'১৯৪২ আ লাভ স্টোরি' পঞ্চমদার শেষ রেকর্ডিং ছিল না: ঊষা উত্থুপ

"আমার গলা বা গায়কী বরাবরই নিয়মের বাইরে, কিন্তু পঞ্চমদা আমার গান পছন্দ করতেন, এবং বলতেন যে আমি যেভাবে অন্যের গাওয়া গানও নিজের ঢঙে গাই, তা শুনতে ভাল লাগত ওঁর"

"আমার গলা বা গায়কী বরাবরই নিয়মের বাইরে, কিন্তু পঞ্চমদা আমার গান পছন্দ করতেন, এবং বলতেন যে আমি যেভাবে অন্যের গাওয়া গানও নিজের ঢঙে গাই, তা শুনতে ভাল লাগত ওঁর"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
usha uthup

রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে কয়েকজন গায়ক-গায়িকার নাম, তাঁদের মধ্যে একজন নিঃসন্দেহে কলকাতার 'দিদি', ঊষা উত্থুপ। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। 'আরডি' বা পঞ্চমের সঙ্গে খুব বেশি কাজ নেই ঊষার, যে আক্ষেপ কোনোদিন ভুলতে পারেন নি গায়িকা। তবে কিসের এই যোগসূত্র? উত্তরে স্রেফ দুটি গানের নাম করতে হয় - 'হরে রাম হরে কৃষ্ণ', এবং 'দোস্তোঁ সে প্যায়ার কিয়া'। আরও একটি কারণ আছে, তবে সে কথায় পরে আসা যাবে।

Advertisment

সকলেই জানেন, প্রথমটি 'হরে রাম হরে কৃষ্ণ' (১৯৭১) ছবির গান, দ্বিতীয়টি 'শান' (১৯৮০) ছবির। ঊষা নিজে মনে করেন, 'দোস্তোঁ সে প্যায়ার কিয়া'-র জন্যই তাঁকে মনে রেখেছেন সকলে। তবে যা সত্যিই অদ্ভুত, তা হলো অনেকের মনে এই ধারণা যে, আরডি-র অমর সৃষ্টি 'দম মারো দম' গানটিও ঊষারই গাওয়া, যেখানে সেই গানের সঙ্গে আদপেই তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই।

কেন এমন হলো? আজ একথা জিজ্ঞেস করলে ঊষা হাসেন, বলেন, "অনেকেই হয়তো জানেন না, প্রথমে 'দম মারো দম' গাওয়ার কথা ছিল আমার আর লতা মঙ্গেশকরের। ছবিতে 'ভালো মেয়ের' ভূমিকায় ছিলেন মমতাজ, যাঁর জন্য লতাজির গাওয়ার কথা ছিল, আর 'খারাপ মেয়ে' জ়িনাত আমানের গলা ছিল আমার। আমি রিহার্সালও দিই, তবে পরে গানটা করেন আশা ভোসলে, এবং কী চমৎকার ভাবে করেন!"

Advertisment

ঊষা অবশ্য পঞ্চমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন গায়িকা বদলের ব্যাপারে। ঊষার কথায়, "উনি আমায় বলেন, 'ইয়ার ওহ গানা আভি ছোড় দো, দুসরা বনা রহেঁ হ্যায় (ওই গানটা ছেড়ে দাও, তোমার জন্য আরেকটা গানের সুর করছি)'।" সেই 'আরেকটা গান' হয়ে দাঁড়ায় 'হরে রাম হরে কৃষ্ণ', আশার সঙ্গে ঊষার ডুয়েট। "গানটা অসম্ভব জনপ্রিয় হয়, আরডি বর্মণের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই," আজ বলেন ঊষা। "শেষ পর্যন্ত 'দম মারো দম'-এর এক্সটেনশন হয়ে যায় 'হরে রাম হরে কৃষ্ণ', ছবিতেও সেইভাবেই পরপর ব্যবহৃত হয় গান দুটো।"

তবে ঊষা মনে করেন, "আ সং ইজ় আ সং ইজ় আ সং" - কে গাইলেন তা শেষমেশ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। একজন মূল গায়ক বা গায়িকা থাকলেও গান মুক্তি পেয়ে গেলে তা সকলের সম্পত্তি হয় ওঠে, শিল্পকে কুক্ষিগত করে রাখা যায় না।

অন্যদিকে, আজও কোনও লাইভ অনুষ্ঠানে 'দোস্তোঁ সে প্যায়ার কিয়া' না গাইলে যে দর্শক তাঁকে মঞ্চ ছাড়তে দেন না, সেকথাও সহাস্যে স্বীকার করেন ঊষা উত্থুপ। সঙ্গে গাইতে হয় 'এক দো চা চা চা', আরডি-র সুরে ঊষার গাওয়া আরও একটি প্রভূত জনপ্রিয় গান, ছবির নাম 'শালিমার' (১৯৭৮)।

এত ভাষায়, এত সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন, কেন আজও আরডি বর্মণকে তাঁর বিশেষ মনে হয়? সময় নিয়ে উত্তর দেন 'দিদি'। "আমার দেখা আর কোনও সঙ্গীতকারের সুর বোধহয় এতবার মিক্স, রিমিক্স, রি-রিমিক্স হয়নি, যতটা পঞ্চমদার ক্ষেত্রে হয়েছে। খুব দুঃখ হয়, এই শ্রদ্ধা, প্রশংসা, যদি নিজের জীবনকালে দেখে যেতে পারতেন, কী ভালো হতো।"

একসঙ্গে তেমন বেশি কাজ না করলেও, সঙ্গীতের মাধ্যমে দুজনের বন্ধুত্ব ছিল আরডি-র শেষ দিন পর্যন্ত। "উনি কমপ্লিট একজন মিউজ়িশিয়ান ছিলেন, এতরকম ভাবে একটা গানকে দেখতে পারতেন... আমরা প্রথমে রেকর্ড, তারপর ক্যাসেট দেওয়া নেওয়া করতাম। ওঁর দৌলতে পৃথিবীর নানা প্রান্তের অজস্র গান শুনেছি আমি," বলেন ঊষা।

আরও পড়ুন: মনে পড়ে রুবি রায়কে? আসলে কে এই ‘রুবি রায়’?

আরও একটি তথ্য যা হয়তো অনেকেরই অজানা তা হলো, জন্মসূত্রে মুম্বইয়ের মেয়ে ঊষা 'উত্থুপ' হওয়ার আগে ছিলেন 'আয়ার', এবং সেই সময় তাঁদের মুম্বইয়ের বাড়িতে পারিবারিক বন্ধু হওয়ার সুবাদে প্রায়শই আসতেন পঞ্চম। শুধু তাই নয়, ঊষা মুম্বইয়ের যতগুলি নাইটক্লাবে গাইতেন, তার প্রায় প্রতিটিতেই তাঁর গান শুনতেও যেতেন। "আমার গলা বা গায়কী বরাবরই নিয়মের বাইরে, কিন্তু পঞ্চমদা আমার গান পছন্দ করতেন, এবং বলতেন যে আমি যেভাবে অন্যের গাওয়া গানও নিজের ঢঙে গাই, তা শুনতে ভাল লাগত ওঁর, বিশেষ করে জ্যাজ় এবং ল্যাটিনো," ফের একবার হেসে বলেন ঊষা।

এই অনুপ্রেরণা একতরফা ছিল না। ঊষাই পঞ্চমকে প্রথম শুনিয়েছিলেন ১৯৬৯ সালের জনপ্রিয় ইংরেজি গান 'ইফ ইটস টিউজ়ডে, দিস মাস্ট বি বেলজিয়াম', যা পরবর্তীকালে বেশ খানিকটা রঙ পাল্টে হয়ে যায় 'ইয়াদোঁ কি বারাত' (১৯৭৩) ছবিতে আরডি বর্মণের সুরে এবং আশা ভোসলের কণ্ঠে সুপারহিট গান, 'চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে জো দিল কো', বিশেষ করে প্রথম কয়েকটি লাইন। "যেভাবে যে কোনও গানকে নিজের ছাঁচে ঢেলে সাজাতে পারতেন উনি, তা অবাক করার মতো," বলেন ঊষা। অবাক হতেন পঞ্চমও, ঊষার কণ্ঠে আশা ভোসলে অথবা নিজের গাওয়া গান শুনেও। ঊষার কথায়, "একবার ওঁরই গাওয়া 'তুমি কত যে দূরে' শুনে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে এবং যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীদের জন্য হাততালি দিয়েছিলেন।"

এখান থেকেই উঠে আসে গায়ক পঞ্চমের কথা, যে বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয় না বলেই মনে করেন ঊষা। "ব্রিলিয়ান্ট সিঙ্গার, সারা পৃথিবীতে খুব কম এমন গায়ক আছেন, যাঁরা এত অরিজিনাল যে তাঁদের মতো কেউ গাইতে পারেন না। উনি সেরকম ছিলেন," বলেন ঊষা। নিজে গেয়েই কি গান তোলাতেন ঊষাকে? "সবসময় না, যেমন 'এক দো চা চা চা'-র সময় আমাকে বলেছিলেন, 'ইয়ার তু তো মাদ্রাসি হ্যায়, আপনে ঢঙ্গ সে গা লে'!"

তবে এর ব্যতিক্রম ঘটে দুজনের শেষ যৌথ কাজের ক্ষেত্রে। "সকলে ভাবেন '১৯৪২: আ লাভ স্টোরি' ছবির গানই ওঁর শেষ রেকর্ডিং, কিন্তু তা নয়। ১৯৪২-র বেশ কিছুটা পরে আমি আর পঞ্চমদা মুম্বইয়ে রেকর্ড করি 'বাতি নেই বাতি নেই' বলে আমাদের বাংলা অ্যালবাম, এবং আমি কোনোদিন ভুলব না, ওই অ্যালবামের 'প্রেমে পড়ে যাই' গানটা রেকর্ড করার সময় পঞ্চমদা আমাকে বলেছিলেন, "চাবা চাবা কে গাও, জ্যায়সে হামেশা গাতি হো," বলে গানের প্রধান লাইনটি গেয়েও শোনান ঊষা। "আমি সবসময়ই গানের কথা গাই, শুধু সুর নয়, যেটা ওঁর খুব পছন্দ ছিল।"

সুতরাং পঞ্চমের কেরিয়ারের মাঝামাঝি, এবং শেষের দিকেও সঙ্গে ছিলেন ঊষা। "সারা জীবন একই প্যাশন দেখে গেছি ওঁর মধ্যে, এবং কেরিয়ারের শেষ রেকর্ডিং আমার সঙ্গে, সেটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো।"

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন