মাস খানেক আগে যখন কান চলচ্চিত্র উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে প্রথম সুসংবাদটি আসে, তখন বিশ্বাসই করতে পারেন নি মধুরা। ভেবেছিলেন কোনও ভুয়ো মেইল এসেছে বুঝি। তাই মেইল দেখে বন্ধ করে আবার নিজের কাজে মন দিয়েছিলেন। এবং কাছের এক বন্ধুর সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে মজাও করেছিলেন। শেষমেশ ভুল ভাঙল আইডবলুসিসি অর্থাৎ ইন্ডিয়ান উইমেন সিনেমাটোগ্রাফারস কালেক্টিভের থেকে ফোন পেয়ে।
মধুরা পালিত, কলকাতার মেয়ে। বাংলা বিনোদন জগতের তরুণতম এবং সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সিনেমাটোগ্রাফারদের অন্যতম মধুরা, এবছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে পেতে চলেছেন একটি বিশেষ পুরস্কার। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সদ্য সিনেমাটোগ্রাফিতে স্নাতক, যাঁদের বিগত দুই বা তিন বছর কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁদের মধ্যে থেকেই সেরাকে বেছে নেওয়া এবং তাঁকে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ দেওয়া এই পুরস্কারের লক্ষ্য।
আরও পড়ুন: হৃতিককে দেখেই অভিনয়ে আসা, আরেফিন জানালেন ‘চুপকথা’
''আমি তো মনে করেছিলাম সেই ফ্রড মেইলগুলোর মতো কিছু হবে যেখানে সেই প্রচুর টাকা পাওয়ার গল্প থাকে,'' বেশ হাসতে হাসতেই বললেন মধুরা। "আমি ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে এমন কিছু একটা হতে পারে। কয়েক দিন পরে আইডবলুসিসি থেকে যখন আমাকে বলল যে 'তুমি কেন মেইলের উত্তর দিচ্ছ না, আমরাই তো তোমার পোর্টফলিও পাঠিয়েছি', তখন আমি আবার ভাল করে পড়ে দেখলাম। আমার কাছে সত্যিই এটা অভাবনীয় ছিল। দ্বিতীয়বার ভাল করে মেইলটা পড়ার পরে বাবা-মাকে জানালাম।"
সিনেমা বোঝেন, ভালবাসেন অথবা কোনও না কোনওভাবে এই মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত, এমন সবার কাছেই ‘কান চলচ্চিত্র উৎসব’ অনেকটা পীঠস্থানের মতো। ‘কান’ মানেই সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সেরা ছবির সম্ভার, ‘কান’-এর পুরস্কার মানেই তা এই মাধ্যমের সবচেয়ে বিশিষ্ট প্রাপ্তিগুলির অন্যতম। মধুরার এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাংলা সিনেমা জগতের কাছে একটি গর্বের বিষয় তো বটেই, তা ছাড়াও আরও একটি কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
হলিউডের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছে যে ছবিগুলি, তার সবকটি মিলিয়ে যদি দেখা যায়, তবে মহিলা সিনেমাটোগ্রাফার রয়েছেন মাত্র তিন শতাংশ। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে ভারত যে খুব একটা পিছিয়ে রয়েছে, তা কিন্তু নয়। শুধুমাত্র আইডবলুসিসি নেটওয়ার্ক-এই রয়েছেন প্রায় ১০০ জন মহিলা সিনেমাটোগ্রাফার। তার মধ্যে ১০ থেকে ১২ জন বাঙালি। আবার এঁদের মধ্যে বেশির ভাগই এখনও ফিল্ম স্কুলের ছাত্রী। অর্থাৎ মোটামুটি ছবিটা দাঁড়াল এই যে এই মুহূর্তে টলিউডে পুরোপুরি পেশাদার মহিলা সিনেমাটোগ্রাফারদের সংখ্যা ১০-এরও কম।
