গোটা দেশ আজ শোকবিহ্বল। চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)। কিংবদন্তী গায়িকার প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করে দু দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে বিনোদুনিয়ার তারকারা, প্রত্যেকেই আজ স্মৃতির সরণিতে হাঁটলেন সুর-সম্রাজ্ঞীর স্মৃতিচারণা করে। বাংলা সঙ্গীতজগতের কাছে এ যেন সরস্বতী বিসর্জন। বসন্ত পঞ্চমী তিথিতেই মানব-সরস্বতী বিদায় নিলেন চিরতরে। প্রবাদপ্রতীম 'কোকিলকণ্ঠী'র বাংলায় গান গাওয়ার শুরু হেমন্ত কুমারের হাত ধরে। গাইলেন, 'প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে…'। বাংলা ভাষায় লতার গাওয়া গানের সংখ্যাও নেহাত কম নয়! মোট ১৮৫টি।
লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে বাংলা সঙ্গীতজগৎও গভীর শোকে। কেউ বলছেন, দ্বিতীয়বার মাতৃহারা হলাম। আবার কথা বলতে গিয়ে কারও বা গলা ধরে এল…।
লোপামুদ্রা মিত্র (Lopamudra Mitra) মন্তব্য, "মানুষটির শরীর চলে গিয়েছে, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি থেকে যাবে সারা জীবন। ৯২ বছর বয়স হয়েছিল মানছি। কিন্তু ওঁর চলে যাওয়ার শূন্যতা কোনওদিন পূরণ হবে না।"
রূপঙ্কর বাগচি (Rupankar Bagchi) বললেন, "মা চলে যাওআর পর সন্তানের কাছে যে শূন্যতা তৈরি হয়, সেই শূন্যতাই তৈরি হল। আমি দ্বিতীয়বার মাতৃহারা হলাম। ওঁর গান-সুর, কণ্ঠ, আমার এই মুহূর্তে আরও বেশি করে মাথায় ঘুরছে। আমরা একটা সমুদ্রের জল ছুয়েছি মাত্র! আর উনি তো পার হয়ে গিয়েছিলেন। কোথাও হয়তো মা সরস্বতীর সঙ্গেই চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকর।"
মনোময় ভট্টাচার্যর কথায়, "বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আজকেই মা সরস্বতীর বিসর্জনের দিন। সেইদিনই আমাদের সরস্বতী ছেড়ে গেলেন আমাদের। খুব কষ্ট হচ্ছে। তবে যতদিন গোটা বিশ্ব আছে, লতা মঙ্গেশকরের সৃষ্টিও ততদিন থেকে যাবে।"
পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী (Ajay Chakraborty) স্মৃতির সরণিতে হেঁটে জানালেন, "লতাজির সঙ্গে আমার অনেক দিনের পরিচয়। ১৯৮১ সালে উনি যখন দাদাসাহেব পুরস্কার পান, আমি তখন সেরা পার্শ্ব পুরুষকণ্ঠের জন্য পুরস্কৃত হই। আমাদের দু'জনের মিল হচ্ছে, আমরা খুব ধীরে সুস্থে কথা বলি। সুরসম্রাজ্ঞী হয়েও উনি নিজে ভাবতেন, আমি তো সাধারণ গায়িকা মাত্র। তবে ওঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। কীভাবে মাইক্রোফেোন ধরতে হয় কিংবা শ্বাস আটকে গাইতে হয়, এই ২টো জিনিস ওঁর কাছ থেকে শিখেছি আমি। উনি হলেন সঙ্গীত-সরস্বতী। সংস্কৃত শ্লোকের অত সুন্দর উচ্চারণ…। আমি একমাত্র লতাজি আর শুভলক্ষ্মীর গানেই শুনেছি। আমার মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের সঙ্গে লতাজির অনেকবার দেখাও হয়েছে। পারিবারিক যোগ ছিল বলা যায়। কলকাতায় একবার ওঁর হাতে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পুরস্কার হাতে তুলে দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আর ওঁর বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের নামে যে পুরস্কার রয়েছে, সেটা উনি আমার এবং আমার কন্যা কৌশিকীর হাতেও তুলে দিয়েছেন। মুম্বইতে ওঁর বাড়িও গিয়েছি আমরা। আজ সেসব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।"
রশিদ খানও (Rashid Khan) স্মৃতিচারণা করলেন সেই দিনের, যেদিন গোয়ায় তাঁর গান শুনে সামনে এসে প্রশংসা করেছিলেন খোদ লতা মঙ্গেশকর। বললেন, "ওঁর বাবার নামে গোয়া অ্যাকাডেমীতে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। আমিও সেখানে পারফর্ম করছিলাম। যখন গাইছিলাম, লতাজি সামনের সারিতে বসে শুনছিলেন। আমার গান শেষ হতেই সামনে এসে উনি বললেন, 'আল্লা তালাহ নে ক্যায়া গলা দিয়ে হ্যায়..' আমি তখন উল্টে বললাম, দিদি আপনি এটা বলছেন! আমি তো আপনারই বড় ভক্ত। তখনই উনি বলছিলেন, আমি তো শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইতে চাইতাম, কিন্তু কোথায় ফিল্মে চলে এলাম।"
"লতা মঙ্গেশকরকে কাছ থেকে দেখার, কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। মানুষ চিরকাল থাকে না ঠিকই। কিন্তু উনি তো ছিলেন স্বয়ং দেবী সরস্বতী", বলছিলেন হৈমন্তী শুক্লা। দুর্গাপুরে একমঞ্চে গেয়েছিলেন একবার লতা-হৈমন্তী। সেখানেই নাকি হৈমন্তী শুক্লাকে বলেছিলেন, মঞ্চে গান গাইতে উঠলে নাকি এতদিন পরও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। আরেকবার গান গেয়ে এসে নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, "হৈমন্তী গান গাওয়া ঠিক হয়েছে তো?" এহেন কিংবদন্তী শিল্পীর এমন সাধারণ আচরণে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন হৈমন্তী শুক্লা।
ইন্দ্রাণী সেনের (Indrani Sen) মন্তব্য, "পঞ্চমী তিথি এখনও আছে, আর সেই তিথিতেই আমাদের সরস্বতীর বরপুত্রী চলে গেলেন। এত বছর ধরে আমাদের গান শুনিয়েছেন, শিখিয়েছেন, সেই মানুষটির চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছি না। আমাদের কোকিলকণ্ঠীর চলে যাওয়া আমাদের সঙ্গীতজগতের অপূরণীয় ক্ষতি। আমার বলার ভাষা নেই।"
"ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি লতাজি-ই মাবব-সরস্বতী। আমার কেরিয়ারে আমি কখনও ওঁর গান গাওয়ার সাহস করিনি। তবে অনেক অনুপ্রেরণা পেয়েছি ওঁর গান শুনে। সেটা কাজেও লাগিয়েছি। ওঁর গান যদি সারাদিন কেউ শোনেন তাহলেই তাঁর অনেকটা শেখা হয়ে যায়", বললেন জোজো।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন