টুবলু থেকে পঞ্চম, রাহুল দেববর্মণের কলকাতা কথা

কোনোক্রমে স্কুলের গণ্ডি পেরোতেই ১৯৫৫ সালে ছেলেকে পাকাপাকিভাবে বম্বেতে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন শচীন দেববর্মণ, ছেলের দিদিমার প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করেই

কোনোক্রমে স্কুলের গণ্ডি পেরোতেই ১৯৫৫ সালে ছেলেকে পাকাপাকিভাবে বম্বেতে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন শচীন দেববর্মণ, ছেলের দিদিমার প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করেই

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
happy birthday rahul da

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

জন্ম থেকে শুরু করে জীবনের প্রথমাংশের অনেকটাই কলকাতায় কাটান ভারতীয় ফিল্ম সঙ্গীতের কিংবদন্তী রাহুল দেববর্মণ। তাঁর জন্মদিনে ফিরে দেখা সেই দিনগুলি, সৌজন্যে অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য এবং বালাজি ভিট্টলের লেখা 'আর.ডি. বর্মণ: দ্য ম্যান, দ্য মিউজিক' বইটি, যা এই লেখার তথ্যসূত্র।

Advertisment

publive-image

১৯৬২ সালের কলকাতা, জানুয়ারি মাস। শহরের অভিজাত রেস্তোরাঁ এবং নাইটক্লাবগুলিতে লাইভ মিউজিকের রমরমা, মূলত পশ্চিমী সঙ্গীত, কখনো-সখনো হয়তো ভারতীয় সঙ্গীতের জন্য বরাদ্দ কিছুটা সময়। সেরকমই কোনও এক প্রতিষ্ঠানে এই বরাদ্দ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আচমকা যন্ত্রসঙ্গীতে বেজে উঠল 'মতওয়ালি আখোঁ ওয়ালে'। কয়েক মাস আগে মুক্তিপ্রাপ্ত 'ছোটে নওয়াব' নামক হিন্দি ছবির গান।

শুনে বিস্ময়ে এবং অস্বস্তিতে হতবাক উপস্থিত উচ্চবিত্ত বাঙালি সমাজের প্রতিনিধিরা। এ কি চায়ের দোকান নাকি, যে 'মারফি' রেডিওতে হিন্দি ছবির গান বাজবে? রবি ঠাকুরের গান হলে একটা কথা ছিল। যে সমাজে শঙ্কর-জয়কিষণ, ওপি নায়ার, সি রামচন্দ্র, এমনকি মদন মোহনের মতো অতীব জনপ্রিয় সুরকারও ব্রাত্য, স্রেফ 'হিন্দি সিনেমার গানে' সুর করেন বলে, সেখানে কোথাকার এক নতুন ছোকরার সুর নিয়ে হাজির অর্কেস্ট্রা?

Advertisment

'ছোকরার' নাম রাহুল দেববর্মণ, পরবর্তীকালে বলিউড কাঁপানো 'পঞ্চম'। বয়স তখন স্রেফ ২৩, 'ছোটে নওয়াব' দিয়েই একক সুরকার হিসেবে হিন্দি ছবির দুনিয়ায় প্রবেশ। ছবি এবং ছবির এই গানটি অল্পবিস্তর জনপ্রিয় হলেও বাকি গানগুলির সেসময় কদর হয় নি তেমন। অন্তর্মুখী স্বভাবের রাহুল ফিরে যান তাঁর পিতা, প্রবাদপ্রতিম সুরকার শচীন দেববর্মণকে সাহায্য করার কাজে। নিজের কাজের স্বার্থে নিজের প্রথম ছবি, বা বিখ্যাত বাবার নাম ভাঙাতে রাজি না থাকায় চার বছর আর কোনও ছবির সুর করেন নি তিনি।

happy birthday pancham পিতাপুত্র, শচীন ও রাহুল দেববর্মণ। ছবি: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস আর্কাইভ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে, দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাট এলাকার হিন্দুস্তান রোডে ২৭ জুন, ১৯৩৯, সকাল সাড়ে ন'টা নাগাদ জন্ম রাহুলের। বাবা-মা শচীন ও মীরা দেববর্মণ ছেলেকে ডাকতেন 'টুবলু'।

তাহলে 'পঞ্চম' কবে হলেন তিনি? জন্মের কয়েক বছর পর। বলা হয়, একেবারে শিশু বয়সে কাঁদলেও নাকি টুবলুর গলায় শোনা যেত সপ্তসুরের পঞ্চম সুর, অর্থাৎ 'পা'। তবে এ বিষয়ে আরও একটি কাহিনী আছে: রাহুল নিজে একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে 'পঞ্চম' নামটা অভিনেতা অশোক কুমারের দেওয়া, যেহেতু শচীন কর্তা 'সা' গাইলেই ছোট্ট টুবলু গাইত 'পা'। উল্লেখ্য, সুরকার হিসেবেও পঞ্চম প্রথম জনপ্রিয়তা পান তাঁর পাঁচ নম্বর ছবিতেই, যার নাম ছিল তিসরি মনজ়িল (১৯৬৬)।

এদিকে পঞ্চমের পাঁচ বছর বয়সে পরিবার সমেত বম্বের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন শচীন দেববর্মণ। আশা ছিল, লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিনেতা অশোক কুমারের মতোই সাফল্যের মুখ দেখবেন হিন্দি ছবির জগতে। তবে প্রথমদিকে আশানুরূপ ফল পান নি, এবং বছর দুয়েকের মধ্যেই, অর্থাৎ ১৯৪৬ সালে, বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের ছাত্র হিসেবে কলকাতায় ফেরত চলে আসে পঞ্চম। এই স্কুলের আরও দুই বিখ্যাত প্রাক্তনীর কথা হয়তো অনেকেই জানেন - সত্যজিৎ রায় এবং শম্ভু মিত্র।

আরও পড়ুন: মনে পড়ে রুবি রায়কে? আসলে কে এই ‘রুবি রায়’?

গোলগাল, চটপটে রাহুল ছিল অসম্ভব রকমের সাহসীও। ওড়িশার গোপালপুরে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রে স্নান করতে নেমে পায়ে সাপ জড়িয়ে যায় তার। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে পা থেকে সাপটিকে ছাড়িয়ে নিজের হাতে তাকে শেষ করে রাহুল। তবে একটি প্রাণীকেই রাহুল যমের মতো ভয় পেয়ে যান আজীবন - সে হলো ঘরের দেওয়ালে বসা নিরীহ টিকটিকি।

সমবয়সীদের মতোই সাইকেল চালানো, ব্যাডমিন্টন খেলা, বা সাঁতার কাটায় উৎসাহ ছিল পঞ্চমের। বস্তুত, সাঁতার ছিল তার অত্যন্ত প্রিয়। এতে যে শুধু তার হাঁপানি কাবু হয়ে যায় তাই নয়, শ্বাসপ্রশ্বাসকে নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলও শিখে ফেলে সে। সেই বয়স থেকেই রাহুলের আরও এক প্যাশন ছিল খাবার, যার প্রতিফলন আমরা দেখি যুবক রাহুল অভিনীত 'ভূত বাংলা' (১৯৬৫) ছবিতে, যেখানে তাঁর চরিত্রের মুখে বসানো হয় সেই অমর সংলাপ, "ম্যায় খা রহা হুঁ"।

মঙ্গোলীয় চেহারার ছেলেটিকে নেপালি বলে ভ্রম হতো অনেকেরই। বন্ধুরা বলেন, লেখাপড়ায় কোনওকালেই উৎসাহ ছিল না রাহুলের, বরং খেলাধুলোয় স্বাভাবিক দক্ষতা ছিল তার। হয়তো সেই কারণেই প্রথমে ১৯৪৮, এবং তারপর ১৯৫১ সালে স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করার পর তাকে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট ছেড়ে দেশপ্রিয় পার্ক সংলগ্ন তীর্থপতি ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হতে হয়। এতে অবশ্য একেবারেই উদ্বিগ্ন হন নি শচীন কর্তা, উল্টে ছেলে পরীক্ষায় ফেল করার দিন তাকে একটি 'র‍্যালে' বাইসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন!

তীর্থপতি থেকেই পাশ করেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর মতো ছাত্র। স্কুলের ধূলিধূসরিত, জরাজীর্ণ নথিপত্র ঘাঁটলে আজও পাওয়া যায় আরও একটি নাম, রাহুল দেববর্মণ। নতুন সাইকেল চালিয়ে নতুন স্কুলে যাতায়াত শুরু করল পঞ্চম, তবে এ ছেলের লেখাপড়া যে বেশিদূর এগোবে না, তা অনেকটাই আঁচ করেছিলেন শচীন দেববর্মণ। বরং গানবাজনার ক্ষেত্রে কিছু হলেও হতে পারে, এই ভাবনা নিয়ে ছেলেকে সঙ্গীতের দিকে টানলেন তিনি।

তালিম শুরু হলো দৃষ্টিহীন তবলা বাদক ব্রজেন বিশ্বাসের কাছে। এবং নানা আকারে রাহুলের সেই তবলার তালিম চলেছিল প্রায় জীবনভর। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে বম্বেতে তাঁর গুরু ছিলেন বিখ্যাত তবলিয়া পণ্ডিত শামতা প্রসাদ। এদিকে কলকাতায় তবলার পাশাপাশি শুরু হলো গড়িয়াহাটে আলি আকবর খান স্কুলে সরোদ বাদনের শিক্ষাও। তবে শিষ্যকে খুব বেশি সময় দিতে পারতেন না ততদিনে জগদ্বিখ্যাত গুরু। বরং আলি আকবরের পুত্র আশিসের সঙ্গেই বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ চলত রাহুলের। এছাড়াও তার অনেকটা সময় কাটত আলি আকবরের সঙ্গে এক সেতার শিল্পীর যুগলবন্দী শুনে - সেই শিল্পী ছিলেন আলি আকবরের ভগ্নীপতি রবিশঙ্কর। এতে শুধু যে রাহুলের মনের খোরাক জুটছিল তাই নয়, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্পর্কেও সাধারণের চেয়ে বেশি জ্ঞান লাভ করছিল সে।

আশিস পরে বলেছিলেন, "ছাত্র হিসেবে খুব সিরিয়াস ছিল না রাহুল, বড্ড অধৈর্য ছিল। কিন্তু সঙ্গীতটা ওর সহজাত, মূল ব্যাপারগুলো খুব তাড়াতাড়ি বুঝত। এবং আমার বাবা বা তখনকার দিনের কোনও বিখ্যাত শিল্পীর জলসা হলেই শুনতে যেত, যার ফলে হয়তো ভারতীয় সঙ্গীতের ব্যাকরণটা আরও ভালো বুঝেছিল।"

publive-image লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে। ছবি: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস আর্কাইভ

এদিকে দক্ষিণ কলকাতায় বড় হয়ে ওঠার ফলে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রভাবও সমান মাত্রায় পড়ছিল রাহুলের ওপর। তার বিশেষ পছন্দের ছিল জ্যাজ় এবং কিউবার 'বিগ ব্যান্ড' মিউজিক। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বিখ্যাত রেকর্ডের দোকান 'মেলোডি'তে ছিল তার অবাধ যাতায়াত, এবং 'মেলোডি'র কল্যাণেই পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে রাহুলের। অবিশ্বাস্য মনে হলেও হিন্দি ছবির গানে পাশ্চাত্য প্রভাবের পথপ্রদর্শক রাহুল দেববর্মণ কারোর কাছে কোনও পশ্চিমী যন্ত্র বাজাতে শেখেন নি। মাউথ অর্গান বাজাতেন বটে, তবে তা নিজে শিখে।

স্কুলের ছুটিতে বম্বে বেড়াতে গিয়ে ১৯৫১ সালে এক স্টুডিওতে আলাপ লতা মঙ্গেশকর এবং কিশোর কুমারের সঙ্গে। এক রেডিও সাক্ষাৎকারে পঞ্চম জানিয়েছিলেন, তখন 'নওজওয়ান' ছবির শুটিং চলছে, লতা রেকর্ড করছেন গান, 'ঠান্ডি হাওয়ায়েঁ লেহরাতি আয়েঁ'। এদিকে শচীন দেববর্মণ তখন সুর করছেন গুরু দত্ত পরিচালিত 'জাল' (১৯৫২) ছবিতে। বিশিষ্ট সঙ্গীত-কথক এবং গবেষক রাজু ভরতনের বক্তব্য অনুযায়ী, গোয়ার প্রেক্ষাপটে ছবির একটি গানে তার বাবা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছোঁয়া রেখেছিলেন, যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে বারো বছরের পঞ্চম। তবে সেই গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।

আরও পড়ুন: আরডি বর্মণের সুরে সেরা দশ বাংলা গান

কোনোক্রমে স্কুলের গণ্ডি পেরোতেই ১৯৫৫ সালে ছেলেকে পাকাপাকিভাবে বম্বেতে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন শচীন দেববর্মণ, ছেলের দিদিমার প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করেই। কলকাতায় থাকাকালীন 'মেলোডি চাইমস' বলে একটি গানের দল শুরু করে রাহুল। তবে বম্বের আকাশ ছিল আরও অনেক বড়।

কলকাতার সুরকার তথা পঞ্চমের ছেলেবেলার বন্ধু দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, "তীর্থপতিতে পড়তে পড়তে কিছুটা বেপরোয়া হয়ে গেছিল পঞ্চম। কসবার কাছে একটা নেশার আড্ডায় নিয়মিত যাচ্ছিল। ওদিক থেকে মন ফেরাতে আমরা লেকের আড্ডায় পাল্টা ওকে বসতে বাধ্য করতাম, যেখানে ও তেড়ে হারমনিকা বাজাত। জীবনের প্রতি পঞ্চমের 'অ্যাটিচিউড' দেখে ওর বাবাও কম চিন্তিত ছিলেন না। এবং ওকে বম্বেতে একরকম ধাপ্পা দিয়েই নিয়ে যান উনি।

"কলকাতায় আলি আকবর স্কুল অফ মিউজিকে তো ও যেতই, তা পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিক থেকেই বম্বেতে বেশি বেশি কাজ পাচ্ছিলেন আলি আকবর, এবং সেখানে স্কুল খোলার কথাও ভাবছিলেন। এসডি (শচীন দেববর্মণ) দেখলেন এই সুযোগ, পঞ্চমকে বললেন, যেহেতু তার শিক্ষাগুরু বম্বে চলে যাচ্ছেন, সেহেতু তারও যাওয়া উচিত। পঞ্চমের ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই 'ধোকা খেয়ে' বম্বেতে শিফট করে গেল। এবং এর ফলে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল ওর কেরিয়ার।"

অনুলিখন: যাজ্ঞসেনী চক্রবর্তী

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন