Advertisment
Presenting Partner
Desktop GIF

বছরে ১৫ কোটি টাকা লগ্নি, প্রতিকূলতা নিয়েও মাথা উঁচু করে বাঁচে কলকাতার যাত্রাশিল্প

Kolkata's Jatra Community: এই ৫০০ বছরেরও পুরনো লোকশিল্প এখনও আদরণীয় গ্রাম বাংলার দর্শকের কাছে। যুগ ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে কলকাতার যাত্রা সম্প্রদায়?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Kolkata's Jatra community surviving all odds

কলকাতার যাত্রার অগ্রণী ও বর্ষীয়ান শিল্পী-সংগঠকরা। ছবি সৌজন্য: চিরশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

Kolkata's Jatra Community: বাংলার যাত্রা এমন একটি বর্ণময় লোকশিল্প যা পাঁচশো বছরেরও বেশি প্রাচীন। এক সময়ে যা ছিল পৌরাণিক গাথা, রূপকথার গল্পের মঞ্চ রূপায়ণ তা এখন অনেকটাই সামাজিক পালা-ময়। মধ্যে অনেক প্রতিকূল সময় এসেছে, মাঠের দর্শক টেলিভিশনমুখী হয়েছেন। কিন্তু বোধহয় যাত্রাশিল্পীদের অদম্য প্যাশনই এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতগুলো বছর ধরে। ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে ঠিক কেমন আছে বাংলার এই লোকশিল্প, কেমন আছেন যাত্রাশিল্পীরা, তারই অনুসন্ধানের চেষ্টা এই প্রতিবেদনে।

Advertisment

শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের অনুষঙ্গ হিসেবেই তৈরি হয়েছিল এই লোকশিল্প। যাত্রা শব্দটির অর্থ হল একটি সাঙ্গিতীক সফর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা লেখার ধরন বদলছে, পরিবেশন পাল্টেছে কিন্তু গান-নাচ, স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী উপযুক্ত আবহের ব্যবহার, এগুলি পুরোমাত্রায় বজায় রেখেছেন এই প্রজন্মের পালাকার ও শিল্পীরা। তাই একজন যাত্রা অভিনেতা ও অভিনেত্রীকে অত্যন্ত দক্ষ হতে হয় গান ও নাচে। টানা তিন ঘণ্টারও বেশি বিরতিহীন অভিনয়, কয়েকশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যাত্রা করে ভোরবেলা ফিরে পরদিন দুপুরে পরবর্তী প্যান্ডেল-এর উদ্দেশে রওনা হওয়া, শৈত্যপ্রবাহ থেকে শুরু করে চৈত্র-বৈশাখের দাবদাহ-ঝড়-বৃষ্টি এমনকী ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত শোকতাপ সরিয়ে রেখেও যাত্রাশিল্পীরা পারফর্ম করে চলেন-- এটাই দস্তুর।

Kolkata's Jatra community surviving all odds এই সময়ের অগ্রণী যাত্রাশিল্পীরা।

আরও পড়ুন: কর্পোরেট কেরিয়ার ছেড়ে কীভাবে হয়ে উঠলেন অভিনেতা, গল্প শোনালেন ‘দুর্গা দুর্গেশ্বরী’-নায়ক

বাংলায় মোট তিনটি যাত্রা ইউনিট রয়েছে-- তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ইউনিটটি কলকাতায়, চিৎপুর-কেন্দ্রিক। আর অন্য দুটি ইউনিটের একটি রয়েছে মেদিনীপুরে ও অন্যটি দক্ষিণ ২৪ পরগণায়। কলকাতার যাত্রাশিল্পীদের সংগঠন 'সংগ্রামী যাত্রা প্রহরী'-র বর্তমান সভাপতি মঞ্জিল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''প্রতি বছর প্রায় ১৫ কোটি টাকার লগ্নি হয় শুধুমাত্র কলকাতার যাত্রা জগতে। কলকাতার যাত্রায় যে পরিমাণ টাকার ইনভেস্টমেন্ট হয় তা বাংলার চলচ্চিত্র জগতেও হয় না। দশ-বারো বছর আগে টেলিভিশনের কারণেই যাত্রার দর্শক কমে গিয়েছিল। সেখান থেকে আমরা কিন্তু আবারও দর্শককে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি প্যান্ডেলে। অনেকেই জানেন না সিনেমায় যেমন ইন-ফিল্ম হয়, যাত্রাতেও তেমন স্পনসরশিপ চালু হয়েছে। যেহেতু যাত্রার অডিয়েন্স বিপুল, তাই বিজ্ঞাপনদাতারা এই মাধ্যমের গুরুত্ব বুঝে এগিয়ে এসেছেন।''

Kolkata's Jatra community surviving all odds ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রা মঞ্চ ও অ্যাকাডেমি।

