সদ্য মুক্তি পেয়েছে অনীক দত্তর 'অপরাজিত'। ১৯৫৫ সালে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে 'পথের পাঁচালি' নামক যে 'মাস্টারপিস' তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়, তার নেপথ্যে কতটা স্ট্রাগল ছিল? সেই গল্পই ২০২২ সালে এসে পর্দায় তুলে ধরলেন অনীক দত্ত। কেমন হল? লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
'অপরাজিত'র হার না মানার গল্প
বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের জীবনকাহিনি পর্দায় তুলে ধরা বাঙালি তথা সিনেপ্রেমীদের আবেগকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ার সম্মুখীন হওয়ার থেকে কোনও অংশে কম নয়। অনীক দত্ত সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন এবং বলা ভাল, সাফল্যের সঙ্গেই সেই ডকুমেন্টশন তৈরি করেছেন। 'পথের পাঁচালি' এখানে 'পথের পদাবলী'। সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকার নাম 'অপরাজিত' রায়। আসলে ৬৬ বছর আগে বিশ্বের সিনে-দরবারে ভারতকে পৌঁছে দিতে মাণিকবাবুর হার না মানার যে অদম্য লড়াই, সেক্ষেত্রে অনীকের ছবির এই নাম যথোপযুক্ত। তবে উল্লেখ্য, 'পথের পাঁচালি' তৈরির নেপথ্যে সত্যজিৎ রায়ের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায়ের অবদানও কম নয়। স্বামীর হাতে বিয়ের গয়না তুলে দিয়ে সিনেমার ফান্ড জোগাড় করার যে গল্প, অনীক তাঁর 'অপরাজিত'তে বিমলা রায় চরিত্রের মধ্য দিয়ে সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, মাণিকবাবুর ব্যক্তিগত জীবনে যেমন 'লিঙ্গবৈষম্য' শব্দটির কোনও অস্তিত্ব ছিল না, ঠিক যেমনটা তাঁর 'অপুর সংসার' থেকে শুরু করে একাধিক ছবির গল্পে দেখা গিয়েছে, অনীক দত্তও খুব পারদর্শীতার সঙ্গে 'অপরাজিত'তে সেই বিষয়টিকে প্রতিস্থাপন করেছেন অপরাজিত (জিতু কামাল) ও বিমলার (সায়নী ঘোষ) চরিত্রের মধ্য দিয়ে।
'পথের পাঁচালি' ও 'পথের পদাবলী'কে মিলিয়ে দিলেন অনীক
সিনেমার মধ্যে সিনেমা..। 'পথের পাঁচালি' মেকিংয়ের সময় সত্যজিৎ রায়কে যে স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, জিতু কামালকে দিয়ে 'পথের পদাবলী'তে সেই কাহিনি দেখালেন পরিচালক। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, মাণিকবাবু ও তাঁর তরুণ টিম সুব্রত মিত্র, বংশী চন্দ্রগুপ্ত যে ম্যাজিক তৈরি করেছিলেন, সেটা পর্দায় রি-ক্রিয়েট করা চারটিখানি কথা নয়! কিন্তু ইন্দিরা ঠাকুরণের মৃত্যুর দৃশ্য থেকে, কাশবনের মধ্য দিয়ে অপু-দুর্গার ছুটে গিয়ে ট্রেন দেখা, বৃষ্টিতে অপু-দুর্গার ভেজার দৃশ্য, টাকে বৃষ্টির ফোঁটা পড়া, পুকুরের জলে মিষ্টিওয়ালার সঙ্গে দুই ভাইবোন ও কুকুরের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করা থেকে উনুনের সামনে 'সর্বজয়া' করুণাদেবীর শাড়ি