তাঁর জন্মদিন ঠিক কবে তা কেউ ঠিক করে জানাতে পারেনি। কিন্তু প্রতি বছর কবিগুরুর জন্মদিনেই তাঁরও জন্মদিন পালন হয়। এবছর পঁচিশে বৈশাখ ৮৮ বছরে পা দিলেন ভারতীয় মাইম শিল্পের পথিকৃৎ যোগেশ দত্ত। অশীতিপর এই মানুষটির জন্মদিন কীভাবে হল পঁচিশে বৈশাখ সেকথা সোশাল মিডিয়ায় জানালেন তাঁর মেয়ে প্রকৃতি দত্ত।
১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিফিউজি হয়ে কলকাতায় এসে পৌঁছন যোগেশ দত্তের পরিবার-পরিজন। কিছুদিন পরেই বাবা-মা-কে হারান তিনি। চায়ের দোকানে কাজ করে, মুদির দোকানে কাজ করে, কখনও কন্স্ট্রাকশন সাইটে কাজ করে জীবনধারণ করেছেন। সেই সময় জন্মদিন পালন নেহাতই বিলাসিতা ছিল। আর তিরিশ-চল্লিশ দশকে জন্মদিন নয়, জন্মতিথি মনে রাখার চল ছিল। সেটাও আবার অনেকে ঠিক মনে রাখতে পারতেন না। যোগেশ দত্তের দিদিও তাই ঠিক মনে রাখতে পারেননি। তাই গুরুদেবের জন্মদিনেই নিজের জন্মদিন পালন করতে শুরু করেন তিনি।
আরও পড়ুন: অনুমতি না নিয়েই সুর রবির কবিতায়! সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁরই হাত ধরে
শিল্পীর মেয়ে প্রকৃতি দত্ত ৮ মে তাঁর সোশাল মিডিয়া পোস্টে জানিয়েছেন যে এবছর ৮৮ বছরে পা দিয়েছেন ভারতীয় মাইমের এই কিংবদন্তি। ভারতীয় মূকাভিনয়কে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়া এই শিল্পী ১৯৭৫ সালে শুরু করেন 'যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমি'। আজ এই প্রতিষ্ঠানের স্বমহিমায় এগিয়ে চলেছে। বিপুল সেই কর্মকাণ্ডের অংশীদার তাঁর মেয়েও।
বাবার এই পঁচিশে বৈশাখ জন্মদিন পালন নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় তিনি লিখেছেন--
আজ ৮৮ বছরে পা দিলেন বাবা। উদ্বাস্তু, অনাথ বাচ্চাদের জন্মদিন কেউ মনে রাখে না। তাঁর ক্ষেত্রেও তাই। বাবারা, পাঁচ ভাই, এক বোন। সব চেয়ে বড় দিদি। বাবা কবে জন্মেছে তা পিসিই একমাত্র জানত। জিজ্ঞাসা করলে বলত, "আরে যেইবার ঝড়ে মন্টুদের তাল গাইসটা পইড়্যা গেল সেইবার ভোলা হইল।" তাতে এইটুকু বুঝতাম যে বাবা ঝড় মাথায় নিয়ে হাজির হয়েছিল। কিন্তু তার পরে খাতায় কলমেও তো একটা জন্মদিন দরকার । তাই আজকের এই তারিখটা ধার্য করেছিল বাবা নিজেই।
পরে বড় হয় পুরো ইতিহাসটা জানার পর আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, আউট অফ অল ডেটস, এই 'হেভি ডিউটি' তারিখটাই তোমার পছন্দ হল? তাতে বাবা হাসতে হাসতে বলেছিল, "আরে, যোগেশ দত্ত বলে এই লোকটাকে যে আদৌ কেউ কোনদিনও চিনবে স্বপ্নেও ভাবিনি বুঝলি। আর, তারপর যখন দু চারজন চিনল তখন আরো ভালোই হল। কারণ তখন জন্মদিনের সেলিব্রেশন মানে এই নাচ, গান,কবিতা, নাটক সবই গুরুদেবের কল্যাণে ফ্রিতেই হতে থাকল। তাই যাকে বলে বুঝলি গুরুদেবের দয়াতেই এই জীবনটা পার হয়ে গেল।"
সেই ষাট-সত্তরের দশক থেকেই মূকাভিনয় শিল্পকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন যোগেশ দত্ত। চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা। একলব্যের মতোই সাধনা করে নিজেকে তৈরি করেছিলেন তিনি। আর মাইম-এর বিষয়বস্তু খুঁজে পেয়েছিলেন দৈনন্দিন জীবন থেকেই। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ-প্রতিবাদ উঠে এসেছে তাঁর মূকাভিনয়ে। তাই যোগেশ দত্তের মাইম বিশ্বের দরবারে পৌঁছে গিয়েছিল অনায়াসেই। পৃথিবীর বহু দেশে পারফর্ম করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আফগানিস্তান-- পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাঁকে সম্মানিত করেছে, তাঁকে নিয়ে বহু বিদেশি তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে। এদেশেও ১৯৮৩ সালে ফিল্মস ডিভিশন একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে। ১৯৯৩ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারে তাঁকে সম্মানিত করা হয়।
এই অশীতিপর মানুষটি এখনও তাঁর অ্যাকাডেমির নিত্যদিনের কাজের সঙ্গে জুড়ে থাকেন। তাঁকে বলা হয় 'সাইলেন্ট পোয়েট' কারণ তাঁর পারফরম্যান্সগুলি কবিতার মতো মনে হতো দর্শকের। তিনি এখনও নীরবে নিভৃতেই থাকতে ভালবাসেন।