মুক্তি পেল অরিন্দম শীল পরিচালিত 'মহানন্দা'। মহাশ্বেতা দেবীর জীবনের আধারে তৈরি এই ছবি প্রান্তিক মানুষদের হয়ে কতটা নাড়ি স্পর্শ করতে পারল? লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
বাম আমল। অন্যায়ভাবে জমি দখল। খেটে খাওয়া চাষিভাইদের মাটি কেড়ে নেওয়ার জোরজোলুম। খুন-ধর্ষণ। আর এসমস্ত যাবতীয় রাজনৈতিক নষ্টামির বিরুদ্ধে যে মানুষটি মায়ের মতো আঁচল বিছিয়ে প্রতিবাদী আওয়াজ তুলেছিলেন ওই দরিদ্র সাওতাল-মুণ্ডা পরিবারগুলির জন্য, তিনি মহাশ্বেতা দেবী। সংসার-ত্যাগী এক নারী যেন জঙ্গলেই তাঁর জগৎ-সংসার পেতেছিলেন ওই দুঃস্থ মানুষগুলিকে নিয়ে। নীতিবোধ, মূল্যবোধের জন্য যিনি এককালে স্বামী-সন্তান ত্যাগ করতেও দ্বিধাবোধ করেননি, সেই মহিয়সী-ই শেষবয়সে লাল পতাকা বুকে আঁকড়ে দল ছেড়েছিলেন শুধুমাত্র সমাজের প্রান্তিক মানুষগুলোর মুখের দিকে চেয়ে। মহাশ্বেতা দেবী- যাঁর জীবন প্রকৃত অর্থেই মহানন্দা নদীর মতোই বহমান। ব্যক্তিগত জীবন থেকে পেশা, সবক্ষেত্রেই বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেও খরস্রোতা নদীতে নিজের জীবন-তরী ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। অরিন্দম শীলের 'মহানন্দা' সেই লড়াইয়ের কথাই বলে।
এ ছবি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বটে! তবে 'মহানন্দা'কে তথাকথিত রাজনৈতিক কিংবা দলীয় কোনও ছবির তকমা দেওয়া যায় না। শাল-মহুয়ার ছায়ায় যেখানে দু'বেলা দু'মুঠো পেটের ভাত জোগাড় করার জন্য মানুষ খেটে মরে, সেখানে তাঁদের লড়াই ভাঙিয়ে ক্ষমতাসীন দল আবারও কালচক্র ঘুরিয়ে সেই একই অপরাধে জড়ায়। অতঃপর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইকে যদি রাষ্ট্রদ্রোহের আখ্যা দেওয়া হয়, তাহলে বিষয়টি কেমন দাঁড়ায়? প্রশ্ন তুলেছে 'মহানন্দা'।
এই ছবির সেরা প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে 'মহানন্দা' গার্গী রায়চৌধুরি। তাঁর অভিনয় দক্ষতা নিয়ে আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। উল্লেখযোগ্য বিষয়, প্রস্থেটিক পড়ে পঁচাত্তরের মহাশ্বেতা দেবীর অভিব্যক্তি, হাঁটুর সমস্যা নিয়ে খুঁড়িয়ে চলা, ভাঙা-ধরা গলায় কথা বলা, কিংবা পুরুলিয়ার সাঁওতালি ভাষার সঙ্গে নিপাট বাংলা বলার ভঙ্গী… যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় নিখুঁতভাবে পরিবেশন করেছেন অভিনেত্রী।
অরিন্দমের এই ছবি কিন্তু রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্রের মোড়কে সম্পর্কের গল্পও বলে। সময়ের ফারাকে সেখানে পরিচালক একাধারে যেমন মহানন্দা ও তাঁর স্বামী বিজন ভট্টাচার্যের (দেবশঙ্কর হালদার) রসায়ন-তিক্ততা দেখিয়েছেন, তেমনই অন্যদিকে আবার তরুণ-জুটি বিহান-মহলের প্রেমকেও সমান্তরাল রেখে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ঘুণ ধরা সম্পর্কের পরিণতি। তাই বোধহয় মহানন্দার মুখে সংলাপ বসিয়ে অরিন্দম বলে দিতে চেয়েছেন- পুরুষ মানুষ সাফল্য আর অর্থের স্বাদ পেলে নীতিবোধ, মূল্যবোধ বিসর্জন দিতেও ভোলে না। যে মহানন্দা পরিবার-পরিজন ছেড়ে বাকি জীবনটা একাই লড়ে গেলেন প্রান্তিক মানুষদের হয়ে। মহালের প্রেমের পরিণতিও ঠিক তাই। প্রেমিকের রাজনৈতিক স্বার্থ, কূটনীতি বুঝতে পেরে যে দূরে সরে যায়। নতুন করে বাঁচার লড়াই শুরু করে মহানন্দার হাত ধরে। আওয়াজ তোলে আদিবাসী মহিলাদের খুন-ধর্ষণের বিরুদ্ধে। মহলের ভূমিকায় ইশা সাহা ও খল-চরিত্র বিহানের বেশে অর্ণ মুখোপাধ্যায় ভাল অভিনয় করেছেন। তবে দেবশঙ্কর হালদার জাত অভিনেতা হলেও তাঁর বাঙাল ভাষার সংলাপে কোথাও বাধো-বাধো ঠেকল!
'মহানন্দা'র গল্প ও চিত্রনাট্য যেভাবে সাজানো হয়েছে তার জন্য প্রশংসার দাবিদার অরিন্দম শীল ও শুভেন্দু দাসমুন্সি। অয়ন শীলের ক্যামেরা ও সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা কোথাও দর্শকের চোখকে অতিরঞ্জিত মনে হতে দেয় না। সোমনাথ কুণ্ডুর মেকআপ পারদর্শীতা আগেও একাধিক ছবিতে দেখা গিয়েছে। কাজেই 'মহানন্দা'য় মহাশ্বেতা দেবীর বিভিন্ন বয়স ফুটিয়ে তোলা তাঁর কাছে যে জলভাতের মতোই, তা বলাই বাহুল্য।
তবে এই সিনেমার প্রাণ বিক্রম ঘোষের মিউজিক। যা কিনা 'মহানন্দা'কে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। সে নেপথ্যসঙ্গীতে সাঁওতালি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার-ই হোক কিংবা সাহানা বাজপেয়ীর কণ্ঠে 'রং ধরেছে' গানটিই হোক। অরিন্দম-বিক্রম জুটি যে বাংলা সিনেমার মিউজিকের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এক অন্য মাইলস্টোন খাড়া করে, 'মহানন্দা' তা আবারও প্রমাণ করে দিল। এক নারীর অদম্য লড়াই, মানসিক শক্তির জোর কীভাবে ক্ষমতাসীন দলকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল? জানতে হলে প্রেক্ষাগৃহে 'মহানন্দা' দেখে আসতেই পারেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন