ধর্মনিরপেক্ষ দেশে সেক্যুলারিজমের বুলি আউড়ে, কতটা সুরক্ষিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি? 'ধর্মযুদ্ধ'র ট্রেলারে সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে মুক্তি পেল সেই বহুপ্রতীক্ষিত ছবি। কেমন হল? লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
আধুনিকতার চাকচিক্যের আড়ালে সাম্প্রদায়িক বিভেদকামী রাজনীতির ষড়যন্ত্র! আমরা-ওঁরা, রাম-রহিমের বিভেদ টেনে বারবার হিংসা-হানাহানি, দাঙ্গার বীজ বুনে দেওয়া হয়। ৪৭-এ স্বাধীনতার পর থেকে জাতিতত্ত্বকে সামনে রেখে সুবিধাভোগী মানুষদের প্রশাসন চালানোর ঘটনা এদেশে কম নয়! একাধিকবার সংবাদের শিরোনামে কখনও হিন্দুবাদ, আবার কখনও বা ইসলামিক ধর্মগুরুদের রোষানলের খবর উঠে এসেছে। সবক্ষেত্রেই নির্মম পরিণতির শিকার আম-জনতা। সলতে-তে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পট থেকে পগাড়-পার হন সেসব সুবিধেবাদী ব্যক্তিত্বরা। যার ফল ভোগ করতে হয় দেশের জনসাধারণকে। আর 'গিনিপিগ' জনতার সেই পরিণতি দেখেই বারবার শেষহাসি হেসেছে ধর্ম ধজ্বাধারীরা। বাস্তব সেই প্রেক্ষাপটের আঁচ-ই পাওয়া গেল রাজ চক্রবর্তীর 'ধর্মযুদ্ধ'তে।
ধর্মের নামে আস্ফালনকারীদের শিকার চার চরিত্র- জবর, রাঘব, শবনম, মুন্নি। প্রত্যন্ত সীমান্ত অঞ্চল। যেখানে জাত, ধর্ম নিয়ে অশান্তি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়, সেই অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার এঁরা। মুন্নির (শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়) স্বামীকে বেকায়দায় ফেলে, উসকে মসজিদে হিন্দু পতাকা লাগানো হয়। যার ফলস্বরূপ জ্বলতে শুরু করে সেই গ্রাম। ধর্মীয় ধজ্বাধারীদের রোষানল থেকে বাদ যায় না জবর, রাঘব, শবনমরাও। প্রত্যেকেরই কালো অতীত রয়েছে। যেখানে ধর্মকে শিখণ্ডি করে খুন-জখমও হয়েছে। এক দাঙ্গার রাতের ঘটনাকেই পর্দায় তুলে ধরেছেন রাজ চক্রবর্তী।
শবনমের (পার্ণো মিত্র) সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে মরতে হয়েছে হিন্দু যুবককে (কৌশিক রায়)। লাভ জিহাদের এহেন ঘটনা 'হিন্দু-রাজ্যে' আকছাড় ঘটে! অন্যদিকে মুসলিম পাঁঠার মাংস বিক্রেতা জবরকে (সোহম চক্রবর্তী) গো-মাংস বিক্রির সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হতে হয়। সমসাময়িক আরেকটি প্লটে দেখানো হয় আজানের সময় তুলসি তলায় শঙ্খ ফুঁ দেওয়ার অপরাধে রাঘবের (ঋত্বিক চক্রবর্তী) মাকে হত্যা করার ঘটনা। আধুনিক সমাজে এহেন ঘটনা অবাস্তব মনে হলেও দেশের অনেকাংশে আজও এসব প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবও বটে! যার বলি হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
দাঙ্গার রাতে ঘরহারা তিন চরিত্র- মুন্নি, জবর, রাঘবরা আশ্রয় নেন এক বৃদ্ধার বাড়িতে। তিনি স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। পরিচালক সম্ভবত সেক্যুলার দেশমাতৃকার আদলে তাঁর চরিত্র বুনেছেন। সংলাপ অন্তত তাই বলে। যেখানে স্বাতীলেখাকে দেখা যায় জাতপাতের বিভেদ না করে আশ্রিত সকলকেই মায়ের মতো বুকে আগলে রেখে সামলাতে। গীতার বাণী কিংবা কোরাণের কলমা আওড়ানো সংলাপের দৃশ্যে টেনশন ক্রিয়েট করতে চেয়েছেন পরিচালক। বেশ কয়েক জায়গায় তা শিথিল বলেও মনে হয়। তবে অতি-নাটকীয়তা ও কাকতালীয়ভাবে একেক চরিত্র পরিচয় করানোর আড়ালে শুভশ্রী, পার্ণো, সোহম-ঋত্বিকদের অভিনয় দর্শকাসনে বসে মন কাড়ে। উল্লেখ্য, স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের মতো বাংলা সিনেমার টলস্তয় অভিনেত্রীর অভিনয়গুণ বিচার করা ধৃষ্টতার মতোই। চিরকাল তাঁর কাজের কাছে ঋণী থাকবে অভিনয়জগৎ।
স্বল্প দৈর্ঘ্যের দৃশ্য হলেও উপস্থিতিতে নজর কেড়েছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এবং সপ্তর্ষি মৌলিক। কৌশিক রায়ও তাই। তবে এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, চিত্রনাট্যে বেজায় দক্ষতার সঙ্গে ট্যুইস্ট রেখেছেন পদ্মনাভ দাশগুপ্ত। শেষপাতে না বললেই নয়, 'প্রলয়' এবং 'পরিণীতা'র মতো সিনেমা উপহার দিয়ে পরিচালক হিসেবে রাজ চক্রবর্তী যে প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছেন, উপরন্তু 'ধর্মযুদ্ধ'র ট্রেলার যতটা ট্রিগারিং ছিল, সেই তুলনায় গোটা সিনেমা ততটাও নয়। সিনেম্যাটিক গ্রামারের প্রসঙ্গ টানলে বেশ কিছু দৃশ্য শিথিল বলে মনে হয়। বিশেষত, অন্তঃসত্ত্বা শুভশ্রী তথা মুন্নির ধ্বস্তাধস্তি এবং সন্তান প্রসবের পর বাচ্চার হঠাৎ কান্না বন্ধ হয়ে যাওয়ার দৃশ্যগুলোতে আরেকটু নজর দিলে ভাল হত।
তবে বাস্তব প্রেক্ষাপটকে এহেন সাহসিকতার সঙ্গে বড়পর্দায় তুলে ধরার জন্য রাজ চক্রবর্তীর বাহবা প্রাপ্য। বাংলা বলেই হয়তো এই সিনেমাকে বয়কট করার সাহস দেখাননি এখনও কেউ কিংবা হলের বাইরে পোস্টার জ্বালিয়ে খুন-ধর্ষণের হুমকি ছোড়েননি। তবে সাম্প্রদায়িক হানাহানির ফল যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তার একটুকরো দলিল হয়ে রইল রাজের 'ধর্মযুদ্ধ'। প্রেক্ষাগৃহে অনায়াসে দেখে আসতে পারেন এই ছবি। তাতে যদি সভ্যসমাজের বিবেক জাগ্রত হয়!
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন