প্রেম মানুষকে সব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে। তার অন্তরের আলোকে ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। যে সময় মানুষ শৃঙ্খলবদ্ধ সারা পৃথিবীতেই, যে সময় বাধ্য করছে মানুষকে বেশি করে একা থাকতে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে রাম কমল মুখোপাধ্যায়ের ছবি 'সিজনস গ্রিটিংস' অনেকটা মিষ্টি সান্ধ্য বাতাসের মতো। সম্প্রতি জিফাইভ-এ মুক্তি পেয়েছে প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ এই ছবি, যা বলে শূন্য জীবনে প্রেম ভরিয়ে নেওয়ার সমানাধিকারের কথা।
ঋতুপর্ণ ঘোষের সব ছবির কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে সম্পর্ক। এক ছবি থেকে আর এক ছবিতে, এক দৃষ্টিকোণ থেকে আর এক দৃষ্টিকোণে তিনি অবিরত প্রেমকে দেখেছেন। মা-মেয়ের ভালবাসা, মনে লেগে থাকা প্রাক্তনের অনুরাগ অথবা কোনও আগন্তুকের অচেনা ক্যানভাসে হঠাৎ প্রেমের রং লেগে যাওয়ার কথা এসেছে। পরিচালকের বেশিরভাগ ছবিতেই প্রেম ছাপিয়ে গিয়েছে মানুষকে। যে পৃথিবীতে তাঁর চরিত্রদের বাস, সেখানে প্রেম অনেকটা চিরস্রোতা নদীর মতো। তাই বার বার ভাঙা হৃদয় নিয়ে চরিত্রেরা উঠে দাঁড়ায়, বার বার তাদের উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করেন ঋতুপর্ণ।
আরও পড়ুন: ‘মানুষ ভাল নেই, প্রকৃতি ভাল আছে’, রইল দুই পরিচালকের দু’টি ছোট ছবি
ঠিক এই দর্শনেই সম্পৃক্ত রাম কমল মুখোপাধ্যায়ের ছবি 'সিজনস গ্রিটিংস: আ ট্রিবিউট টু ঋতুপর্ণ ঘোষ'। প্রায় বছরখানেক আগে এই ছবির ঘোষণা করেন লেখক-পরিচালক। ঠিক কী কারণে 'সিজনস গ্রিটিংস' প্রয়াত পরিচালকের প্রতি একটি শ্রদ্ধার্ঘ তা ছবির প্রথম দৃশ্য থেকেই স্পষ্ট। নব্বইয়ের শেষে ও মিলেনিয়ামের প্রথম দশকে যখন বাঙালি ও ভারতীয়রা ক্রমশ ভেসে যেতে থাকছে গ্লোবালাইজেশনে; প্রযুক্তির বাড়াবাড়িতে কেমন চাপা পড়ে যেতে থাকছে হাত থেকে হাতে, বুক থেকে বুকে ভালবাসার নিষিদ্ধ ইশতেহারের প্রচার, তখন বার বার সম্পর্কের আবেগকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ।
রাম কমল মুখোপাধ্যায়ের এই ছবির গল্পেও রয়েছে তেমনই আবেগের উদযাপন। পাশাপাশি রয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও ব্যক্তিগত চয়েস-এর গুরুত্বের প্রসঙ্গ। ছবির গল্প এক মা ও তার মেয়েকে নিয়ে, যে দুটি চরিত্রে রয়েছেন লিলেট দুবে ও সেলিনা জেটলি। দুজনেই নির্বাসিত তাদের নিজের নিজের জগতে। কিন্তু দুজনের কেউই 'একা' নয়। ঠিক কীভাবে দুটি চরিত্র একা থেকেও সদর্পে মাথা উঁচু করে জুড়ে থাকে সেই নিয়েই ছবি।
একটি মানুষ ঠিক কীভাবে বাঁচবেন, কাকে নিয়ে বাঁচবেন সে সিদ্ধান্ত তাঁর সম্পূর্ণ নিজস্ব। এই ভাবনা থেকেই পরিচালক ছুঁয়ে গিয়েছেন এলজিবিটিকিউ ইস্যুটিকে। এই ছবির চপলা চরিত্রটি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ উসমান চরিত্রটি। সে এই সময়ের পুরুষ, সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক একটি পরিবার থেকে উঠে আসা অথচ সে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে সম্মান করে। আবার প্রেমহীন সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার অধিকারের কথাও বলে এই ছবি। কিন্তু কোথাও কোনও কথাই পরিচালক উচ্চকিতভাবে বলেননি, বলেছেন একটি শান্ত, সুরেলা মেজাজে।
এই ছবিতে বেশ কিছু ভাল গান ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু ছবিটি সেই জন্য সুরেলা নয়। যে কোনও সংবেদনশীল দর্শক এই ছবি দেখতে বসে বুঝবেন আসলে জীবন নামক বহমানতায় যে সুর লেগে রয়েছে, স্তব্ধতায় যে গান বেজে চলে প্রতিনিয়ত, সেই সুরে সুর মেলানোর কথা বলেছেন পরিচালক। সেই সুরই আসলে মানুষকে পৌঁছে দেয় প্রেমের পারাবারে। আর তা তখনই সম্ভব যখন মানুষ নিজেকে ভালবাসে। সে যেমন, তেমনই সে ভাল। যা তার সত্য, তাই সুন্দর। সে ঠিক যেভাবে চায়, ঠিক তেমন করেই তার ভালবাসায় বাঁচার অধিকারের কথা বলে 'সিজনস গ্রিটিংস'।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন