আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি, ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, লাল টুকটুক লিপস্টিক মাখা ঠোঁট নেড়ে গান ধরেছেন নায়িকা, নায়কের চোখেমুখে প্রেমের উষ্ণতা...কিংবা হঠাৎ বৃষ্টি পেয়ে খুশিতে ডগমগ নায়িকা। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে গান ধরে বাড়ির উঠোনে নেচে উঠলেন নায়িকা, আড়াল থেকে নায়িকার সেই ‘ভিগা বদন’ দেখে পাগল হয়ে গেলেন নায়ক। আবার বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির ছাদে নায়কের ছবি হাতে নিয়ে নাচে-গানে নায়কের প্রতি ভালবাসার উত্তাপ ছড়ালেন নায়িকা। এমন বৃষ্টি ভেজা হাজারো রোম্যান্সের সাক্ষী সেলুলয়েড।
বৃষ্টি আর প্রেম যেমন একে অপরের পরিপূরক বলা চলে, তেমনই বৃষ্টি আর নায়িকা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আর তাইতো, যুগ যুগ ধরে বৃষ্টির গানে নায়কদের থেকে বেশি আধিপত্য দেখিয়ে আসছেন নায়িকারা। বলিউড তো বটেই মায় টলিউডেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বৃষ্টির গানে নায়িকাদের উষ্ণ উপস্থিতিকে বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন বাংলা সিনেমার পরিচালক-প্রযোজকরা। দর্শকরাও চেটেপুটে উপভোগ করেছেন সেসব বৃষ্টির গানের দৃশ্য।
কিন্তু বৃষ্টির গানের শুটিং করতে গিয়ে যা যা করতে হয়, তা মোটেই সুখের অভিজ্ঞতা নয়। বৃষ্টির গানের শুট করতে গিয়ে এক নায়িকা তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, কেউ কেউ আবার ঠান্ডা লাগিয়ে সর্দি-কাশি বাঁধিয়েছিলেন। এই ভরা আষাঢ়ে বৃষ্টির শুটিংয়ের সেইসব নানা অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন ঋতুপর্ণা, দেবশ্রী রায়, শতাব্দী রায়, ইন্দ্রাণী হালদার, কোয়েল মল্লিকরা।
একটা সময় ছিল, বাংলা বাণিজ্যিক ছবি মানেই ঋতুপর্ণা, আর ঋতুপর্ণা থাকা মানেই ছবিতে একটা বৃষ্টিতে গানের দৃশ্য থাকবেই। হ্যাঁ, টলিউডের এই হার্টথ্রব নায়িকাই বোধহয় বাংলা রুপোলি পর্দায় সবথেকে বেশি ভিজেছেন। বৃষ্টির গানের শুটিংয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই ঋতুপর্ণা বললেন তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতার কথা। ‘‘বৃষ্টি যে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা যায়, সেটাই আমার কাছে একরকম আশ্চর্য ব্যাপার ছিল। প্রথম যখন বৃষ্টির গানের দৃশ্যের শুটিং করতে যাই, তখন শুটিংয়ের জন্য বৃষ্টি তৈরি করা হচ্ছে, এটা আমার কাছে একটা নতুন আবিষ্কারের মতো ছিল। চারিদিকে বৃষ্টি পড়ছে অথচ বৃষ্টি হচ্ছে না।’’
src="https://www.youtube.com/embed/jFtvlRt3rfQ" width="100%" height="415" frameborder="0" allowfullscreen="allowfullscreen">
বৃষ্টির গানের দৃশ্যের শুটিং যদি বর্ষাকালেই হত কিংবা গরমে হত...আহা, তাহলে বোধহয় জমে যেত। এমনটা বোধহয় টালিগঞ্জের এই নায়িকাদের মনের কথা। অভিনেত্রী শতাব্দী রায় এ প্রসঙ্গে বললেন,‘‘যখন গরম থাকে, বৃষ্টি পড়লে ভাল লাগবে, তখন সাধারণত বৃষ্টির গানের শুটিং হয় না, সবসময়েই উল্টোটা হয়। আমার মনে আছে ‘শ্রীমান ৪২০’ নামে একটা ছবিতে একটা গানের শুটিং ৩১ ডিসেম্বর রাতে দিঘার সমুদ্রসৈকতে হয়েছিল। ওই কনকনে ঠাণ্ডায় সেদিন শুটিং করাই গেল না।’’ শতাব্দীর মতোই আরেক নায়িকা ইন্দ্রাণী হালদার বললেন,‘‘বৃষ্টির শুটিং বরাবর ঠাণ্ডার সময়েই হয়।’’ এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ ছবির কথা। ‘‘আমার মনে আছে, ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ ছবির শুটিং হয়েছিল ডিসেম্বর মাসে। সেদিন আবার ছিল শীতলতম দিন। ‘আরও একবার’ বলে আরেকটা ছবিরও বৃষ্টির দৃশ্য ডিসেম্বরে হয়েছিল। খুব কষ্ট হয়েছিল শীতকালে ওভাবে ভিজতে।’’
হ্যাঁ, বৃষ্টির গানের দৃশ্য যতটা মাখোমাখো হয়, ঠিক ততটাই কষ্ট করতে হয় নায়িকাদের। কনকনে ঠান্ডায় বৃষ্টির গানে শুট করার কথা বলতে গিয়ে ঋতুপর্ণা বললেন, ‘‘আমি প্রচুর বৃষ্টির গানে শুট করেছি। এজন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও বৃষ্টির গানে শুট করছি। আমার মনে আছে, একটা দক্ষিণী ছবিতে বৃষ্টির গানের শুটিংয়ে ঠান্ডায় এত কাঁপছিলাম যে আমাদের গরম দুধ আর হলুদ খাওয়ানো হয়েছিল। বৃষ্টির দৃশ্যে শুট করতে গিয়ে বহুবার শরীর খারাপও হয়েছে।’’ বৃষ্টির গানে শুটিং করতে গিয়ে শরীর বাঁচাতে ঋতুপর্ণার মতোই দুধ, মধু খেতেন শতাব্দী রায়ও। তিনি জানালেন,‘‘বৃষ্টিতে ১২-১৪ ঘণ্টা ধরে ভিজে ভিজে শুটিং করা খুব কষ্টের। বরাবরই বৃষ্টির গানের দৃশ্যে শুটিংয়ের জন্য কষ্ট হয়েছে। এজন্য দুধ, মধু খেয়ে থাকতাম। পা পিছলে কতবার যে ফ্লোরে পড়ে গিয়েছিলাম তার ইয়ত্তা নেই।’’ বৃষ্টির গানে শুট করতে গিয়ে অবশ্য এখনও অসুস্থ হননি কোয়েল। তবে মল্লিকবাড়ির এই কন্যা আবার বৃষ্টির গানের শুটিংয়ের জন্য নিজেকে ফিট রাখেন। কোয়েল বললেন, ‘‘সৌভাগ্যবশত বৃষ্টির গানে শুট করে আমার এখনও শরীর খারাপ হয়নি। বৃষ্টির শুটিংয়ের মাঝে মাঝে গরম জল খাই।’’ তাঁর ‘প্রেমের কাহিনী’ ছবির সেই হিট ‘রিমঝিম এ ধারাতে’ গানের শুটিংও যে ডিসেম্বরে কনকনে ঠান্ডায় হয়েছিল, সেকথাও বললেন নায়িকা। বৃষ্টির গানে শুট করতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন দেবশ্রী রায়। ‘‘প্যায়ার কা শাওন’ ছবিতে একটা সেমিক্ল্যাসিক্যাল গান ছিল বৃষ্টির উপর, সে গানের শুটিং করতে গিয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। কম্বল গায়ে জড়িয়ে থাকতে হয়েছিল শুটের মাঝে।’’
আরও পড়ুন, Happy Birthday R. D. Burman: জন্মদিনে সুরেলা শ্রদ্ধার্ঘ
বৃষ্টির গানের শুটিংয়ে কাদের ঝক্কি বেশি, নায়ক নাকি নায়িকার? প্রশ্ন শুনে দেবশ্রী রায় বললেন, ‘‘নায়িকাদেরই বেশি ঝক্কি পোহাতে হয়। বৃষ্টির মধ্যে লিপ মেলানো, নাচ ঠিক রাখা, মেকআপ, এক্সপ্রেশন ঠিক রাখা খুব কঠিন। নায়কদের তো সেরকম নাচের কোনও সুযোগ থাকে না।’’ এ প্রসঙ্গে দেবশ্রীর একসময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী শতাব্দী রায় বললেন,‘‘বৃষ্টির গানে নায়কদের থেকে নায়িকাদের পরনে কম পোশাক থাকে। তারপর নায়কদের থেকে নায়িকাদের চুল লম্বা হয়, ফলে তা শুকোতে দেরি হয়।’’
তবে কষ্ট যাই হোক, দর্শকদের কথা মাথায় রেখে সব কষ্ট যেন লাঘব হয়ে যায় টলিউডের এই নায়িকাদের। শেষপাতে তাই বৃষ্টির গান নিয়ে দেবশ্রী রায় বললেন, ‘‘আর কত রাত একা থাকব’ গানটা দর্শকদের এত ভাল লেগেছে, যে ওই গানের শুটিং করতে যা কষ্ট হয়েছিল, তা আর মনে হয়নি।’’ ইন্দ্রাণী, শতাব্দীরাও বললেন, ‘‘মানুষকে আনন্দ দিতে গিয়ে আমাদের কষ্ট হয়েছে।’’ টলিউডের লংটাইম সারভাইভার ঋতুপর্ণা বললেন, ‘‘বৃষ্টির গান বরাবরই ছবিতে একটা আলাদা সৌন্দর্য বজায় রাখে, আলাদা মাত্রা আনে।’’ ‘রিমঝিম এ ধারাতে’ গান দর্শকদের এত ভাল লেগেছে যে, সেই আনন্দে ডিসেম্বর মাসে কষ্টকর শুটিংয়ের কষ্ট যেন মনেই হয়নি কোয়েলের।