, "আমাকে লেখিকা হিসেবে কেউ মর্যাদা দিল না, কিন্তু এই লেখাই আমাকে উপার্জন এনে দিল।"
৭৫ বছর বয়সি লেখিকার চরিত্রের জন্য প্রস্থেটিক মেকআপও করতে হয়েছে। কতক্ষণ সময় লাগত?
তিন ঘণ্টা সময় লাগত মেকআপ করতে। আর আড়াই-তিন ঘণ্টা মেকআপ তুলতে। প্রতিদিন অল্প ভাত আর ডিম সেদ্ধ খেয়ে ভোর পাঁচটায় মেকআপে বসতাম। সকাল সাড়ে আটটায় শুট শুরু হত। রামপুরহাটের ৪৫ ডিগ্রি গরমেও রাত্রি ১২টা অবধি শুট চলত। ফিরে যখন প্রস্থেটিক খুলছি, দেখতাম অসম্ভব ঘাম ঝরছে। সেই মেকআপ এতটাই ভারী ছিল যে লাঞ্চও করতে পারতাম না। স্ট্র দিয়ে তরল কিছু গলধঃকরণ করতাম কোনও মতে। ফিরে একেবারে রাতে খেতাম। প্রায় ১৫ দিন এভাবে শুটিং করেছি। সোমনাথ (কুণ্ডু) আর হেমা অসম্ভব যত্ন করে মেকআপ করিয়ে দিত।
শুটের সময়কার কোনও স্মরণীয় মুহূর্ত? অভিনয় করতে গিয়ে কখনও আবেগঘন হয়ে পড়েছেন বা এরকম কিছু…
রামপুরহাটে প্রচণ্ড গরম। ফাঁকা মাঠে একটা বেড়া ভাঙার দৃশ্য। মহাশ্বেতা দেবী যেখানে বেড়া ভাঙতে ভাঙতে চেঁচিয়ে উঠছেন- "মাটি আমার মা.. আমি ছাড়ব না…" সেই দৃশ্যের শুটের আগে অরিন্দমদা বলছেন, "একটা পোর্টেবল এসি আনি এত গরম.." আমি বলেছিলাম- "কোত্থাও বসব না।" চারদিকে লোক পিলপিল করছে। টিমেরই কেউ একটা আমাকে কিছু বলতে গিয়েছিলেন, তো তার উত্তরে আমি একটু খেঁকিয়েই উঠেছিলাম। ওই ভীড়ের মধ্যে থেকেই একজন বলে উঠলেন- "বাবাহ বুড়ির অনেক তেজ আছে তো..!" প্রস্থেটিক মেকআপ এতটাই ভাল হয়েছিল যে, কেউ চিনতেই পারেননি আসলে। আবার কাউকে বলতে শুনলাম, "এই বুড়িটা বয়সকালে ভাল দেখতে ছিল।" এগুলো মজার ঘটনা রয়েছে অনেক।
এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নিজের কোনও মিল খুঁজে পেয়েছেন?
আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বলেন, আমি খুব তেজি। মহাশ্বেতা দেবী বরাবরই খুব তেজস্বিনী মহিলা ছিলেন। হ্যাঁ, তবে মানুষের জন্য নিজের মতো করে ভাবি। একেবারে তৃণমূল স্তরের লোকজনদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পছন্দ করি। আমার বাড়িতে ২৪ ঘণ্টা যে পরিচারিকা থাকেন, তাঁর সঙ্গে আমার অনেক বেশি বন্ধুত্ব। বহু টেকনিশিয়ানের সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক। ছোট থেকেই চারদিকের সবকিছু অবসার্ভ করতে পছন্দ করি। 'মহানন্দা' করতে গিয়ে আমার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো বেশ কাজে লেগেছে।
এই সিনেমায় গান খুব গুরুত্বপূর্ণ। ট্রেলারে সেই আভাস মিলল। রবীন্দ্রসঙ্গীত, সাঁওতালি মিউজিকের ধাঁচও রয়েছে…
হ্যাঁ। মোট ৫টা গান রয়েছে। প্রত্যেকটাই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সিনেমার সঙ্গে এত সুন্দরভাবে মিশে গিয়েছে যে, সেটা বড়পর্দায় না দেখলে বোঝা যাবে না।