৩ নম্বর ময়রা স্ট্রিটের বাড়ি। "বেনু, ফকিরবাবু এসেছেন চাল ভাজা নিয়ে।" আগতের চটজলদি জবাব, "ফকির তো বাবু হয় না।" এবার তিনি বললেন, "ফকির মাইনাসবাবু এসেছে।" এটা কোনও ছবি বা নাটকের সংলাপ নয়। তখন সপ্তাহের কোনও একদিন এই ঘটনাই ছিল বাস্তব। চালভাজা এবং নাড়ু নিয়ে মহানায়কের বাড়িতে পৌঁছে যেতেন মেমারির সেনগ্রামের ফকির দাস কুমার। নয় নয় করেও উত্তম কুমারের সঙ্গে ১৪টি বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেছেন ফকিরবাবু। আজ, মহানায়কের জন্মদিনে, এই ৮৬ বছর বয়সেও গড়গড় করে স্মৃতি রোমন্থন করে গেলেন। ওই অভিনেতার কথায়, "ওত বড় মনের মানুষ খুব কমই হয়। মহানায়কের মনটাও ছিল বিরাট।"
'জয়জয়ন্তী', 'বিকেলে ভোরের ফুল', 'রাতের রজনীগন্ধা', 'কায়াহীনের কাহিনী', 'দুই পুরুষ', 'মৌচাক' সহ ১৪টি ছবিতে উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। কখনও গামছা কাঁধে ফেলে ভৃত্যের অভিনয়, কখনও বা ওঝার চরিত্র। কেমন সম্পর্ক ছিল সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমারের? না বলার ছলেও অনেক কথা বলেও দিলেন ফকিরবাবু। অশীতিপর অভিনেতা বলেন, "ওঁদের দুজনের মধ্য়ে খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল। 'ছোটি সি মুলাকাত' ছবি করতে গিয়ে ২২ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছিল উত্তম কুমারের। সেই টাকার ঘাটতি মেটাতে সুপ্রিয়াদেবীর সঙ্গে নানা জায়গায় অনুষ্ঠান করেছিলেন উত্তমকুমার। একবার তো উত্তরপ্রদেশে 'লালপাথর' ছবির শুটিং করতে গিয়েছেন উত্তমবাবু। সেখানে ছিলেন বেনুদিও। হঠাৎ সেখানে গিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন উত্তমবাবুর স্ত্রী গৌরী দেবী। তখন দিল্লি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বেনুদিকে। রাগ করে যাওয়া গৌরী দেবী ফিরে যান কলকাতায়।" তিনি জানান, গৌরী দেবীকে গান শেখাতেন উত্তমবাবু। প্রেম করে বিয়েও করেছিলেন।
আরও পড়ুন: ‘উত্তম’ পোস্টারে সাজল ২০১৯ সালের ক্যালেন্ডার
আপনার সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল মহানায়কের? ফকিরবাবুর বলেন, "আমাকে খুব ভালবাসতেন। একবার হাজারীবাগে আউটডোর শুটিং চলছিল। ১৯৫৭-৫৮ সাল হবে। দাদার সঙ্গে প্রথম ছবি 'জয় জয়ন্তীতে' অভিনয় করছি। সেখানে এক বাগানবাড়িতে শুটিং হচ্ছে। হাজারীবাগ কলেজের একদল ছাত্র এসেছে অটোগ্রাফ নিতে। উত্তমকুমার প্রায় হাঁফিয়ে উঠেছেন। আমি বললাম, ম্য়ানেজ করে নেব। তারপর প্রায় ৩০০টি খাতায় আমরা পাঁচজন মিলে মহানায়কের অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম। তারাও খুশি হয়েছিল। উত্তমবাবুও স্বস্তি পেয়েছিলেন।" সেদিন রাতে উত্তমবাবু ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই বুদ্ধিটা কার? আমার বলতেই বললেন, "দারুন কুবুদ্ধি তো। ঠিক আছে।" আমাকে নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বললেন, তাঁর বাড়িতে যেতে। পরদিন শুটিং-এ ভিড়ও কেটে গেল।
"একবার দীঘাতে মাঝরাতে দুটি বাচ্চাকে নিয়ে বহু দূর থেকে গাড়ি ভাড়া করে একটি পরিবার হাজির আমাদের লজে। আমাকে এসে ভদ্রলোক বললেন, উত্তমকুমারকে দেখতে এসেছেন। তাঁর স্ত্রী উত্তমবাবুকে না দেখে এখান থেকে যাবেন না। মহানয়ককে একটিবার দেখবেন। অগত্য়া গিয়ে হাজির হলাম উত্তমদার ঘরে। এত রাতে আবার কী হল? জিজ্ঞেস করলেন মহানায়ক। বললাম, একবার দেখা দিতে হবে। বললেন, সারা দিন তো অনেকবার এসব হয়েছে, আবার এখন কেন? আমিও নাছোড়বান্দা। শেষমেষ তিনি এলেন, বাইরের বারান্দায়। তাঁকে দেখে শান্তি হল ওঁদের। তিনি ঘরে চলে গিয়েছেন, তবু দেখছি ওপরে তাকিয়ে আছেন ওই ভদ্রমহিলা।"
গ্রামের কেষ্ট যাত্রা দিয়ে অভিনয় শুরু করা ফকিরদাস বলেন, "এমন মানুষ আর পাওয়া যাবে না। স্টুডিওর গেট দিয়ে ঢোকার সময় থেকে মেক-আপ রুমে যাওয়া পর্যন্ত ডাইনে-বাঁয়ে সকলের সঙ্গে কথা বলেতেন তিনি। যেতে যেতে যার সঙ্গেই দেখা হত জিজ্ঞেস করতেন কি খবর। এত ভাল মনের মানুষ আর জন্মাবে না।" বলতে বলতে ৮৬ বছরের অভিনেতার চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। এক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ে। "না, আর কিছু বলব না। যত বলব তত মনে পড়বে। কষ্ট তত বাড়বে।"