২০০৭ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্যোগে যাত্রাশিল্প ও শিল্পীদের উন্নয়নের লক্ষ্যেই বাগবাজার স্ট্রিটে নির্মিত হয় 'ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রা মঞ্চ' যা কি না 'পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা অ্যাকাডেমি'-র আবাস। মঞ্চটি ডিজাইন করেছিলেন কণিষ্ক সেন। এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল, যাকে পুরোমাত্রায় এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে রাজ্যের বর্তমান সরকার।

''সরকার আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। মুখ্যমন্ত্রী ও অরূপদা দুজনেই যাত্রা শিল্পীদের কথা ভাবেন, তাঁদের সমস্যাগুলো বোঝেন'', বলেন সংগ্রামী যাত্রা প্রহরীর বর্তমান সেক্রেটারি মিতালি চক্রবর্তী, ''দুঃস্থ শিল্পীদের জন্য বার্ষিক পেনশন চালু করা হয়েছে, আমাদের সংগঠনের কোনও অফিস ছিল না। আমরা রাস্তাঘাটে মিটিং করতাম। এখন আমরা অ্যাকাডেমি-তে একটা ঘর পেয়েছি, আমাদের যাতে একটা পাকাপাকি ঠিকানার ব্যবস্থা করা যায়, সেটাও চেষ্টা করছেন অরূপদা। কিন্তু যাত্রায় অনেক সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে বাসশিল্পীরা অনেকেই ঠিক সময়ে পেমেন্ট পান না। আমি এক বছর আগে দায়িত্বে এসেছি। পাঁচজন প্রোডিউসারকে আমরা বসিয়ে দিয়েছি কারণ তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে পেমেন্ট বাকি রেখেছিলেন। ৫০ টাকা, ১০০ টাকা রোজে যাঁরা কাজ করেন, যাঁদের এই টাকায় সংসার চলে, তাঁদের এভাবে কী করে চলবে। এই বাসশিল্পীরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হন। তাঁদের স্কুলবাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়, পাখা থাকে না, পুকুর থেকে জল তুলে খেতে দেওয়া হয় অনেক সময়, এগুলোই আমরা বন্ধ করার চেষ্টা করছি।''

Kolkata's Jatra community surviving all odds মঞ্জিল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মিতালি চক্রবর্তী। ছবি: শাঁওলি

আরও পড়ুন: নিজের নামটাই বদলে ফেলতে হয়েছিল ভাস্বরকে

যাত্রার প্রযোজকরা প্রতি বছর রথের দিনে তাঁদের সেই বছরের দল ও প্রযোজনা ঘোষণা করেন। ওই সময়েই শিল্পীদের সঙ্গে কনট্রাক্ট সই করা হয়। কোন শিল্পী সেই বছর কোন দলে অভিনয় করছেন, সেটা তখনই জানা যায়। এই পর্যায়টা অনেকটাই কলকাতা ময়দানের দলবদলের মতো। সেই নিয়ে বেশ মজার কিছু ঘটনাও ঘটে, বাগবিতণ্ডাও হয়। তবে কলকাতার যাত্রা সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য অত্যন্ত বেশি। তাই সব সমস্যাই মিটিয়ে নেন নিজেদের মধ্যে। পালা-র নাম ঘোষণা ও শিল্পীদের কনট্র্যাক্টের পরে শুরু হয় রিহার্সাল ও যাত্রার শো শুরু হয়ে যায় সপ্তমী থেকে যা চলে পরের বছর জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত।

যাত্রাশিল্পীরা এই বিশেষ ফর্মটি নিয়ে এতটাই আবেগপ্রবণ এবং পেশাদার মনোভাবসম্পন্ন যে সব প্রতিকূলতাই সেই প্যাশন দিয়ে তাঁরা অতিক্রম করে যান। ''আমার স্বামী মারা গিয়েছেন, সেইদিন ডবল শো, মুখাগ্নি করে শো করেছি'', বলেন বর্ষীয়ান তারকা যাত্রাশিল্পী রুমা দাশগুপ্ত যিনি এখন যাত্রা অ্যাকাডেমি-র প্রধান উপদেষ্টা। নতুন প্রজন্মের তারকা অমৃতা চ্যাটার্জি বলেন, ''আমি সিনেমা করেছি, টেলিভিশনও করেছি কিন্তু যাত্রা করি তার কারণ অভিনয়ের চর্চার সুযোগটা এখানে অত্যন্ত বেশি। একজন যাত্রা শিল্পীকে নাচ-গান সবটাই জানতে হয়, প্রত্যেকবার সেরা পারফরম্যান্সটা দিতে হয়। আর এখানে কাজের ফিডব্যাকটা পাওয়া যায় সরাসরি। যাত্রার দর্শক অত্যন্ত সংবেদনশীল। ভালো হলে যেমন তাঁরা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন আবার খারাপ হলে কিন্তু এসে বলেন তুমি অভিনয় করতে পারো না। অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটা ফর্ম। আর সেটাই ভালো লাগে।''

Bengali Actor Bengali Actress
Advertisment