Advertisment

বাংলা শিখতে শিক্ষক রাখেন লতা, চুটিয়ে কাজ করেছিলেন হেমন্ত-সলিল-কিশোরদের সঙ্গে

কিশোর, মান্না দে, সলিল চৌধুরি, পঞ্চমদের সঙ্গে কীরকম সম্পর্ক ছিল লতা মঙ্গেশকরের? পড়ুন বিশদে।

author-image
Sandipta Bhanja
New Update
Lata Mangeshkar with Bengali musicians, RD barman, Lata Mangeshkar, kishore kumar, লতা মঙ্গেশকর, পঞ্চমদা, মান্না দে, সলিল চৌধুরী, কিশোর কুমার, শচীনদেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বাংলার সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের সম্পর্ক, bengali news today

লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে বাংলার আত্মীক সম্পর্ক

বাংলার সঙ্গে বাস্তবে নাড়ির যোগসূত্র না থাকলেও এই ভাষার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। কাজের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছিল এক আত্মিক সম্পর্ক। আর তাই বাংলা ভাষা শিখতে কিংবদন্তী রীতিমতো বাড়িতে শিক্ষক রেখেছিলেন। তাও আবার কার তত্ত্বাবধানে বাংলা শিখেছিলেন জানেন? তিনি বাসু ভট্টাচার্য। তৎকালীন মুম্বইয়ের খ্যাতনামা বাঙালি পরিচালক। তিনিই ছিলেন লতার বাংলার গৃহশিক্ষক।

Advertisment

আসলে গোড়া থেকেই পারফেকশনে বিশ্বাসী ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি থেকে শুরু করে শচীন দেব বর্মন, রাহুল দেব বর্মন, কিশোর কুমার, মান্না দে প্রমুখ বাঙালি সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। বাংলার সুরকার, গীতিকার-গায়কদের সঙ্গে গানের সূত্রেই লতার একটা আত্মিক যোগ গড়ে উঠেছিল বলা যায়। আর সেই থেকেই বাংলা গান গাওয়ার প্রস্তাব আসতে থাকে তাঁর কাছে একটার পর একটা। তবে বাংলা গান গাইতে হলে যথাযথ উচ্চারণের জন্য ভাষার দখল প্রয়োজন। কিন্তু লতা তো তখনও বাংলাটা শিখে উঠতে পারেননি! অতঃপর বাংলা ভাষাকে আরও কাছ থেকে জানার জন্য গৃহশিক্ষক রাখবেন বলে মনস্থ করলেন। প্রস্তাব গেল বাসু ভট্টাচার্যের কাছে।

publive-image
একফ্রেমে লতা-আশা, কিশোর-পঞ্চম

অত বড় মানের শিল্পী হয়েও বাধ্য ছাত্রীর মতো বাংলা শিখেছিলেন। নাহলে শুধুমাত্র বাংলা ভাষাতেই প্রায় ২০০টির মতো গান গাইতে পারতেন না। লতার গাওয়া বাংলা গানের সেই তালিকার দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়, আজও সমানভাবে সেগুলো শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়। তিনি প্রথম বাংলায় কাজ করেন নরেশ মিত্রর 'বউ ঠাকুরানির হাট' সিনেমায়। তাতে ২টি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন। সেটা ১৯৫৩ সালের কথা। সেইসময়েই 'অমর ভূপালী' মারাঠি ছবির বাংলা রিমেক হয়। সেখানে সঙ্গীত আয়োজক নীতিন বসুর তত্ত্বাবধানে 'ঘন শ্যাম সুন্দর' গেয়েছিলেন মান্না দে'র সঙ্গে ডুয়েটে। মারাঠি ছবিতেও লতা-মান্না জুটিই গেয়েছিলেন। তবে প্রথম কলকাতায় এসে ২টো পুজোর গান রেকর্ড করা সম্ভবত ১৯৫৬ সালে। কম্পোজ করেছিলেন ভূপেন হাজারিকা। গানের কথা লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। মতান্তরে তাঁর গাওয়া প্রথম বাংলা গান, 'প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে' (১৯৫৬)। গানের কথা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা। সুর করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

publive-image
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গান নিয়ে কথোপকথনে লতা মঙ্গেশকর

সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লতার কতটা কাছের ছিলেন, তা তাঁর জীবনী থেকেই বোঝা যায়। বাংলার প্রবাদপ্রতিম শিল্পী তখন মুম্বইয়ের আরেক বাঙালি পরিচালক শশধর মুখোপাধ্যায়ের ডাকে কাজ শুরু করেছেন। 'আনন্দমঠ' ছবিতে 'বন্দেমাতরম' গানের সুর করলেন হেমন্ত। কিন্তু প্রশ্ন উঠল গাইবে কে? হেমন্তের পছন্দ লতা মঙ্গেশকর। কিন্তু বাদ সাধল স্টুডিওর ব্যানার। কারণ ততদিনে ফিল্মিস্তান-এর সঙ্গে গায়িকার কিছু মন কষাকষি চলছে। পরিচালক শশধর পত্রপাঠ বলে দিলেন যে, লতা কখনোই এখানে গান গাইবেন না! ওদিকে হেমন্তও নাছোড়বান্দা। এই গান তিনি কোকিলকণ্ঠীকে দিয়েই গাওয়াবেন। কিন্তু পরিচালক বলছেন, লতাজি গাইতে আসবেন না। একপ্রকার শাঁখের করাত পরিস্থিতি তখন হেমন্তের। শেষমেশ, নিজেই লতাকে রাজি করানোর চ্যালেঞ্জ নিলেন।

একদিন সোজা চলে গেলেন লতার তৎকালীন নানাচকের বাড়িতে। গায়িকার আপ্যায়ণ-আথিতেয়তায় মুগ্ধ হেমন্ত। তারপরই 'আনন্দমঠ' ছবিতে গান গাওয়ার প্রস্তাব পেড়ে ফেললেন। লতা প্রথমটায় চুপ থাকলেও পরে সায় দিয়ে জানান, ফিল্মিস্তানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ঠিক না থাকলেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য তিনি গাইবেন। একথা শুনে সঙ্গীত পরিচালক তখন উচ্ছ্বসিত! পারিশ্রমিক কত নেবেন? প্রশ্ন করে বসলেন তিনি। এর উত্তরে লতা যা বলেছিলেন, সেটা অবাক করে দিয়েছিল হেমন্তকে। গায়িকা সপাটে জানিয়েছিলেন, "টাকার জন্য না, আপনার জন্যই গাইব।"

publive-image
সলিল চৌধুরীর সঙ্গে রেকর্ডিং স্টুডিওয় লতা মঙ্গেশকর

প্রকাশ্যেই সলিল চৌধুরির ভূয়সী প্রশংসা করতেন লতা মঙ্গেশকর। সলিলের সুরে 'যা রে যা রে উড়ে যারে পাখি', 'ও মোর ময়না গো', 'সাত ভাই চম্পা', 'না যেও না রজনী এখনও', 'না মন লাগে না' থেকে 'হায় হায় প্রাণ যায়', 'ওগো আর কিছু তো নাই' -এর মতো ৩০-৩৫ টা হিট গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সেই তালিকায় 'জাগো মোহন প্রীতম'ও রয়েছে। এমনকী লতার সঙ্গে বাংলা কথোপকথন নিয়েও রীতিমতো গুরুগম্ভীর ছিলেন সলিল। তিনি চাইতেন গায়িকা তাঁর কথার জবাব বাংলা ভাষায় দিন। আর ওদিকে লতা বাংলা শিখলেও পরিস্কার বলতে পারতেন না। তবে বাংলা ভাষাটা বুঝতেন ঠিকঠাক।

publive-image
মান্না দে ও লতা মঙ্গেশকর

গান রেকর্ড করা নিয়ে মান্না দে'র সঙ্গে বেজায় ভাব ছিল লতা মঙ্গেশকরের। দুই গায়ক-জুটিতে 'ইয়ে রাত ভিগি ভিগি', 'প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া', 'চুনরি সম্ভাল গোরি', 'আজা সনম মধুর চাঁদনি'র মতো অজস্র এভারগ্রিন হিট গান উপহার দিয়েছেন। লতা বলতেন, "ক্ল্যাসিকাল ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য মান্না দে নোটেশন করে আনতেন।" আর সেই বিষয়টা গায়িকার বেজায় ভাল লাগত।

publive-image
কিশোর কুমারের সঙ্গে আড্ডায় লতা মঙ্গেশকর

রেকর্ডিং স্টুডিওতে কিশোর কুমারকে নাকি একবার গম্ভীরভাবেই হুমকি ছুঁড়েছিলেন, "কিশোরদা দয়া করে হাসানো বন্ধ করুন, আমি কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব।" বছরখানেক আগে এক সাক্ষাৎকারে কিংবদন্তী গায়িকা কিশোর কুমারের সঙ্গে ডুয়েট রেকর্ড করার অভিজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, "কিশোরদা ছিলেন লাইভ এন্টারটেইনমেন্ট। ওঁর সঙ্গে রেকর্ডিং থাকলে বুঝতাম না যে, হাসব না গান গাইব! এত মজার মজার জোকস বলতেন যে, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত।"

publive-image
শচীনকর্তা, পঞ্চমের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকর

শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে ১৯৫১ সালে প্রথম কাজ করেন লতা। শচীনকর্তার করা সুরে লতার জনপ্রিয় গান 'ঠান্ডি হাওয়ায়ে' সাড়া ফেলে দিল সেইসময়ে। আবার পঞ্চমের সঙ্গে নাকি হাফ-প্যান্ট পরা বয়স থেকেই আলাপ ছিল গায়িকার। তাঁদের প্রথম দেখা কীভাবে হয়েছিল, লতা বহুকাল আগে এক সাক্ষাৎকারে সেকথা ফাঁস করেন। শচীন দেববর্মনের সঙ্গে একটা গানের রেকর্ডিংয়ে ব্যস্ত লতা। সেইসময়েই খাতা হাতে অটোগ্রাফের জন্য এক কিশোর গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করে স্টুডিওতে। সেদিন পঞ্চমের অটোগ্রাফের খাতায় লতা কী লিখেছিলেন জানেন? রসিকতা করেই সাদা পাতায় লিখে দেন- "পঞ্চম বদমাশি ছোড় দো।…" পরে অবশ্য তাঁরই বোন, তবে বয়সে ৬ বছরের বড় আশা ভোঁসলেকে বিয়ে করেন পঞ্চম।

আজ পরপারে বোধহয় লতা মঙ্গেশকরকে স্বাগত জানাতে জলসার আয়োজনে ব্যস্ত হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কাঁপানো সেসব বাঙালি সঙ্গীতশিল্পীরা।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Manna Dey Salil Chowdhury Kishore Kumar Lata Mangeshkar death R. D. Burman Lata Mangeshkar Hemanta Mukhopadhyay Entertainment News Indian Music S. D. Burman
Advertisment