মজার বিষয় এটাই যে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েও বাংলা বিনোদন জগতের বেশিরভাগ মানুষই ক্যামেরা হাতে একজন মহিলাকে দেখে চোখ কপালে তোলেন। লিঙ্গ বৈষম্য কতটা গভীরে গিয়েছে তা ধরা পড়ে মধুরার সঙ্গে কথোপকথনে, "প্রথম প্রথম খুব অদ্ভুত প্রশ্ন করত সবাই। সবচেয়ে অদ্ভুত প্রশ্ন হত, 'আচ্ছা, তুমি ক্যামেরাটা তুলতে পারবে তো?' ভাবখানা এমন যেন মেয়ে তো, অতটা কি আর শক্তি আছে?'' মজার ছলেই বলে চলেন, "তবে এখন আর খুব একটা এই প্রশ্ন শুনতে হয় না, অনেকগুলো কাজ দেখে নিয়েছে তো। আর একটা মজার ঘটনা বলি, একবার একজন এগজিকিউটিভ প্রোডিউসারের সঙ্গে কথা বলতে গেছি, অনেকক্ষণ ধরে দেখি, তিনি যা বলছেন তা আমার কাজের মধ্যেই পড়ে না, শেষমেশ আমি তাঁকে বললাম, 'আমি কিন্তু ডিওপি (ডাইরেক্টর অফ ফোটোগ্রাফি)', উনি তখন খুব লজ্জা পেয়ে বললেন, 'সরি, আমি ভেবে ছিলাম তুমি কসটিউম এডি'!''
কিন্তু এসব নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামান না মধুরা। ২৮ বছরের এই সদাহাস্যময়ী আক্ষরিক অর্থেই অত্যন্ত মধুর স্বভাবের মানুষ। শুটিং ইউনিট জমিয়ে রাখেন, রাগ করতে খুব কমই দেখা যায় তাঁকে। শুধু তাই নয়, তিনি সচেতন ভাবেই 'লো বাজেট' ছবির পৃষ্ঠপোষক। কান চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর কাজের যে পোর্টফলিওটি পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে বেশিরভাগ ছবিই ছিল কম বাজেটের, কিন্তু উৎকর্ষের দিক থেকে যে কোনও গড়পড়তা বাংলা ছবির চেয়ে অনেক উপরে।
মধুরার ছবিগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘ওয়াচমেকার’ (২০১৭), ‘আমি ও মনোহর’ (২০১৭), ‘সম্পূরক’ (২০১৮), ‘পেপার বয়’ (২০১৫) এবং একটি ভার্চুয়াল রিয়ালিটি শর্ট ফিল্ম, যা পুরোপুরি একটি নতুন মাধ্যমের কাজ। সারা পৃথিবীতে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ছবির সংখ্যা হাতে গোনা এবং অত্যন্ত গর্বের বিষয় হল, তার মধ্যে একটির সিনেমাটোগ্রাফি মধুরার।
''বড় বাজেটের ছবিতে কাজ করতে সবারই ভাল লাগে কিন্তু আমার মনে হয় আমি যেমন নতুন, তেমনই আরও অনেকেই তো প্রথম কাজ করছে, সবাই সবার পাশে দাঁড়ালে ভাল কাজ আরও বেশি হবে। তাই আমি ছবি বাছার সময় বাজেট নয়, বিষয়বস্তুর ওপর বেশি জোর দিই," জানালেন মধুরা। আপাতত তিনি প্রস্তুত হচ্ছেন মে মাসে কান পাড়ি দেওয়ার জন্য। মধুরাই দ্বিতীয় যিনি এই বিশেষ পুরস্কারটি পাবেন এবং ভারতের প্রথম।
কথায় কথায় উঠল প্রিয় অভিনেতাদের প্রসঙ্গ, ভবিষ্যতে তাঁর ক্যামেরার সামনে দেখতে চান কোন কোন তারকা অভিনেতাদের। ভিকি কৌশল, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি থেকে ইরফান খান, অনেকেরই নাম শোনা গেল। শেষে বললেন, ''আর একজনের কথা বলছি, সে আমার ক্যামেরার সামনে এলে বোধহয় মরেই যাব! হৃতিক রোশন!''