প্রথমবার ছেলে উজান গঙ্গোপাধ্যায়কে পরিচালনা করলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। মানবতা বিকিয়ে দেওয়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে মেরুদণ্ড সোজা রাখার পরিণতি ঠিক কী হতে পারে? সেই উত্তর নিয়েই মুক্তি পেল 'লক্ষ্মী ছেলে'। কেমন হল? লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
কথাতেই আছে- 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর'। জন্ম জন্মান্তর ধরে এমন প্রবাদকে বেদবাক্য হিসেবে মেনে এসেছে সমাজ। সেই ধ্যান-ধারণা খণ্ডায় কার সাধ্যি? ধর্ম যেখানে পণ্যে পরিণত হয়েছে, সেখানে ঈশ্বর-দেবতাও পাটে ছোঁড়া পয়সার ঘায়ে ডরায়…! সমাজের বিধি মানলেই সে 'লক্ষ্মী ছেলে', আর বিধির বাম-গতি হলেই সে কুলাঙ্গার। ধর্মের দোহাই দেওয়া এমন সমাজে আসল-নকল 'লক্ষ্মী ছেলে-মেয়ে'দের বিচারদণ্ড থাকে কার হাতে? প্রশ্ন-জবাব দুটোই ছুঁড়েছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। বিবেক জাগ্রত করার দায় 'আধুনিক-উন্নত' সমাজের দর্শকদের।
ঋতুঃস্রাবে আচার ছুঁলে আচার-নিয়মের ব্যারাম ঘটে! ঠাকুর পাট ছোঁয়া তো নৈব নৈব চ! জাত-পাতের স্কেলে নিম্নবর্গীয় মাপ এলেই সেই দুয়ার মাড়ালে হায় হায়..। পাছে জাত যায়। অতিরিক্ত হাত,পা-ওয়ালা, কিংবা দু-পা জোড়া কোমরের নিম্নাংশ মৎসাকার ধারণ করলেই সেই সন্তান খোদ ঈশ্বর। কেউ বিষ্ণুর অবতার, কেউ বা দেবী লক্ষ্মীর! 'ঐশ্বরিক বস্তু' বলে সেই প্রাণ পরিণত হয় পণ্যে। অথচ, সেই মানুষটার কী জ্বালা! নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। শরীর খারাপ হওয়া চলে না। ও তো নিজেই ঠাকুর-দেবতা, ডাক্তারের প্রয়োজন আছে নাকি? আর সমাজের এমন মাথার ব্যামো যদি সারাতে আসে অন্য ধর্মের কোনও ব্যক্তি, তাহলে তো কথাই নেই। পরিণাম ভয়ঙ্কর। কীরকম? 'লক্ষ্মী ছেলে' আমির হুসেনকে দিয়েই দেখালেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।
পুরাণ অনুসারে দেব-দেবীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বাস্তব প্রেক্ষাপটকে আসলে মিলিয়ে দিতে শেখেননি ধর্মের কাণ্ডারিরা। ধর্ম-ঈশ্বরকে তাঁরা পুজিবাদের সঙ্গে মিশিয়ে ভয়ে পরিণত করেছে। এদিকে রক্ষক-ই যদি ভক্ষক হয়, তাহলে রুখে দাঁড়াতে আমজনতার ঘরে ঘরে 'লক্ষ্মী ছেলে'-মেয়েদের প্রয়োজন। সিনেমার গল্পেই শিখিয়ে দিলেন পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।
হিঙ্গলগঞ্জে চার হাত-ওয়ালা মেয়ের জন্ম হতেই আশেপাশের গ্রামে শোরগোল। ছুঁৎমার্গের দোহাই দিয়ে যে বাড়ির দুয়ারে পা রাখা তো দূর অস্ত আশপাশ দিয়ে ঘেঁষতেন না গ্রামের বাবুরা। পাছে জাত চলে যায়! যে নিম্নবর্গীয় মানুষেরা নিজেদের জীবনকে অভিশাপ বলে মনে করত। সে ঘরেই চার হাত-ওয়ালা কন্যাসন্তানের জন্ম হতে জাতে উঠল তারা। নাম রাখা হল 'লক্ষ্মী'। দাদু হল গ্রামের মাথা। আর গ্রামের প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের মুনাফা হয়ে উঠল লক্ষ্মী। 'লক্ষ্মী'র আশীর্বাদ নিতে আসা আশপাশের গ্রামের পুণ্যার্থীদের টাকায় ফুলে-ফেঁপে উঠতে লাগল গ্রামের মোড়লের ক্যাশবাক্স। ভোটে জেতার চাবিকাঠিও ছিল এই 'লক্ষ্মী'। তবে ভেস্তে যায় তিন জুনিয়র ডাক্তারের স্পর্ধার জন্য।
চিকিৎসা করিয়ে তাঁরা বাঁচান লক্ষ্মীকে। যার ইনাম-স্বরূপ মেলে একরাশ ঘৃণা, কটুক্তি, এমনকী ভয়ঙ্কর পরিণাম। কারণ? সেই জুনিয়র ডাক্তারদের একজনের নাম আমির হুসেন। হিন্দু দেবীজ্ঞানে পুজো করা সেই কন্যাকে কোন সাহসে কোলে তুলে বাঁচান মুসলিম যুবক? শুধু প্রশ্নের সম্মুখীন নয়, এমন স্পর্ধার মূল্যও চোকাতে হল আমিরকে।
আমিরের ভূমিকায় উজান গঙ্গোপাধ্যায় অনবদ্য। দ্বিতীয় ছবি হলেও অভিনেতা হিসেবে উজান এখানে অনেক পরিণত এবং পরিমিত। কোথাও অতি-নাটকীয়তার লেশমাত্র নেই। তাঁর দুই সঙ্গী ঋত্বিকা পাল ও পূরব শীল আচার্যও বেশ। তবে উজানের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন ইন্দ্রাশীষ রায়। নজর কাড়লেন প্রদীপ ভট্টাচার্য, চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায় ও অম্বরিশ ভট্টাচার্যরাও। ছোট্ট দৈর্ঘ্য হলেও স্বল্প পরিসরে বাবুল সুপ্রিয় যথাযথ। তবে সংলাপ বলার ক্ষেত্রে তাঁকে খানিক আড়ষ্ট মনে হয়েছে কিছু জায়গায়।
'লক্ষ্মী ছেলে'র মেদহীন চিত্রনাট্যের পাশাপাশি বিশেষভাবে প্রশংসার দাবিদার এই সিনেমার গান ও প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। একেকটা দৃশ্যের সঙ্গে আবহ সঙ্গীতের সঙ্গতে দুর্ধর্ষ টেনশন ক্রিয়েট করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। শেষপাতে বলতেই হয় যে, 'লক্ষ্মী ছেলে'দের 'ক্যাপ্টেন অফ দ্য শিপ' কৌশিক একটা মাস্টারপিস তৈরি করে ফেলেছেন প্রযোজকদ্বয় শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের হাত ধরে। প্রেক্ষাগৃহে সময় ও অর্থ কোনওটাই নষ্ট করবে না 'লক্ষ্মী ছেলে'।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন