Bengali Television: শিল্পীরা শ্যুটিং করেছেন। কলাকুশলীরাও তাঁদের কাজটুকু করেছেন। শ্যুটিংয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের দায়িত্বে যাঁরা, তাঁরাও তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ধারাবাহিকের এপিসোড তৈরি হয়েছে, নির্দিষ্ট চ্যানেলে নির্দিষ্ট সময়ে সেই এপিসোড সম্প্রচার হয়েছে। দর্শক দেখেছেন। কেউ বাহবা দিয়েছেন, কেউ বা বলেছেন ধারাবাহিক দেখার কোনও মানে হয় না। কিন্তু মোদ্দা কথা হল সম্প্রচার হয়েছে, মানুষ দেখেছেন। অথচ তার পরেও অভিনেতা-অভিনেত্রী-কলাকুশলীরা তাঁদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক পাননি।
সম্প্রতি আবারও বাংলা টেলিপাড়ায় ঘনিয়ে উঠেছে বকেয়া টাকা নিয়ে অসন্তোষ। শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নন, টেকনিসিয়ানরাও বকেয়া টাকা উদ্ধার নিয়ে অত্য়ন্ত চিন্তিত। একাধিক প্রযোজকের বিরুদ্ধে পারিশ্রমিকের টাকা বকেয়া রাখার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠছে প্রযোজক রানা সরকারের বিরুদ্ধে। প্রাপ্য় পারিশ্রমিক ঠিক কবে পাওয়া যাবে, এখনও তার কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি বলেই জানিয়েছেন বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী।
আরও পড়ুন: রাতারাতি ‘হাত বদল’ চার ধারাবাহিক, লক্ষ্য করেছেন?
বাংলা টেলিজগতের এই পরিস্থিতি নতুন নয়। কখনও দু'মাস, তিনমাস পরে পারিশ্রমিকের টাকা মেলে। এই অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষার সংস্কৃতি পাল্টাবে এমনটাই ভাবা গিয়েছিল ২০১৮ সালের মাঝামাঝি যখন পাঁচদিন শ্যুটিং বন্ধ থাকে টেলিপাড়ায় এবং বেশ কিছু ধারাবাহিকের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায় এপিসোড ব্য়াংকিংয়ের অভাবে। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে অচলাবস্থা কাটে। ওই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেন যে প্রতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্য়ে তার আগের মাসের বকেয়া টাকা মিটিয়ে দিতে হবে।
আর্টিস্ট ফোরাম, টেকনিশিয়ান্স গিল্ড, প্রোডিউসার্স গিল্ড-সহ বিনোদন জগতের মোট ২৪টি গিল্ডের মাথা, ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ানস অ্য়ান্ড ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া। ওই ফেডারেশন ও তার তত্ত্বাবধানে থাকা বাকি সমস্ত সংগঠনগুলির প্রতি এমনটাই নির্দেশ ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। অথচ তার পরেও বেশ কিছু প্রযোজকের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সময় টাকা বাকি রাখার অভিযোগ উঠেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে জোরালো অভিযোগ 'দাগ সি মিডিয়া'-র কর্ণধার, প্রযোজক রানা সরকারের বিরুদ্ধে। ২০১৭ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে তিনটি চ্য়ানেলের মোট পাঁচটি স্লটের ধারাবাহিকের প্রযোজনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে স্টার জলসা-র 'আমি সিরাজের বেগম', জি বাংলা-র 'জয় বাবা লোকনাথ', কালারস বাংলার 'মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য', 'প্রথম প্রতিশ্রুতি' ও 'খনার বচন'।
এর মধ্য়ে 'প্রথম প্রতিশ্রুতি'-র শ্যুটিং মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাকি চারটি ধারাবাহিক আপাতত হাত বদল হয়ে চলে গিয়েছে অন্য় প্রযোজকদের তত্ত্বাবধানে। এই হাতবদল ঘটেছে মার্চ মাসের মাঝামাঝি। গত বছর মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে, প্রত্য়েক প্রযোজকের সঙ্গেই ফেডারেশন ও আর্টিস্ট ফোরামের মধ্যস্থতায় একটি বোঝাপড়ায় আসেন শিল্পী ও কলাকুশলীরা। কথা ছিল যে ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই ২০১৮ সালের যাবতীয় বকেয়া টাকা মিটিয়ে দেওয়া হবে। রানা সরকারের পাঁচটি ধারাবাহিকের শিল্পী-কলাকুশলীদের অধিকাংশেরই অভিযোগ যে ফেব্রুয়ারি মাসে সেই বকেয়া টাকার পেমেন্ট হয়নি।
এই নিয়ে ক্রমশ অসন্তোষ বাড়তে থাকায় শেষ পর্যন্ত মার্চের মাঝামাঝি স্টার জলসা-র আমি সিরাজের বেগম, জি বাংলা-র জয় বাবা লোকনাথ, কালারস বাংলার 'মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য' ও 'খনার বচন'-- এই চারটি ধারাবাহিককে হস্তান্তরিত করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ ১৬ মার্চ থেকে ওই চারটি ধারাবাহিকের প্রযোজনার দায়িত্বে আর নেই দাগ সি মিডিয়া। শোনা গিয়েছে, মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকেই ফোন ধরা বন্ধ করে দেন প্রযোজক। বিগত এক মাস হল তাঁকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি। অনেকের বক্তব্য়, তিনি কলকাতার বাইরে আছেন, আবার অনেকের বক্তব্য, তিনি কলকাতাতেই আছেন কিন্তু সম্ভবত নিজের বাড়িতে থাকছেন না।
যেহেতু বাংলা টেলিজগতের সাম্প্রতিক বিজনেস মডেল অনুযায়ী, নির্দিষ্ট চ্য়ানেলই ধারাবাহিকের স্বত্বাধিকারী, তাই এই হস্তান্তরটি ঘটে তিনটি চ্য়ানেল কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে। এই গোটা প্রক্রিয়াটি ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের জ্ঞাতার্থেই ঘটে, এমনটাই জানা গিয়েছে। ওই চারটি ধারাবাহিকের একাধিক অভিনেতা-অভিনেত্রী জানিয়েছেন, নিয়ম অনুযায়ী ১৬ মার্চের আগে পর্যন্ত তাঁদের যা যা বকেয়া টাকা রয়েছে তা মিটিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব প্রাক্তন প্রযোজকেরই। কিন্তু যেহেতু তাঁর কোনও নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না, তাই পেমেন্ট উদ্ধারের দায়িত্ব বর্তায় ফেডারেশনের উপর।
হস্তান্তরের সময় মিটিংয়ে ঠিক করা হয়েছিল যে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বকেয়া মেটানো হবে ১৫ এপ্রিলের মধ্য়ে। আর ১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত যা বকেয়া রয়েছে, তা মেটানো হবে ১৫ মে-র মধ্য়ে। কিন্তু আজ, ২৮ এপ্রিলের আপডেট অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত কোনও টাকা পাননি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। ফেডারেশন পেমেন্ট উদ্ধার করবে এবং আর্টিস্ট ফোরামের মাধ্যমে তা শিল্পীদের কাছে পৌঁছে যাবে, এমনটাই শোনা গিয়েছিল।
অভিনেত্রী লাবণী ভট্টাচার্য, যিনি 'আমি সিরাজের বেগম' ও 'জয় বাবা লোকনাথ', দু'টি ধারাবাহিকেই অভিনয় করেছেন বা করছেন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে জানিয়েছেন যে তাঁর সাত মাসের পেমেন্ট বাকি। অভিনেত্রী রূপা ভট্টাচার্য জানিয়েছেন তাঁর নভেম্বর মাস থেকে পেমেন্ট বকেয়া রয়েছে। তালিকায় রয়েছেন বাদশা মৈত্র, সৌমিলী বিশ্বাস, দেবদূত ঘোষের মতো টেলিপাড়ার তুলনামূলক সিনিয়র অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও। প্রত্য়েকেরই কয়েক লক্ষ টাকা বাকি রয়েছে। ঠিক সময়ে পেমেন্ট না পেয়েও ধারাবাহিক সম্প্রচার অক্ষুণ্ণ রাখতে তাঁরা কাজ করে গিয়েছেন।
শিল্পীদের বকেয়া টাকা উদ্ধার, বিপদে-আপদে সাহায্য বা কাজের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সুবিধা-অসুবিধার দিকটি দেখে, শিল্পীদের সংগঠন আর্টিস্ট ফোরাম। তাই ১৫ এপ্রিল পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন বকেয়া টাকা পাওয়া যায়নি, তখন ফোরামের কাছে ২৩ এপ্রিল একটি মাস পিটিশন ফাইল করেন দাগ সি মিডিয়া-র বিভিন্ন ধারাবাহিকের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। এই পিটিশনের ভিত্তিতে আগামী ১ মে, আর্টিস্ট ফোরামের কার্যনির্বাহী সভাপতি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্য়ায়ের উদ্যোগে একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। যেহেতু আর্টিস্ট ফোরাম সিনে ফেডারেশনের অন্তর্গত, তাই এই মিটিংয়ে ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসও উপস্থিত থাকবেন, এমনটাই শোনা গিয়েছে। পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন যাঁরা সেই সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একাংশ ওই সভায় অংশ নেবেন বলে জানা গিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, এই সভায় কি পাওয়া যাবে সমাধান সূত্র? রূপা ভট্টাচার্য জানালেন, ''এখনও পর্যন্ত সংগঠনের তরফ থেকে কোনও অফিসিয়াল কমিটমেন্ট আমাদের করা হয়নি। আমরা প্রচণ্ড বিপন্ন। আর্টিস্ট ফোরাম বরাবরই আর্টিস্টদের ব্য়াপারে যতবার লড়াই করেছে, জিতেছে। আমার ভরসা আছে বুম্বাদার উপরে। অরিন্দমদা, সপ্তর্ষিদা এবং বাকি সমস্ত যাঁরা রয়েছেন বিভিন্ন পদে, সাথে রয়েছে এগজিকিউটিভ কমিটি, সাথে রয়েছে ফেডারেশন যাঁরা ২৪টি গিল্ডের মাথার উপরে রয়েছেন। সবটা মিলিয়ে আমি বিশ্বাস করছি, আর্টিস্ট-টেকনিসিয়ানদের বকেয়া টাকা তাঁরা উদ্ধার করে দেবেন। কারণ ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও অসৎ মানুষ এসে আমাদের টাকা মেরে দেবেন, আর সেখানে বুম্বাদার মতো মানুষেরা সেটা অ্য়ালাও করবেন, সেটা কখনোই হয়নি, কোনও দিনও হবে না। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের পেমেন্ট উদ্ধার হবে, এটা আমার ভরসা, এটা আমার বিশ্বাস।''