"তুমি তো আমার অ্যাঙ্গেল মেরে দিয়েছো হে! ছবি তোলো, ছবি তোলো।" পিঠ চাপড়ে বলা সত্যজিৎ রায়ের এই বাক্যটাই বদলে দিয়েছিল সেদিনের তরুণের ভবিষ্যৎ। বুধবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন সত্যজিতের জনপ্রিয় ফোটোগ্রাফার নিমাই ঘোষ। এদিন তাঁর প্রয়াণে ফিরে দেখা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা- কে দেওয়া শেষ সাক্ষাৎকার।
মানিকবাবু বলতে আপনার কী মনে পড়ে?
মনে পড়ে উনি শুয়ে আছেন। চারপাশে ওঁকে ঘিরে প্রচুর মানুষ। এইটুকুই। আমি তো আজও ওঁকে স্বপ্ন দেখি। এখনও মনে হয় উনি ডাকছেন, ''নিমাই! নিমাই কি এসেছে?'' কী জনেন, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তীতা, এসব আমি একজনের কাছ থেকেই শিখেছি। তিনি সত্যজিৎ রায়।
এই মুহুর্তে ভারতীয় সিনেমা রাজনৈতিক প্রচারমূলক হয়ে উঠছে জাতীয় স্তরে। একাধিক ছবির উপর কখনও নির্বাচন কমিশন, কখনও সুপ্রিম কোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। আমাদের রাজ্যে ছবি অজ্ঞাত কারণে হল থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন?
চূড়ান্ত অ্যানার্কির পরিস্থিতি। খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যে ছবির কথা আপনি বলছেন, তার পরিচালক আমার কাছেও আসেন। পরিচালক বলেছিলেন, কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি রয়েছে চারপাশে। তিনি তা নিয়ে মন্তব্য করায় তাঁর ছবিটা অজ্ঞাত কারণে সিনেমা হল থেকে তুলে নেওয়া হল। ছবিটা এখনও আমার দেখা হয় নি, তবে দেখে নেব। এসব করে লাভ কী হল, সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে তো ছবি দেখানোর আদেশ এসেই গেল।
আজ যদি মানিকবাবু থাকতেন, বিষয়টায় কীভাবে রিয়্যাক্ট করতেন? উনিও ইমার্জেন্সির সময়ে 'হীরক রাজার দেশে' বানিয়েছিলেন।
শুধু ছবিটা বানিয়েছিলেন তাই নয়, বিজলিতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে পাশে বসিয়ে ছবিটা দেখিয়েছিলেন। বন্ধু হওয়ার সুবাদে মানিকদাকে উনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ''এই ছবিটা তুই আমাকে দেখালি?'' এখন আর এই পরিস্থিতি নেই।
আপনি তো ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের সঙ্গেও কাজ করেছেন?
হ্যাঁ! মৃণালের সঙ্গে তিনটে ছবি করেছি। ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে একটা। অপর্ণা সেনের সঙ্গেও কাজ করেছি।
মৃণাল সেনের শেষযাত্রায় গিয়েছিলেন?
আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু অত বিখ্যাত মুখ তো নই, আর চেহারাও বদলে গিয়েছে। অনেকে বুঝতে পারেন নি।
আপনি তো এত সম্মান পেয়েছেন...
(কথা কেটে) কই এত সম্মান? ভারত সরকার কেবলমাত্র পদ্মশ্রী সম্মান দিয়েছেন। রাজ্য সরকার কোনও কালেই এগিয়ে আসেনি। কেবলমাত্র ভোটের সময় আসে।
তাই নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে?
না! আক্ষেপ কেন থাকবে? তবে এক লক্ষর উপরে ছবি রয়েছে। সেগুলো কোনও সরকারই সংরক্ষণের ব্যবস্থা করল না। একটা আর্কাইভ বানাতে পারছি না, কেউ এগিয়ে এল না, এটাই যা আক্ষেপ।
কিন্তু আক্ষেপের সুরেই আপনি বলেছিলেন সংরক্ষণের ব্যবস্থা না হলে আপনি গঙ্গার জলে সব ভাসিয়ে দেবেন।
হ্যাঁ! একটি সাক্ষাৎকারের শেষে কথাটা বলেছিলাম। এখনও তাই বলছি। আমি ভেবেছি, কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোনোরকম উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিদেশ থেকে অনেক রকম উদ্যোগ নিয়েছে, সেই চিন্তা থেকে অনেক নেগেটিভ দিল্লীতেও পাঠিয়েছি, কিন্তু কই সেরকম কিছু চিন্তাভাবনা ওরাও করেনি। এখনো বলছি, ছবিগুলোকে সংরক্ষণ না করলে গঙ্গার জলেই ফেলে দেব।
এখনও ছবি তুলছেন?
হ্যাঁ, তবে অ্যানালগে। একমাত্র বিকাশ বোস আছেন যিনি এখনও ছবি ওয়াশ করেন। উনি যতদিন থাকবেন ছবি তুলব, তারপর জানি না।
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ছবি তুলবেন ভেবেছিলেন?
নাহ, একদমই ভাবি নি। (হেসে) উনিই তো আমার জীবনটা শেষ করে দিলেন। আমার ফটোগ্রাফার হওয়ার ইচ্ছাই ছিল না, 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' ছবির সেটে প্রথম ছবি তুলি। সেটা দেখে তিনি বলেছিলেন, "তুমি তো আমার অ্যাঙ্গেল মেরে দিয়েছ।" অবশেষে 'সিকিম' ডকুমেন্টারির পর সিদ্ধান্ত বদলে দিই।
আজকাল প্রত্যকের হাতে মোবাইল, ডিজিটাল ক্যামেরা। সবাই নিজেদের ছবি দিচ্ছে। এই সামগ্রিক বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখেন?
এটা নিয়ে আমার খুব একটা কিছু বলার নেই। সবাই আজকাল ডিএসএলআর-এ ছবি তুলতে স্বচ্ছন্দ। অন্যালগ শিখতে যাঁরা আসেন, সবাই বিদেশ থেকে। এখানে খুব বেশি উৎসাহ দেখি না। (তারপর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ফোটোগ্রাফারের দিকে তাকিয়ে) আপনার হাতেও তো ডিজিটাল ক্যামেরা নাকি!
মানিকবাবুর কোন অপূর্ণ ইচ্ছে যা আপনি জানেন...
সে তো অনেক কিছুই ছিল। উনি থাকলে হয়তো আরও অনেক কিছু পেতে পারতাম। সেগুলো হলো না। সত্যি কথা বলতে, মানিকদা যে নেই, এখনও আমার মনে হয় না। এই তো সেদিও 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'-এর প্রদশর্নীতে গিয়েছিলাম। ওটা হাতেখড়ি তো!
তিনটে নাম বলছি। আপনি তাদের কীভাবে দেখেন?
সত্যজিৎ রায়...
সবকিছু
ঋত্বিক ঘটক...
ইনডিসিপ্লিনড
মৃণাল সেন...
সবকিছু নয়, তবে বন্ধু