আঁকড়ে মৃত মেয়ে দুর্গার স্মৃতিচারণা করে ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠার মতো কালজয়ী দৃশ্যগুলো সাদা-কালো ফ্রেমে বেজায় পারদর্শীতার সঙ্গে 'অপরাজিত' ছবিতে তুলে ধরেছেন অনীক। এ যেন এক নস্ট্যালজিক ট্রিপ। পথের পাঁচালির মেকিংয়ের গল্প যাঁরা এযাবৎকাল বইয়ের পাতায় পড়েছেন, তাঁদের জন্য 'অপরাজিত'তে সেই ছবি জীবন্ত করে তুললেন পরিচালক।
'অপরাজিত' যতটা সত্যজিতের, ততটাই বিজয়া রায়ের
সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকায় জিতু কামাল। বিজয়া রায়ের চরিত্রে সায়নী ঘোষ। যদিও দুই চরিত্রের নাম বদলে অপরাজিত ও বিমলা রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই সিনেমার পর থেকে অভিনেতা জিতু দর্শকদের প্রত্যাশা আরও বাড়িয়ে দিলেন। চেহারার সাদৃশ্য ও সম্প্রতি চলতে থাকা সেই বিষয়ে তর্কাতর্কি, সমলোচনা, কাটাছেঁড়া এসবের উর্ধ্বে গিয়ে মাণিকবাবুর অভিব্যক্তি, চলন-বলন থেকে সিগারেট ধরার স্টাইল, এমনকী কথা বলার সময় হাতের যে মুদ্রা, সেটাও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রপ্ত করেছেন জিতু কামাল। তবে ব্যারিটোন ভয়েসের বিষয়টা কিন্তু দিব্যি সামলে দিয়েছেন চন্দ্রাশীস রায়। সমান্তরালভাবে বিজয়া রায়ের চরিত্রে বিমলা থুড়ি সায়নী ঘোষের পারফরম্যান্সও ক্ষুরধার। জিতুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। জিতু কিংবা সায়নীর অভিনয়ে কোথাও এটুকু বাড়াবাড়ি মনে হয়নি।
'অপরাজিত' কেন দেখবেন?
চিত্রনাট্যে কোনও অতিকথন নেই। দেখতে বসে দর্শকের অন্তত একঘেয়ে লাগবে না। সিনেমার গোড়া থেকে বিশিষ্ট নাট্যকার তথা সিনে-সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হয়ে সাক্ষাৎকারে অপরাজিত রায় ওরফে জিতু যেভাবে 'পথের পদাবলী' মেকিংয়ের নেপথ্যের স্ট্রাগলের কথা তুলে ধরেন ও অনীক তাঁর সিনেমার চিত্রনাট্যে যেভাবে সেই টুকরো টুকরো ঘটনাগুলিকে সাজিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। বিশেষ করে সুপ্রতিম ভোলের দৃশ্যগ্রহণ, অর্ঘকমল মিত্রের সম্পাদনা উল্লেখযোগ্য। মেকআপ শিল্পী সোমনাথ কুণ্ডুর কথা বোধহয় এক্ষেত্রে আলাদা করে আর উল্লেখ করার প্রয়োজন হয় না। মাণিকবাবুর জুতোয় পা গলাতে জিতু যতটা খেটেছেন, সেই প্রেক্ষিতে সোমনাথেরও কৃতিত্ব কম নয়। সুব্রত মিত্রের ভূমিকায় দেবাশিষ রায়ও বেজায় সাবলীল। 'পথের পাঁচালি'তে মাত্র ১১ ঘণ্টার ব্যবধানে রবিশঙ্কর যে সুরের মূর্চ্ছনায় বিশ্বের সিনেদর্শকদের আবেগাপ্লুত করেছিলেন, অনীকের 'অপরাজিত'র জন্য দেবজ্যোতি মিশ্রর আবহসঙ্গীতও সেই প্রেক্ষিতে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এহেন ছবি উপহার দেওয়ার জন্য প্রযোজক ফিরদৌসুল হাসানকেও ধন্যবাদ জানাতে হয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন