Tota Roy Chowdhury Web Series: একজন সৎ নির্ভীক আইনজীবীর মুখ্য ভূমিকা ঠিক কেমন হওয়া উচিত? যেন তিনি তাঁর পেশার প্রতি কদর করেন। তাঁর লড়াইয়ের প্রতিটা শব্দ যেন ইনসাফ দিতে পারে নির্দোষ কাউকে। আর একজন অভিনেতা, তাঁর পেশার প্রতি কদর হওয়া উচিত নাকি না? অবশ্যই হওয়া উচিত! আর সেই কথাই আবারও প্রমাণ করলেন টোটা রায়চৌধুরী ( Tota Roy Chowdhury ) ।
অভিনেতা হিসেবে দীর্ঘদিনের পথচলা তাঁর। বাংলা সিনেমার নানা মোড় ঘোরানো মুহূর্ত দেখেছেন। হার্ডকোর কমার্শিয়াল ছবি হোক, অথবা আর্ট ফিল্ম কিংবা ঋতুপর্ণ ঘোষের ( Rituparna Ghosh ) চিরাচরিত ক্রাফট সিনেমা, টোটাকে নানা ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। আর এবার, যাহা বলিব সত্য বলিব ( Jaha bolibo Sotto bolibo) সিরিজে, প্রথমবারের মতো তিনি আইনজীবীর ভূমিকায়। তাও আবার ডিফেন্স ল- ইয়ার, সাহস লাগলো? কী কী শিখলেন? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার সঙ্গে 'ঠোঁটকাটা' টলিউডের টোটা অর্থাৎ পুস্পরাগ চৌধুরী।
রিলিজ হয়ে গিয়েছে, একদম ভিন্ন কোর্ট রুম ড্রামা, কোনও আইনজীবীকে নকল করেছিল চরিত্রটা প্রেজেন্ট করার আগে?
আমি, যখন অভিনয় করতে যাই, তখন একটা জিনিষ মাথায় রাখি যে চরিত্রের সঙ্গে আমার অর্থাৎ টোটার কোথায় কোথায় মিল আছে। এটা হলো প্রথম কথা। আর এবার হচ্ছে দ্বিতীয়। আমি এরপর চরিত্রটা ডাইমেনশন দেওয়ার চেষ্টা করি। যাতে আমার থেকেও ভিন্ন হবে। আমি চেষ্টা করি, যাতে কাউকে ফলো না করি। হোমওয়ার্ক করি, কিন্তু ফলো না। নাহলে ক্যারিকেচার হয়ে যাবে। আমার কল্পনাপ্রসূত একটা বিষয় থাকে। যাতে সেটা আমার সঙ্গে যায় এটাই। আর রয়েছে স্ক্রিপ্ট। ফেলুদার নজর দিয়ে যদি দৃষ্টিপাত করি তবে এটাই তো আসল। এতে সব লেখা থাকে। সঙ্গে পরিচালকের ভাবনা এবং ধারণা তো থাকেই। উনার, যেমনটা চাই। আর তো প্রচুর সিনেমা রয়েছেই।
বাপী সেন, যার মার্ডার কেস নিয়ে এই 'যাহা বলিব সত্য বলিব', সেই ঘটনাটি যখন নিজে কানে শুনেছিলে, তোমার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
আমার মনে আছে, দুটি ইমোশন কাজ করেছিল। প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল আর দ্বিতীয় হচ্ছে হতাশা। রাগের কারণটা হচ্ছে একটা বচসার জেরে একজন পুলিশ অফিসারকে মারা হল। আর মারল কারা? যারা নিজেরাই পুলিশ অফিসার। এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব না। এটা যদি সমাজবিরোধী বা কোনও ক্রিমিনালের কাজ হতো তাহলে মেনে নেওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু পুলিশ কর্মীরা, একজনকে নৃশংসভাবে মারল। তবে, পরে যখন আমরা আরও বিষদে জানতে পারি সিরিজের জন্য যে একজন মানুষকে কীভাবে মারা হয়েছিল, গা গুলিয়ে উঠেছিল বিশ্বাস করো।
আর হতাশ..? ( একটু থেমে ) হতাশ এইজন্য হয়েছিলাম যাদের জন্য তিনি প্রাণটা দিলেন, তাদের খোদ পুলিশ কমিশনার অনুরোধ করেন যে আসুন, এসে বিষয়টার দিকে আলোকপাত করুন। কিন্তু না, তারা নীরবে নিভৃতে থেকে গেলেন। সেটা থেকে একটু হতাশা হয়েছিল।
রাত বিরেতে পুলিশের কাছে সকলেই কি নিরাপদ? কারণ এই কেসটা পর্যবেক্ষণ করলে তো...
বিষয়টা হচ্ছে। আমি এটাকে দলীয়ভাবে দেখব না। পুলিশ তো একজন না। অনেক মানুষ, পুরো ফ্রেটার্নিটি। তাঁদের সবাইকে দোষারোপ করা উচিত না। কারণ, আমার বেড়ে ওঠা শহর কলকাতায়। আমি কিন্তু, রাত বিরেতে বলো বা, যেকোনও সময় খুব সাহায্য পেয়েছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেয়েছি। আমি যখন অভিনেতা হিসেবে নামও করিনি তখন কিন্তু কলেজের ক্ষেত্রে হোক বা অন্যান্য জায়গা, পুলিশের তরফে বরাবরই সহযোগিতা পেয়েছি। সুতরাং সেইদিন যে কান্ড ঘটেছিল তারা পাঁচজন দায়ী। যে অবস্থায় তারা ছিলেন সেটা ভয়ংকর। এদের আচরণ সমগ্র পুলিশের প্রতিফলন না। নাহলে, কলকাতা শহরকে সুরক্ষিত শহর বলা হত না। তাঁর জন্য কলকাতা এবং সমস্ত পুলিশ সমাজকে সাধুবাদ জানাব।
শুটিং চলাকালীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলে মিমি চক্রবর্তীর সঙ্গে?
চ্যালেঞ্জটা আমার সঙ্গে মিমির ( Mimi Chakraborty ) হয়নি। হয়েছে পৃথার সঙ্গে জয়রাজের। আমি ভীষণ আনন্দ পেয়েছি। উপভোগ করেছি। আর ভাল স্ক্রিপ্টে কাজ করলে এমনই শুটিং ভাল হয়। আমি ডিফেন্স আর মিমি পাবলিক প্রসিকিউটর। আমি, বাস্তবে দেখেছি যে উকিলরা কোর্টের ভেতরে মারমার কাটকাট! একের পর এক কাউন্টার - প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। কিন্তু, বাইরে তারা বেশ ভাল বন্ধু। তবে, এই সিরিজে কোর্টের বাইরের দৃশ্য একদম নেই। পুরোটাই কোর্টরুম।
দুজনের অভিনয় দেখে কোথাও তো মনে হচ্ছিল 'বীর জারা' ( Veer-Zara ) ছবির রানী মুখোপাধ্যায় আর অনুপম খের...
( হাসি ) এটা কিন্তু দারুণ কমপ্লিমেন্ট। আমি আগে শুনিনি। সত্যি, এই কথাগুলো তো আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল কোনওদিন, বা বাস্তবে মানুষকে ন্যায় দিতে পেরেছ?
মানুষ হিসেবে কিছুটা। ক্ষীণ আশা থাকলেও আমি প্রতিবাদ করি। যদিও, অনেকে বলেছেন আমায় যে কেন এসবের মধ্যে যাও। কেন ঝুটঝামেলায় পড়ছ। আমি তাদের একটাই কথা বলি যে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই হবে। নাহলে, ভবিষ্যতে অন্যায় ন্যায় হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হবে। আজ থেকে প্রতিবাদ করতেই হবে। এর ভাষা যে শুধু মারামারি হবে সেটা না। নরম ভাবে, যুক্তি দিয়ে, নীরব ভূমিকা নিয়েও প্রতিবাদ করা যায়। এই যে আমরা বলি, সমাজের কী হবে? এই যে অবক্ষয়, এটা কিন্তু আমাদের জন্যই হয়। আমরা পরোক্ষভাবে হলেও দায়ী। কারণ, আমরা প্রতিবাদ করি না। আমি প্রতিবাদ করি, সমবেত হয়ে আমরা প্রতিবাদ করে ফল পেয়েছি। একটা কথা যদি আওয়াজ তুলে বলতে পারি তবে শুনবে অনেকে।
মিথ্যের আশ্রয় নেয় যে আইনজীবী, টাকা কিংবা নামের কারণে ... জীবনে ফেস করেছ এসব কিছু?
বহুবার দেখেছি। আমি এমন অনেক কিছু ফিল করছি বলতে পারো। বিশদে বলতে পারব না। তবে, গত ৭ বছরে অনেক কিছু যা ঘটেছে...আবার অনেককে দেখেছি যারা সত্যের জন্য জান লড়িয়ে দেয়। অনেককে দেখেছি, ক্লায়েন্টকে ধরে রাখতে প্রতিপক্ষের থেকে টাকা নেন। ব্যাক্তিগত জীবনে এটাও দেখা। ভাল খারাপ সব পেশাতে আছে। পেশার প্রতি সততা না থাকলে পেশার অপমান। একজন দুজনের জন্য বাকিদের বদনাম হয়।
২০২৩ অসাধারণ কেটেছে তোমার, বলিউড এন্ট্রি, পরপর সিরিজ... পার্থক্য কিছু পেলে?
বলিউডের পয়সা বেশি। আমাদের পয়সা কম। ওদের সময় বেশি। আমাদের সময় কম। এই দুটি যদি থাকত, বাংলা ছবিতে যে ট্যালেন্ট আছে আমরাও ওদের মত কী আরও ভাল ছবি বানাতে পারতাম। কোনও কারণে মার্কেট বড় করতে পারিনি। অন্যান্য রিজিওনাল সিনেমার ক্ষেত্রে গুজরাট মারাঠি এরা নিজেদের আরও বেশি করে বাড়াচ্ছে। আর, আমরা আরও সংকুচিত হচ্ছি। আসলে কারণ কী? আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে দুই থেকে তিনজন আপ্রাণ চেষ্টা করছে। যাবতীয় যা কিছু করছে। কিন্তু বাকিরা, কেমন যেন গা ছাড়া। নয়তো তারা তাল মেলাতে পারছে না। নয়তো চাইছে না, আবার নয়তো অল্পতেই সন্তুষ্ট। এরইমধ্যে যা আছে করে খায়। রিস্ক নেবে না। সেকারণেই, তফাৎ! আগামীদিনে টক্কর দিতে গেলে রিচ বাড়াতে হবে।
'বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানো...' বিরাট নামের তারকা উপস্থিতি থাকলেও অনেক ছবির শো ফাঁকা যায়। তোমার, মতে সুপারস্টার ব্যতীত আর কী কী থাকা উচিত একটি বাংলা ছবির মধ্যে যাতে মানুষ হলমুখী হয়?
এটা একটা বিরাট বড় উত্তর। বিশদে ভেবে দেখেছি। আমি অল্প করে বলছি। অনেক সময় হল ফাঁকা যায়। হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ২৩০ টা মত ছবি হয়। কিন্তু, কটা দেখতে যায় মানুষ? খুব বেশি হলে ২০ টা ছবি। বাংলা ছবি হয় ৬০-৭০ টা। মানুষ, ১০-১৫টা দেখে। পার্সেন্টেজ হিসেবে বিচার করলে আমরা দেখি যে বাংলা ছবির দর্শক অনেক বেশি।
দ্বিতীয়, আসছে সুপারস্টারডম। শেষ দশবছর ধরে আমরা দেখেছি সুপারস্টারকে হেয়ো করা হয়েছে। প্রচুর মানুষ, মিডিয়ার মানুষ লিখেছিলেন যে এইসব বাজারি সিঙ্গেল স্ক্রিন হলের ছবি, রীতিমতো, গালাগাল দেওয়া হয়েছে। বোম্বেতে হয়েছে। আমাদেরও হয়েছে। কোথায় হয়নি? দক্ষিণে হয়নি। জওয়ানকে দেখো শাহরুখ ছাড়া, সবাই দক্ষিণের মানুষ। তাহলে? ওদের মানুষজন ওদের তারকাদের কাছের মানুষ ভাবে, তাদের ভালবাসে, সেই জন্য ওরা এগিয়ে গিয়েছে। শেষ দশবছর আমরা গালাগাল দিয়েছি কমার্শিয়াল ছবিকে। এখন জিজ্ঞেস করছে, কেন চলছে না তাদের ছবি? অল্টারনেট বাংলা ছবি হল ভরাতে পারে না। হতেই পারে না। সারা বিশ্বে কমার্শিয়াল ছবি। Marvel-Avengers যাই বলো। আর যদি বাংলার কথা বলো তাহলে বুম্বা দা, দেব, জিৎ ...সকলেই কমার্শিয়াল ছবির প্রোডাক্ট। এইসব ছবি ছাড়া হলে মানুষ যাবে না। তারা বিনোদন পেতে যায়। ভাবনাজনিত ছবি দেখতে মানুষ হলে যায় না। কিংবা আঁতেল ছবি থেকে আসে না। ওগুলো প্রাইজ পায়। দিজ্ঞজ লোকেরা সেই নিয়ে আলোচনা করে। ব্যবসা দেয় কমার্শিয়াল ছবি। আমরা সেটাকে ছোট করেছি।
সুপারস্টার ইন্ডাস্ট্রির অ্যাসেট। বুম্বা দা, দেব-জিৎ সকলেই ব্যবসা দিয়েছেন এই কমার্শিয়াল ছবির মধ্যে দিয়েই। আমি কমার্শিয়াল ছবি করেছি বলে, আমায় সেই দেখে ঋতু দা চোখের বালিতে নিয়েছিলেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী বাঙালির কাছে সেটা ভাল লাগে নি। তাকে কালচারালি খেলতে হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিকে টেনে নামিয়েছে তো কী করা যাবে? আবার সমবেতভাবে সেটা শুরু না হলে কিছু করা যাবে না।
টোটা রায়চৌধুরী বলিউডে পা রাখতেই মাথায় বৈদুর্যমনি জুড়ল?
আমার মনে হয়, আমি যখন বাইরে কাজ করি আমি বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে রিপ্রেজেন্ট করি। আমি ইন্ডাস্ট্রি বদলাতে যাচ্ছি না। বাংলার টোটা। বাংলার থেকে শিখেছি। বাংলার মানুষ আমায় তিনদশক ধরে ভালবেসেছেন। আমায় সহ্য করেছেন। এখানের ক্রাফট আমার রক্তে। আমি আজ তোমায় বলে যাচ্ছি, শেষ দিন অবধি আমি বাংলার টোটা থাকবো।