কতটা পথ হাঁটলে ভালবাসার মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যায়? 'বেলাশেষ'-এর পর 'শুরু'র ঠিকানাটা ঠিক কোথায়? পরিচালকজুটি শিবপ্রসাদ-নন্দিতা আবারও ভালবাসার নয়া সমীকরণ বুনলেন সৌমিত্র-স্বাতীলেখার 'বেলাশুরু'র হাত ধরে। কতটা খাসা হল সেই বুনন? লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
সিনেমা নয়, এ যেন আস্ত এক মনস্তত্ত্বের পাঠ। আম দর্শকের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে শিবু-নন্দিতা যে বেজায় সিদ্ধহস্ত, তা এযাবৎকাল তাঁদের কাজ-ই বাতলে দিয়েছে। সিনেমার জটিল ব্যকরণের ধাঁধায় না গিয়ে সহজ-সরল ন্যারেটিভেই বারবার বাজিমাত করেছেন তাঁরা। অতিনাটকীয়তা, কাকতালীয় বিষয়, যুক্তিবুদ্ধির মারপ্যাঁচ বর্জিত আবেগঘন দৃশ্যায়ণে দর্শককে ভুলিয়ে রাখতে শিবু-নন্দিতার কলম-ক্যামেরা বরাবারই সাবলীল। 'বেলাশুরু'র ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। অ্যালঝাইমার্স, যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় বিস্মরণ-এহেন একটা বিষয়ের আঙ্গিকে পারিবারিক গল্প বুনেছেন শিবু-নন্দিতা। যেখানে ভালবাসা, সম্পর্কের পাঠও দিলেন পরিচালকজুটি।
বর্তমান সমাজে যেখানে প্রেম-বিয়ে কিংবা যে কোনওরকম সম্পর্কেই চিঁড় ধরার প্রবণতা সিংহভাগ, সেই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে 'বেলাশুরু' বলে দিল- সময় থাকতেই সম্পর্ককে আগলান, নতুবা ভবিষ্যতে অনুশোচনায় ভুগতে হতে পারে। আধুনিক সমাজে সম্পর্কের সমীকরণে যেখানে মনের থেকে শরীরী টানের পাল্লা ভারী, সেখানে দাঁড়িয়ে সিনেমার চরিত্র মিলির মুখ থেকে পরিচালকজুটি বলিয়ে নিলেন- "একটা সময় পরে শরীর থাকে না, আকর্ষণ থাকে না। যেটা থেকে যায় বন্ধুত্ব…।" যে বন্ধুত্বে ভর করে হাতে হাত রেখে কাটিয়ে দেওয়া যায় গোটা জীবন।
গল্পের নায়ক বিশ্বনাথ সরকারও (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) 'বেলাশেষে' যে জীবন বৈচিত্রের খোঁজে বাহিরমুখো হতে চেয়েছিলেন, সেই তিনিই 'বেলাশুরু'তে এসে পুরোপুরি সংসারমুখো হয়ে উঠলেন। কয়েক দশকের বৈবাহিক জীবনে স্ত্রী আরতিকে (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) না দিতে পারা সময়গুলোই তাঁকে আরও বেশি করে অনুশোচনার পথে টেনে নিয়ে গিয়েছে। আ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত আরতিকে 'সোহাগে আদরে' রাখতে গিয়ে প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠলেন স্বামী বিশ্বনাথ। স্ত্রীর বিস্মরণ তাঁকে ভাবিয়ে তুলল কতটা পথ হাঁটলে আবার ভালবাসার মানুষটিকে কাছে পাওয়া যাবে, সে আবার চিনতে পারবে তাঁকে?
‘বেলাশুরু’ এক চিরন্তন প্রেমের গল্প। শেষ থেকে শুরুর গল্প। ভালবাসা কী? প্রেমের উদযাপন-ই বা কী? গোটা সিনেমাজুড়ে পাঠ দিলেন সৌমিত্র-স্বাতীলেখা জুটি। জীবনের কঠিনতম দিনেও ভালোবাসার মানুষকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার স্বাদ মিলেছে কখনও? শিবু-নন্দিতার এই ছবি দেখতে বসে বারবার সেই প্রশ্ন-ই মনে ঘুরপাক খায়।
বিশ্বনাথ-আরতির চার সন্তানের সম্পর্ককেও নতুন করে তুলে ধরলেন পরিচালকজুটি। মিলি-বিজন (ঋতুপর্ণা-সুজয়প্রসাদ) যেখানে পারিবারিক ইচ্ছের শিকার, সমকামি স্বামীর সঙ্গে বিনা-সুখের দাম্পত্যেও মিলি খুঁজে পেয়েছে এক ভাল বন্ধুকে। আর তাই বারবার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ালেও মিলি-বিজনের কেউই কাউকে ছাড়তে না পারে না সেই টানে। ব্যস্তজীবনে হাজারও ঝগড়ার মাঝে সেখানে দাম্পত্য টিকিয়ে রাখার পাসওয়ার্ড পিউ-পলাশ (মনামী-অনিন্দ্য) জুটি। ছেলে-বউমা বারিন-শর্মিষ্ঠাও তাঁদের ঘুন ধরা ডিভোর্সি সম্পর্কের বাঁক ফিরে দেখল কর্তব্যের খাতিরে। গহীন-হৃদয় মন্থনে হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার আঁচ উপলব্ধি করতে পারল। বড়মেয়ে-জামাই অপরাজিতা-খরাজের রসিক দাম্পত্যও বেশ উপভোগ্য। সিনেমার কমিক এলিমেন্ট এই জুটিই।
বিস্মরণে আক্রান্ত আরতির স্মৃতি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে তাঁর স্বামী বিশ্বনাথ ও সন্তানেরা যেভাবে চেষ্টা করেন, সে শৈশবের ভিটে ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে আবারও বৃদ্ধ দম্পতির বিয়ে দেওয়া, সেই গল্প যেন বারবার দর্শককে মনে করায়- 'হাল ছেড়ো না বন্ধু'। গোটা সিনেমাটা দেখতে দেখতে মনে হয় এই বুঝি আরতির স্মৃতি ফিরে এল… একেবারে ক্লাইম্যাক্স অবধি অপেক্ষা করিয়ে রাখেন পরিচালকজুটি। বিয়ের প্রস্তুতি, ছাদনাতলা সাজানো, জল সইতে যাওয়া, সোহাগ কুড়নোর পর শুভদৃষ্টির সময় একবার হলেও মনে হয় আরতি বুঝি এবার স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে চিনতে পারবেন! কিন্তু তেমনটা ঘটেনি। আর এখানেই পরিচালকজুটি শিবু-নন্দিতার স্বার্থকতা। নাটকীয় মোড় ঘুরেও কোনও অতিকথন জোড়েননি শেষে।
হবে হ্যাঁ, বর্তমান সমাজে যৌথ পরিবার যেখানে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে, নিউক্লিয়ার ফেমিলি কনসেপ্টেই বিশ্বাসী সিংহভাগ মানুষ। সেই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে এই সিনেমা দেখে বেরিয়ে এসে আলাদা থাকা কোনও সন্তান কিংবা দূরদেশে থাকা ছেলে-মেয়েরা একটা বারের জন্য হলেও মা-বাবাকে ফোনে ধরবেন। আসলে আজকালকার ব্যস্তজীবনে রাখার বিষয়টাই তো উবে গিয়েছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন