'মনে পড়ে রুবি রায়, কবিতায় তোমাকে একদিন কত করে ডেকেছি/ আজ হায় রুবি রায়, ডেকে বলো আমাকে, তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি..'।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে মুক্তি-পাওয়া গান। তবু আজও চিরনতুন। চিরসবুজ। সঙ্গীতপ্রিয় বাঙালির কাছে এ গানের আবেদনে এতটুকু আঁচড় কাটতে পারেনি সময়। বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাসে জনপ্রিয়তার নিরিখে চিরকালীন মাইলফলক এই গানের নেপথ্যকথাকে আজ ফিরে দেখা, 'মনে পড়ে রুবি রায়'-এর সুরকার এবং গায়ক রাহুল দেববর্মণের জন্মদিনে।
বাংলার সঙ্গীতজগতকে তোলপাড় করে 'রুবি রায়'-এর আত্মপ্রকাশ ১৯৬৯ সালের পুজোয়। আধুনিক বাংলা গানের সোনার সময় তখন। নামিদামি গায়ক-গায়িকারা তখন তাঁদের সে বছরের সেরা বাংলা গানগুলো তুলে রাখতেন 'পুজো-রিলিজ'-এর জন্য। সে হেমন্ত-মান্না-শ্যামল-সতীনাথ-কিশোরকুমারই হোন, বা লতা-আশা-সন্ধ্যা-উৎপলা-আরতি। গীতিকার-সুরকাররাও তাঁদের সেরাটা বাঁচিয়ে রাখতেন পুজোর জন্য। শ্রোতারাও বছরভর উন্মুখ হয়ে থাকতেন প্রিয় গায়ক-গায়িকার পুজোর গানের জন্য। যে গান 'হিট' করে যেত, মনে ধরত শ্রোতার, সেটাই সে বছর বাংলার পুজোমণ্ডপে বাজত একচেটিয়া।
ঠিক যেমনটা বেজেছিল 'মনে পড়ে রুবি রায়', আজ থেকে একান্ন বছর আগে, '৬৯-এর পুজোয়, বাঙালিকে আবেগের স্রোতে স্রেফ ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আর.ডি. বর্মণের এই গান। বাঙালির গলায় তখন চলতে-ফিরতে গুনগুন..'রোদ-জ্বলা দুপুরে, সুর তুলে নুপূরে, বাস থেকে তুমি যাবে নামতে/ একটি কিশোর ছেলে একা কেন দাঁড়িয়ে, এ কথা কি কোনোদিনও ভাবতে? মনে পড়ে রুবি রায়..'।
কিন্তু কে এই 'রুবি রায়', যাঁর আবেদন সংগীতপিপাসু বাঙালির মননে শিকড় গেড়ে রয়েছে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে? জানতে হলে ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরতে হবে এই গানের তৈরি-হওয়ার গল্পে। গানটা লিখেছিলেন শচীন ভৌমিক, ছয়ের দশক থেকে টানা প্রায় চল্লিশ বছর ধরে যিনি ছিলেন বলিউডের অসংখ্য সুপারহিট ছবির লেখক-চিত্রনাট্যকার। বক্সঅফিস-সফল যত হিন্দি ছবির গল্প বা চিত্রনাট্য লিখেছিলেন যে তালিকা করতে বসলে শেষ হবে না। ছয়ের দশকে 'আরাধনা', 'ব্রহ্মচারী', ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস', সত্তরের বছরগুলোয় 'ক্যারাভান', 'হাম কিসিসে কম নেহি', 'গোলমাল'। আটের দশকে 'কর্জ', 'বেমিসাল', 'কর্মা'। নব্বইয়ে 'ম্যায় খিলাড়ি তু আনাড়ি', 'কোয়লা', 'সোলজার', এবং আরও পরে এই শতকের প্রথম বছরগুলোয় 'কোই মিল গয়া' বা 'কৃশ'। ২০১১-য় মৃত্যুর কিছুদিন আগে পৰ্যন্তও সক্রিয়ভাবে বলিউডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শচীন ভৌমিক।
তা এই শচীন ভৌমিক মশাইয়ের সঙ্গে গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল রাহুল 'পঞ্চম' দেববর্মণের। ছয়ের দশকের মাঝামাঝির কথা বলছি, মুম্বইয়ের সংগীতজগতে যখন 'আর.ডি.-রাজ' শুরু হয়েছে স্বমহিমায়। একের পর এক হিট। যা ছুঁচ্ছেন, সোনা। বলিউডে সাফল্যের চূড়োয় থাকা সত্ত্বেও পঞ্চমের ভারি ইচ্ছে ছিল, পুজোয় বাংলা গানের একটা অ্যালবাম করবেন। শচীন ভৌমিককে অনুরোধ করেছিলেন একটা গান লিখে দিতে। মুম্বইয়ে একাধিক ছবির চিত্রনাট্য লেখার কাজে ব্যস্ত থাকায় শচীন বছরখানেক সময় পাননি বন্ধু পঞ্চমের অনুরোধ রাখার। সময় পেলেন '৬৯-এ, লিখলেন 'মনে পড়ে রুবি রায়'। সুর দিলেন এবং গাইলেন রাহুল দেববর্মণ স্বয়ং। বাকি ইতিহাস।
'রুবি রায়'-এর তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার পর গীতিকার শচীন ভৌমিককে একাধিক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এ গানের প্রেরণা কোথা থেকে এল? শচীন জানিয়েছিলেন, তাঁর নিজের জীবনের ব্যর্থ কিশোর প্রেমের স্মৃতিকে মাথায় রেখেই এই গানের জন্ম। যাঁকে ভালবেসেছিলেন কিশোরবেলায়, এবং প্রতিদানে পেয়েছিলেন প্রত্যাখ্যান, তাঁর নাম প্রকাশ্যে আনতে চাননি। নামটা বদলে করে দিয়েছিলেন 'রুবি রায়'। ভুলতে-না-পারা ওই প্রথম প্রেমের ক্ষতই এ গানের প্রসূতিসদন। ব্যর্থ প্রেমের আবহমান মনকেমন উঠে এসেছিল গানের ছত্রে ছত্রে... 'দীপ-জ্বলা সন্ধ্যায়, হৃদয়ের জানালায়, কান্নার খাঁচা খুলে রেখেছি/ পাখি সে তো আসেনি, তুমি ভালবাসোনি, স্বপ্নের জাল বৃথা বুনেছি... মনে পড়ে রুবি রায়...'
বাংলায় এ গান সোনা ফলিয়েছিল। তার ফসল তুলেছিল বলিউডও। 'রুবি রায়' প্রকাশ পাওয়ার চার বছর পর, ১৯৭৩-এ, সঞ্জীব কুমার-জয়া ভাদুড়ী অভিনীত 'অনামিকা' ছবিতে একই সুরে মজরুহ সুলতানপুরির কথায় রাহুল দেববর্মণ তৈরি করেছিলেন 'মেরি ভিগি ভিগি সি...'। ছবি মুক্তি পাওয়া মাত্রই সুপারহিট হয়েছিল 'মনে পড়ে রুবি রায়'-এর এই রিমেক। অনেকেই ভাবেন এখনও, 'মেরি ভিগি ভিগি সি'-র বাংলা বোধহয় 'রুবি রায়'। আসলে উল্টোটা। আগে 'রুবি রায়'। তার পথ ধরে চার বছর পর 'মেরি ভিগি ভিগি সি'।
মনে পড়ে রুবি রায়কে? না পড়ে উপায় আছে? কে ভুলবে রুবি রায়কে? যতদিন প্রেম থাকবে, প্রেমে প্রত্যাখ্যান থাকবে, রুবি রায়কে তো মনে পড়বেই বাঙালির। ভোলা সম্ভব কখনও?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন