আশির দশকের শেষের দিক। ১৯৮৮ সালে মুক্তি পেল অঞ্জন চৌধুরির পরিচালনায় 'ছোট বউ'। প্রেম-বিচ্ছেদ, সাংসারিক পলিটিকস, আদ্যপান্ত ফেমিলি মেলোড্রামা। মুখ্য চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও দেবিকা মুখোপাধ্যায়। সেই ছবি তো সুপারহিট। তবে রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গেলেন অঞ্জনের নায়িকা। তাই আজও দর্শকরা তাঁকে 'ছোট বউ' বলেই চেনেন। বছর খানেক আগে নরেন্দ্র মোদীর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু আজও টালিগঞ্জের পুরনো স্টুডিও পাড়াকে মনে-প্রাণে মিস করেন। কথপোকথনের মাঝে নিজেই জানালেন সেকথা। কেমন ছিল সেইসময়কার টলিপাড়া? স্মৃতির সরণিতে হেঁটে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার নতুন সিরিজ ‘পুরনো সেই দিনের কথা’য় নস্ট্যালজিক হয়ে পড়লেন দেবিকা মুখোপাধ্যায়। লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
শৈশবে 'ফরিয়াদ' সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ। কাজ করেছেন পরিচালক তপন সিনহার সঙ্গেও। সেটা ছিল 'বাঞ্ছারামের বাগান'। তবে 'ছোট বউ' তাঁকে যে জনপ্রিয়তা এনে দেয়, তা নিয়ে আজও উচ্ছ্বসিত দেবিকা মুখোপাধ্যায়। প্রসেনজিতের সঙ্গে তাঁর 'সোনার সংসার' ছবিও হিট হয়েছিল সেইসময়ে। তবে টলিউডের বাইরে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও সিনেমা করেছেন দেবিকা। সেটা আবার 'ছোট বউ'-এর আগে। ছবির নাম 'আনকাহি'। দুই নায়িকা- দেবিকা মুখোপাধ্যায় ও দীপ্তি নাভাল আর বিপরীতে অমল পালেকর। এরপর দীনেন গুপ্তর পরিচালনায় 'অবশেষে' নামে আরেকটি ছবি করেন দেবিকা, যেখানে তাঁর নাম সাজেস্ট করেন খোদ অমল পালেকর। নাতিদীর্ঘ ফিল্মি কেরিয়ারে সিনেমার সংখ্যা ৪০টি হলেও মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর মতো পরিচালকের সঙ্গেও কাজ করেছেন একটা সময়ে। সৈকত ভট্টাচার্যের 'দুলিয়া'র জন্য পুরস্কৃত হয়েছিলেন মস্কোয়। তবে বিয়ের পর লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের দুনিয়া থেকে খানিক বিরতিই নিয়েছিলেন।
একটা সময়ে সকাল হলেই শুটের তাড়া থাকত। কিন্তু যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন মুখের ভীড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন দর্শকদের প্রিয় 'ছোট বউ'। দেবিকার অভিযোগ, "এখনকার পরিচালক-প্রযোজকরা আমাদের জন্য কোনও চরিত্র-ই ভাবেন না। আর ভাবলেও, মনের মতো চরিত্র পাওয়া যায় না। আমাদের থেকে কমবয়সিরা এখন বয়স্কা মহিলার চরিত্রে অভিনয় করছেন। আমার ভাবতে খারাপ লাগে যে, আমি দেবিকা মুখোপাধ্যায় ইন্ডাস্ট্রিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য কোনও ভাল চরিত্র পাচ্ছি না!"
অভিনেত্রী জানালেন, এখনকার সিনে ইন্ডাস্ট্রি অনেক বেশি কর্পোরেট মনে হয় তাঁর কাছে। তাঁর কথায়, "তখন শুট করার সময়ে আমরা বেশ মজাও করতাম। পেশাদারিত্বের পাশাপাশি আমরা কিন্তু আত্মিক যোগ ভুলে যাইনি। অনেকবার এরকম হয়েছে সহ-অভিনেতারা যা খাওয়ার আবদার রেখেছেন, বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছি। মনে আছে, একটা সিনেমায় তাপসের (পাল) সঙ্গে অভিনয় করছি। ও সোজাসুজি বলে বসল- কাল লাঞ্চে কী আনছ? আমিও জিজ্ঞেস করলাম- যা খাবে, তাই আনব। তো তাপসের অর্ডার এল- পোস্তর বড়া, আলুপোস্ত চাই। আমি বললাম- একশোবার হবে, শুধু মাকে বলতে হবে। রান্নাটা জানতাম না, তাই অগত্যা মায়ের দ্বারস্থ হতে হত। আমাদের মধ্যে ওই কিন্তু-কিন্তু ব্যাপার ছিল না, যে ওকে বললে কী হবে, বা বলা যাবে কিনা! আমরা লাঞ্চ ব্রেকে একসাথে যখন খেতে বসতাম, সবাই মিলে ভাগ-বাটোয়ারা করে খেতাম। কখনও আমিও সবাইকে পরিবেশন করতাম। এসব দৃশ্য এখন আর ইন্ডাস্ট্রিতে দেখা যায় না।"
'ছোট বউ' ছবিতে অভিনয় করার পরই প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর প্রেমের গুঞ্জন রটে। তা নিয়েও আজও রসিকতা করেন অভিনেত্রী। বললেন, "বুম্বার চেহারার মধ্যে একটা প্রেমিক সুলভ ভাব ছিল, এবং প্রত্যেকটা রোম্যান্টিক সিনেমাতেই ওকে ভাবা হত। চিরঞ্জিৎকে না কিন্তু! প্রসেনিজিৎ ইজ প্রসেনজিৎ… খুব মিষ্টি ছেলে। কার কার সঙ্গে ওঁর নাম জড়ায়নি বলুন তো! অর্পিতা তো ক্ষেপে লাল হয়ে যাবে এসব শুনলে। পল্লবীও রেগে যাবে। বলবে আমার ভাইকে নিয়ে এসব বলছিস কেন? ওঁর সঙ্গে এখন অবশ্য দেখা হয় না। কোথাও কোনও শো থাকলে কদাচিৎ! বুম্বা দেখি প্রায়ই পুরনো দিনের অভিনেত্রীদের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে। আমার আক্ষেপ, ওঁর সঙ্গে আমার কোনও ছবি নেই!"
দেবিকা, তাঁর প্রজন্মের নায়িকাদের মধ্যে ‘ক্যাটফাইট’-এর অস্তিত্ব মানতেই নারাজ। অভিনেতা-অভিনেত্রী সকলের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। দেবশ্রী রায়ের সঙ্গেও একসময়ে বেজায় ভাল সম্পর্ক ছিল দেবিকা মুখোপাধ্যায়ের। সেই প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বললেন, "চুমকির সঙ্গে একটা সময়ে অনেক কথা হত। ইদানিং হয় না। ও জীবনে অনেক ওঠা-পড়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। চুমকি যখন ধারাবাহিক করা শুরু করল, আমি ভাবলাম ওঁর এই কাজটা আরও আগেই করা উচিত ছিল। কাজের মধ্যে রয়েছে, ওঁর যন্ত্রণা এখন হয়তো অনেক কম। আমার কুকুর যখন মারা গেল। সে কী মন খারাপ আমার। দেখলাম, চুমকি নিজেই আমার বাড়িতে পুরোহিত নিয়ে এসে শ্রাদ্ধ করাল পোষ্যের। এরপর আমি যখন বিজেপিতে যোগ দিলাম, ও তখন তৃণমূলে, সেইজন্যই হয়তো দূরত্ব তৈরি হল আমাদের মধ্যে।"
টলিউডের নবীর প্রজন্ম নিয়ে দেবিকার মন্তব্য, "আমরা মন থেকে অভিনয় করতাম। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখি, সংলাপও মুখস্থ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। খুব প্রাণহীন মনে হয়। সবাইকে একইরকম লাগে। সাজ-অভিনয় সবই এক। আমাদের সময় সবাই নিজস্বতা বজায় রাখত। আমি যেরকম চরিত্রে অভিনয় করছি, আরেক নায়িকার অনস্ত্রিন প্রেজেন্স কিন্তু আলাদা হত। আমাদের সময়কার নায়িকাদের মধ্যে যে ইমোশন ছিল, এখনকার নায়িকাদের অভিনয়ে সেটা ফুটে ওঠে না। আমরা গ্লিসারিন ছাড়াই কাঁদতাম। জীবনে হয়তো এমন কোনও দুর্ঘটনা যা নাড়া দেয়, সেই ঘটনার কথা ভেবে ক্যামেরার সামনে ঝরঝর করে চোখের জল ফেলেছি। এখনকার প্রজন্ম এরকম গভীরতা দিয়ে কি অভিনয় করে? সত্য কথা বলছি বলে হয়তো অনেকেই আমার ওপর রেগে যাবে! সেইসময়ে নায়িকাদের মধ্যে ক্যাট-ফাইটও ছিল না। আমি ভীষণ মিস করি আমাদের সময়কার বাংলা সিনে ইন্ডাস্ট্রিটাকে।"
"বর্তমানে সিনেমার কন্টেন্ট বদলেছে। পারিবারিক সিনেমা খুব কম হয়। আমাদের সময় পরিচালকরাও ভীষণ পার্টিকুলার ছিলেন। কোনও চরিত্রের জন্য কোনও একজন অভিনেত্রীকে উপযুক্ত মনে হলে, তাঁকে দিয়েই রোলটা করানো হত। এখন একজনের ডেট না পাওয়া গেলে অন্য নায়িকার কাছে প্রস্তাব যায়। প্রযোজকরাও কিন্তু পরিচালকদের সেই ছাড়টা দিতেন", বলছিলেন আট-নয়ের দশকের হিট নায়িকা।
দেবিকার আক্ষেপ, "আজও কোথাও গেলেই অনেকেই জানতে চান, আমি অভিনয় কেন করছি না? আমি ভাবি, বিগত ত্রিশ বছর পর্দায় মুখ না দেখিয়েও লোকেরা আমাকে দেখতে চাইছেন। আমার উত্তর দিতে কষ্ট হয়!"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন