বাংলা সিনেমায় বদল এসেছে প্রায় অনেকবছর। কিন্তু, বাংলা ওয়েব সিরিজে সেই বদল দেখা গিয়েছে দেশ কিছু বছরে। হাত না পাকতেই অনেক পরিচালক সিরিজের চারপাশ দেখতে শুরু করলেও তাতে ফুল মার্কস পেয়েছেন খুব কম। অন্তত, এই বছর লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আবার প্রলয় ওয়েব সিরিজের জগতে বিরাট ছক্কা হাঁকিয়েছে। আর এবার, ছোটলোকের শুরু থেকে শেষ খতিয়ে দেখার পালা।
কাকে ছোটলোক বলে আদতে? যারা নিজের মানসিকতার ছোট পরিচয় দেয় নাকি যারা সমাজের ভাষায় নিচু শ্রেণীতে বাস করেন? নাকি..? ছোটলোকের যত বিশেষণ থাকুক না কেন, পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী কিন্তু এক অনন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আজও বাংলার ঘরে ঘরে জাত পাতের এক বিশেষ জায়গা রয়েছে। বিশেষ করে ভেদাভেদের স্থান বেশি মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যেই। কিন্তু... বড়লোকের ড্রয়িং রুমে সীমারেখা টানা থাকলেও ভেদাভেদ বাইরে থেকে চোখে পড়া খুব বিরল। আর এই বিষয়টিতে স্ট্রেট ড্রাইভ খেলে গিয়েছেন পরিচালক।
লেয়ার থ্রিলার, পরতে পরতে রয়েছে রহস্য এবং সমাজের কোণে কোণে লুকিয়ে থাকা নানা অদৃশ্য সত্যি আবার কিছুটা দৃশ্যও বটে। সিরিজে, নিম্নবর্ণের একজন মহিলার চরিত্রে দামিনী বেনি বসু, যায় কপালে সবসময় চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। সাব ইন্সপেক্টর সাবিত্রী বসু মন্ডল...যাকে শিকার হতে হয় ধর্মান্ধতার। তাঁকে এও বলা হয়, সে যে বাতাসে শ্বাস নেন সেটির যোগ্য আপনি নন। সিরিজের শুরুতেই মার্ডার। কিন্তু কার? তথাকথিত এই সিরিজে যাদের ছোটলোক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। থ্রিলারে ছোটলোক এবং ভদ্রলোকের বিবাদ স্পষ্ট দেখানো হয়েছে। গ্ল্যামার, মেকাপ, শহরের বুকে একটা আস্তানা, এসব স্বপ্নই কাল হয়ে দাঁড়াল। কলকাতার একটি ফ্ল্যাট এবং মফস্বল থেকে উঠে আসা একটি মেয়ে রূপসা, যে উদীয়মান মডেল এবং পার্ট টাইম এসকর্ট। তাঁর খুন এবং রহস্যের শুরু।
আর পাঁচটা পরিবেশে যা হয়, পরিচালক ঠিক সেটাই দেখিয়েছেন। তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কার হওয়ার পর, সেটি যেন সেলফি যোন হয়ে উঠল। সকলে তাঁর ওয়ার্ডরোব থেকে জুতোর ড্রয়ার ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকল। তাঁর নানা ধরনের অন্তর্বাস, ছুঁয়ে দেখল সকলে। মন্ডল এই মামলা খতিয়ে দেখছেন। একজন নিম্নবর্ণের পুলিশ এবং তাঁর সহকারীকে ঘিরে ধরলেন তথাকথিত উচ্চবর্ণের সকলে। এরপরই আসল মানুষের সঙ্গে সকলের পরিচয় হওয়া। খুন কে করেছে এর কিনারা করতে গিয়েই রাস্তায় এসে দাঁড়ায় একের পর এক চরিত্র।
রাজা ভট্টাচার্য, অর্থাৎ গৌরব চক্রবর্তী। যিনি রাজনীতিবিদ মোহর ভট্টাচার্যের ( ইন্দ্রানী হালদার ) পুত্র। রাজা মল্লিকার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও রূপসার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল প্রতিনিয়ত। চরিত্রগুলোর মধ্যে অনেক তফাৎ। নানা ক্রস কানেকশন সবকিছুই বিদ্যমান। পরিচালক নেপথ্যের খেলা ভালই পর্যবেক্ষণ করিয়েছেন। মোহর ভট্টাচার্য হিসেবে ইন্দ্রানী হালদার যে দাপুটে চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন সেটি অনবদ্য। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক কেরিয়ারে বাঁধা পেরোতে তাঁকে নানা অপমান, কটাক্ষ সহ্য করতে হয়েছে। ফলেই তিনি বেশ যৌক্তিকতা এবং বাস্তবে বিশ্বাসী। ছেলের বউয়ের পদবী নিয়েও তিনি সমান জ্ঞান রাখতে পছন্দ করেন। ব্রাহ্মণ ঘরে দাস অর্থাৎ নিচুবর্ন! অসবর্ন বিবাহ নিয়েই নাক উচুঁ ভাব তাঁর।
রহস্য তো রয়েছেই তবে, সিরিজের প্রতিটা পাতায় রয়েছে বিনোদন। একটি শো কখন হয়ে ওঠে যখন তাতে চর্চিত ষড়যন্ত্রের থেকে বেশি বড় হয়ে ওঠে আসলে চরিত্রগুলি গুরুত্বপূর্ন। এটি একটি এমন শো যা সমাজকে এবং যারা এই সমাজের জাত পাতের এক বিরাট দুর্গ সৃষ্টি করেছেন তাদের কীভাবে নিষ্ঠুর হতে শেখানো যায়। পরিচালক হিসেবে ইন্দ্রনীল অনবদ্য। প্রিয়াঙ্কা বেশ সাবলীল। গৌরব অন্যত্র যেভাবে নিজেকে তুলে ধরেন সেখানের তুলনায় একটু হলেও খামতি থেকে গিয়েছে।