গ্ল্যামারের হাতছানি। ঝকঝকে, চাকচিক্য জীবনযাপনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার মনোজগত। একের পর এক রহস্যমৃত্যু। পল্লবী দে, বিদিশা দে মজুমদার, মঞ্জুষা নিয়োগীদের মতো তরতাজা প্রাণ কেন অকালেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? ভাবিয়ে তুলছে সমাজকে। ব্যক্তিগত-পেশাগত জীবনের চাপে অনেককেই অবসাদ ঘিরে ধরছে। সেই প্রেক্ষিতেই 'ভাল থাকার, ভাল রাখার' বার্তা দিতে কলম ধরলেন সেই মানুষটি, যিনি নিজেও চার-চারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। আবার কঠিন সময়ের কান মলে জীবনে ঘুরেও দাঁড়িয়েছেন। সেই মীর আফসার আলি পজিটিভ থাকার পাঠ দিলেন।
যারাই অবসাদে ভুগছেন না কেন, সবার আগে তাঁদেরকে বলব, চুপ করে থাকবেন না। আমি কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখব না, কিংবা কথা বলব না, খাওয়া-দাওয়া করতে ইচ্ছে করছে না- এমন ভাবনা মাথা থেকে বাদ দিন। কারণ, হতাশায় ভোগার প্রথম লক্ষণ এটা। প্রায়শই অনেকে এগুলোকে এড়িয়ে যান। ব্যক্তিগতজীবনেও খুব কাছ থেকে দেখেছি যে, অবসাদগ্রস্থ মানুষেরা হয় খাওয়া বন্ধ করে দেন, নাহলে বিষয়টাকে ভুলে থাকার জন্য বিশাল পরিমাণে খাওয়া-দাওয়া শুরু করেন। সেক্ষেত্র বলব- যাই করুন না কেন, স্বজন কিংবা ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা খুব জরুরী। এখানে দাড়ি টানলে চলবে না।
যে কোনও কারণই হোক, প্রেম-সম্পর্কঘটিত কোনও বিষয় বা পেশাগত জীবনে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া, এহেন নানাবিধ সমস্যার জেরে অবসাদ ঘিরে ধরতে পারে। এইসময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে যে ভাবনা আসে, সেটা হল- কিছুতেই একা থাকা সম্ভব হচ্ছে না, কিংবা এই সমস্যাটা আর টানা যাচ্ছে না, অতঃপর চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়াই হয়তো যুক্তিযুক্ত হবে! অবসাদগ্রস্থ মানুষদের বিশেষ কিছু লক্ষণ রয়েছে। যেমন- তাঁরা না মনসংযোগ দিয়ে বই পড়তে পারেন, গান শুনতে পারেন, কিংবা একটানা কোনও সিনেমা বসে দেখতে পারেন। খুব ছোট ছোট কারণে বিরক্ত হয়ে যান, ভীষণরকম রাগের বহিপ্রকাশ ঘটান। এই বিষয়গুলো খেয়াল করলেই বাড়ির লোকরা সাবধান হয়ে যান। কেউ যদি একা থাকেন, তাহলে সেটা আলাদা বিষয়। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে থাকলে বাকি সদস্যদের বিশেষ করে নজর দেওয়া প্রয়োজন ওই অবসাদগ্রস্থ মানুষটির দিকে। কী সমস্যা হচ্ছে? সেই মানুষটির সঙ্গে কথা বলে জানা ভীষণ প্রয়োজন। কথোপকথন থামালে কিন্তু চলবে না। কারণ, বেশিরভাগ সময়েই হতাশায় ভোগা মানুষেরা নিজেরা গুম মেরে যান। খুব একটা ভিতরের কথা বলতে তাঁদের ইচ্ছে করে না। এমনকী কথা বলার ইচ্ছেও হারিয়ে ফেলেন অনেকে।
<আরও পড়ুন: অবাক লাগে মানুষ সুইসাইডের খবরেও হা-হা রিয়েক্ট করে: শ্রীলেখা>
অনেকসময় দেখা যায়, ভরসার কোনও মানুষের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা বিষয়টা খুলে বলতে পারেন। গুমড়ে মরার থেকে আমার মনে হয় নিজেকে ব্যক্ত করাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে বাড়ির লোকেরা তাঁকে কোনও মনোবিদের কাছে নিয়ে যেতে পারেন। আজও অনেকের ধারণা যে, মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া মানেই সেই মানুষটা হয়তো পাগল হয়ে গিয়েছেন! সমাজ খুব তাড়াতাড়ি এহেন তকমা দিতে ওস্তাদ। এইধরণের নেতিবাচক কথাবার্তা থেকে যেমন অবসাদগ্রস্থ মানুষটির দূরে থাকা প্রয়োজন, ঠিক তেমনই বাড়ির লোকেদেরও এড়িয়ে যাওয়া উচিত। অবসাদ-হতাশায় ভোগা মানুষদের আরও বেশি করে বন্ধুবান্ধব পরিবেষ্টিত হয়ে থাকা প্রয়োজন। কোনওভাবেই এঁদের একা থাকতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ, একাকীত্বে গ্রাস করলেই কিন্তু মানুষ এধরণের চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
আত্মহত্যার মতো বিষাদগ্রস্থ খবরগুলো যখনই শোনা যায়, তখনই যে কারো মনে হয়- একটু আগে যদি ওই মানুষটার খবরাখবর জানতে পারতাম, তাহলে হয়তো এমন পরিণতির শিকার হতে হত না। 'এই একটু আগের' ফারাকটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সময় থাকতেই অবসাদগ্রস্থ মানুষটির কথাবার্তা, চলন-বলন দেখে বোঝা উচিত চারপাশের মানুষদের। ভাবলেশহীন মানুষেরাই হয়তো একমাত্র বুঝতে পারবেন না। কিংবা এড়িয়ে যাবেন।
যে মানুষটি অবসাদগ্রস্থ, তার পক্ষে ঠিক-ভুল বিচার করা কঠিন। অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করে বসেন, "আরে তুমি তো বুদ্ধিমান, তুমি কেন সমস্যা বুঝতে পারছ না?" এসব যুক্তি-তক্কো তখন খাটে না। সে বুঝতে পারছে না বলেই তার সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। অবসাদ ঘিরে ধরলে সত্যি-সত্যিই মানুষ বুঝতে পারে না, তার জেরেই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চরম কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তাই এদের প্রতি যতটা সম্ভব সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন।
<আরও পড়ুন: পল্লবী কাণ্ডের পর মা-কে চিন্তা করতে বারণ করেন বিদিশা, তার পরেও মেয়ের ‘রহস্যমৃত্যু’>
বাড়ির লোকজন, বন্ধুবান্ধবদের খেয়াল রাখার পাশাপাশি, যিনি অবসাদে ভুগছেন, তাঁরও উচিত তিনি যেন মনের দরজা বন্ধ না করে দেন। তাহলে বাইরে থেকে কারও পক্ষেই তাঁকে সাহায্য করা সম্ভব হবে না। এছাড়া, অতিমারী-উত্তর পর্বে মানুষের মন-মানসিকতা অনেক বদলে গিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক থেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি। গোটা লকডাউন পিরিয়ডে অনেক মানুষের রোজগার বন্ধ গিয়েছিল। অনেকেই আবার গৃহবন্দি থেকে বাইরের মানুষদের সঙ্গে কথা না বলতে পেরে গুমড়ে গিয়েছিলেন। আমারও হয়েছিল। একটা সময়ের পর মানুষের নিজেকে আমোদিত করার ইচ্ছে থাকে না আর।
কঠিন সময় জীবনে আসবেই। চড়াই-উতরাই থাকবেই। তবে এই বিশ্বে সব সমস্যারই সমাধান থাকে। তাই চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা না ভেবে জীবনটাকে নতুন করে শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। যাঁরাই অবসাদে ভুগে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের একটাই কথা বলার- আবার নতুন করে বাঁচার কথা ভাবুন। বলা সহজ, তবে পাশে কেউ না থাকলে নতুন উদ্যমে শুরু করার তাগিদ আনা সত্যিই খুব কঠিন। কিন্তু চেষ্টা থামলে চলবে না। বাইরে গিয়ে হাওয়া বদল করে আসুন। এই সময়ে এমন একজন মানুষকে পাশে খুব দরকার, যে কোনও প্রশ্ন করবে না, কেন হল? কী হল? এসব বিচারসভা না বসিয়েই চুপচাপ মনের কথাগুলো শুনে যাবে। শরীরী ছোঁয়াও খুব প্রয়োজন। মা-বাবা, বন্ধু যে-ই হোক, কারও স্নেহের স্পর্শ ক্ষত সারাতে ভীষণ সাহায্য করে। কারও যদি আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে, দেরি না করেই অতি সত্ত্বর মনোবিদের কাছে পরামর্শ নেওয়া উচিত। একটা চেষ্টা, একটা প্রয়াস জীবন বদলে দিতে পারে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন