'মাঝে মাঝে মনে হয়, কলকাতার পয়ঃপ্রণালীর মধ্যে থেকে উঠে আসে, আজীবন যে শুয়ে রয়েছে… শিশু/ যারা সামাজিক মাতা-পিতা নয় স্তম্ভিত ক্রীড়ায় যে বোঝে সবার মধ্যে লক্ষণীয় স্থান নেই তার- / নিতে হবে ছলে-বলে, কেড়ে ও কৌশলে'… ১ ঘণ্টা ৩৩ মিনিটের ছবিটা দেখলে বারবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার এই লাইনগুলো মনে উঁকি দেয়। পরিচালক ঈশান ঘোষের পয়লা পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা 'ঝিল্লি'। বাস্তব আস্তাকুঁড়ে ঘেঁটে ক্যামেরাকে দৌঁড় করিয়ে ধাপার মাঠের আবর্জনা ঢিপির ভিতর থেকে যা আবিষ্কৃত হল, সেটা নিখাদ সোনা।
ব্যস্ত আধুনিক শহরের চাকচিক্যের অন্দরেই এ এক অন্য জগতের গল্প। পথচলতিদের কাছে তা অজানা অচেনা। অন্ধকারও বটে! কেউ জানার চেষ্টাও করেন না। কিংবা ওই অন্ধকূপের মধ্য থেকে প্রান্তিক মানুষগুলোকে টেনে তোলার ভাবনা তো দূরঅস্ত। পরিচালক ঈশান কিন্তু তাঁর পয়লা সিনেমাতেই তথাকথিত আধুনিক সমাজের 'বাতিলদের' কথা তুলে ধরার সাহস দেখিয়েছেন।
দূর থেকে ধাপার মাঠ দেখলেই সভ্য সমাজের গা গোলানোর জোগাড় হয়! পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে তো কোনও কথাই নেই। নাকে-মুখে রুমাল ওঠে। এত দুর্গন্ধে বসবাস করা তো দূরঅস্ত, আবার কেউ থাকতে পারে নাকি? উত্তরটা দিলেন ঈশান ঘোষ। ধাপার ওই আস্তাকুঁড়ে থেকেই খুঁটে খাওয়া এবং খেটে খাওয়ার লড়াই জারি রাখার মানুষগুলোকে তুলে ধরলেন ঠান্ডা ঘরের দর্শকদের সামনে।
বকুল, গণেশ, শম্ভু, চম্পারাও সমাজের একেকটা সংগ্রামী প্রান্তিক মানুষদের প্রতিভূ হয়ে উঠল ঈশানের হাত ধরে। দুর্গন্ধযুক্ত বাসের মাঝেই যারা বেঁচে থাকার সুবাস খুঁজে পায়। শহরের হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের জ্বলতে থাকা আলো আর আকাশে উড়ে যাওয়া বিমানের শব্দ ওদের লম্বা ইচ্ছে-ডানা মেলার ইন্ধন জোগায়। আবার কখনও বা গণেশ-বকুলদের স্মরণ করায় ওরা কতটা ভিখাড়ি। প্রত্যেকেরই চাওয়া বলতে এক দুর্গন্ধমুক্ত জীবন।
স্বপ্ন দেখার সাহস যে কখনও কখনও বন্ধুদেরকেও মিথ্যে বলতে ইন্ধন জোগায় তা 'ঝিল্লি'তে শম্ভুর চরিত্রের মধ্য দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছেন ঈশান ঘোষ। চাকরি না পেয়েও লোভনীয় প্যাকেজের কথা সে পাড়ে দুই বন্ধুর কাছে। বেকারত্বের জ্বালা, মানসিক অস্থিরতা, নেশায় আসক্তি জীবনের বিপদসঙ্কুল খাদগুলো চিত্রনাট্যের নিখুঁত খাঁজে ধরেছেন পরিচালক। একরাশ হতাশা, চাওয়া-পাওয়া আর কিছুটা আশার গল্প 'ঝিল্লি'।
ক্যামেরা, সম্পাদনার কাজ পরিচালক ঈশান ঘোষ নিজেই সামলেছেন। এবং খুব দক্ষতার সঙ্গে। মৃত জন্তুর হাড়ের পাহাড়ের ওপর শুয়ে থাকা চরিত্র ক্ষয়ে যাওয়া মনঃস্তত্ত্ব থেকে উঠে দাঁড়ানোর পাঠ দেয়। প্রতিটা মুহূর্তে ক্য়ামেরার ধাওয়া করার বিষয়টি 'ঝিল্লি'র সিনেম্যাটোগ্রাফিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। চরিত্রদের সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরাও ছুটছে। ছুটছে পচা-গলা জীবনযাপনের অলি-গলির মধ্য দিয়ে। বাজেট না থাকা সত্ত্বেও পরিচালক ও তাঁর বন্ধুদের সৎ প্রয়াস 'ঝিল্লি'কে যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
পরিচালক গৌতম ঘোষের সুপুত্র ঈশান 'ঝিল্লি' দেখিয়ে পরবর্তী ছবির প্রতি আরও প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিলেন। তথ্যচিত্রের আদলে বড়পর্দায় দেড়ঘণ্টায় এক অন্ধকার, অচেনা জগতের হদিশ দিলেন। উল্লেখ্য, ২৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা ছবির পুরস্কার জিতে নিয়েছে ঈশান ঘোষ পরিচালিত 'ঝিল্লি'। পরিচালক হিসেবে তাঁর পয়লা প্রচেষ্টা দেখেই দক্ষতার আন্দাজ করা যায়। তাছাড়া বাবা গৌতম পরিচালিত 'শঙ্খচিল', 'রাহাগিড়'-এর মতো সিনেমায় সহকারী পরিচালনায় তাঁর হাত পাকানো যে বিফলে যায়নি, মুগ্ধ দর্শকদের প্রতিক্রিয়াই তার প্রমাণ।