- পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী এযুগের অন্যতম ভারতীয় চিত্র পরিচালকের
সৌরদীপ সামন্ত
মৃত্যু যে কতটা নিষ্ঠুর, তার জ্বলন্ত উদাহরণ বোধহয় ২০১৩ সালের ৩০ মে। টলিউড তো বটেই, এমনকি ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কাছে নক্ষত্রপতন বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। তাঁর অকালপ্রয়াণে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল পাঁচ বছর আগে, তা আজও 'আবহমান'। আজও তাঁর শোকে 'দহনের' শিখা জ্বলছে। না, তাঁর নায়িকারা কখনই তাঁর 'চোখের বালি' ছিলেন না, বরং ছিলেন 'হীরের আংটির' চেয়েও দামি। তাঁর হাত ধরে আর কোনও ছবির 'শুভ মহরৎ' হয় না। তাঁর ছবিতে কাজ করার সুযোগ পাওয়ার আনন্দ, যে কোনও বড় উৎসবের আনন্দের থেকে কোনও অংশে কম নয়। তাঁর ছবির চরিত্রগুলো খুব বাস্তব, কাল্পনিক নয় ঠিক। তিনি হঠাৎ চিরঘুমে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর মনের 'অসুখের' কতখানিই বা খবর রাখতে পেরেছিলাম আমরা?পাঁচটা বছর পার, তিনি নেই, তিনি, মানে ঋতুপর্ণ ঘোষ। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে বিশেষ নিবেদন আমাদের।
আরও পড়ুন: ঋতুপর্ণর জন্য ‘সিজনস গ্রিটিংস’
লোকে বলে, নারী চরিত্র বেজায় জটিল। 'দহনের' রোমিতা হোক বা 'বাড়িওয়ালির' মালতি, নারী মনকে বোধহয় তাঁর মতো করে কেউ বুঝতেন না। আজও তাঁকে মিস করেন তাঁর 'উনিশে এপ্রিলের' ডাঃ অদিতি সেন (দেবশ্রী রায়), 'দহনের' ঝিনুক (ইন্দ্রাণী হালদার), 'চোখের বালির' আশালতা (রাইমা সেন), 'আবহমানের' শিখা (অনন্যা চট্টোপাধ্যায়), 'বাড়িওয়ালির' মালতি (সুদীপ্তা চক্রবর্তী)। ঋতুপর্ণ ঘোষের এই পাঁচ চরিত্রের রিয়েল লাইফ অবতাররা স্মৃতিচারণা করলেন তাঁদের প্রিয় ঋতু বা ঋতু দা কে নিয়ে।
দেবশ্রী রায়: আজও উনিশে এপ্রিলের কথা মনে পড়ে, অসুখের কথা মনে পড়ে, একসঙ্গে কাজ করার কথা মনে পড়ে। একজন মহিলার অনুভূতিগুলি খুব ভাল করে বোঝাতে পারত ও। ওর ব্যক্তিগত জীবন হয়তো সুখময় ছিল না, তাই অকালেই চলে যেতে হল ওকে। সবারই জীবনে ওঠা-নামা থাকে, সেটাকে ও যদি ওভারকাম করতে পারত, তাহলে হয়তো আরও কিছুদিন ওকে পেতাম, আরও ভাল ভাল কাজ দেখতে পেতাম। আমাদের সম্পর্কটা এমন ছিল যে এই ঝগড়া হল তো আবার এই ভাব হল। ও যেখানেই থাকুক, ভাল থাকুক।
ইন্দ্রাণী হালদার: ওঁর জায়গা আমার জীবনে সবসময় আলাদা হয়ে থাকবে। দহনের হাত ধরে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। আমার কাছে চিরকালই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ব্যক্তিগত ভাবেও খুব ভাল সম্পর্ক ছিল ওঁর সঙ্গে। ওঁকে আজও খুব মিস করি। পাঁচ বছর কেন, পঞ্চাশ বছর পরেও ওঁকে মনে রাখবে সবাই। উনি অ্যাক্টরস ডিরেক্টর। বিশেষত, উনি মেয়েদের কমন সাইকোলজি খুব ভাল বুঝতেন। যে কোন কাউকে দিয়েই উনি সুন্দর অভিনয় করিয়ে নিতেন। এই অসামান্য ক্ষমতাটা ছিল ওঁর। আজ উনি নেই, এখন মনে হয়, কত কী যে পেলাম না। উনি থাকলে নতুনরা আরও অনেক কিছু শিখত। ওঁর এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা আজও মানতে পারি না।
রাইমা সেন: আমি খুব মিস করি ওঁকে। উনি শুধু আমার পরিচালক ছিলেন না, আমার গাইড ছিলেন। বন্ধুর মতো ছিলেন। পেশাদার জীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও গাইড করতেন। যা শিখেছি, ওঁর থেকে শিখেছি। আমি খুবই ভাগ্যবতী যে ওঁর সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি। উনি খুব ভাল শেখাতে পারতেন। ওঁর সঙ্গে যে কেউ কাজ করলেই ভাল অভিনেতা হয়ে যেতেন। ওঁর মতো ছবি আজ আর সেভাবে দেখি না, যেখানে নারীরা সবসময় গুরুত্ব পেয়েছে। নায়িকাদের খুব ভালবাসতেন। এখন আর বুঝতে পারি না, নতুন করে কী শিখব। মাঝেমাঝে 'নৌকাডুবির' গানগুলো দেখি। ইউটিউবে ভিডিওগুলো দেখি। আমার কাজ দেখি। বাইরে থেকে যখনই কেউ আমার সঙ্গে দেখা করেন, বলেন যে ঋতুপর্ণর ছবিতে তোমাকে সবচেয়ে ভাল লাগে।
অনন্যা চট্টোপাধ্যায়: কথায় কথায় ঋতুদা’র কথা মনে হয়। ঋতুদা’র কাজ এমনভাবে ছাপ ফেলেছে, যে তা মুহূর্তে মুহূর্তে ভেসে উঠবে। মেয়েদের ইমোশন ওঁর মতো করে আর বোধহয় কেউ বোঝেননি। ঋতুদা মেয়েদের লড়াইকে বুঝতেন। ঋতুদা’র ছবিতে আমি একজন (বা একাধিক) নারী চরিত্রকে এমন ভাবে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছি, যাতে করে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। জাতীয় পুরস্কার না পেলেও, কাজটা কাজই থাকত। ঋতুদা ঋতুদাই থাকতেন, আছেন, থাকবেন। ভাল থেকো ঋতুদা, অনেক আদর।
সুদীপ্তা চক্রবর্তী : দর্শক হিসেবে ঋতুদা'র ছবি মিস করি। ঋতুদা'র স্ক্রিপ্ট মিস করি। অমন স্ক্রিপ্ট তো এখন আর লেখা হয় না। ব্যক্তিগত বা পেশাদার জীবনে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ও খুব মিস করি ওঁকে। ওঁর মতো করে কেউ এত ডিটেলিং করেন না। ঋতুদা'র সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। উনি সারাক্ষণই স্মরণে থাকেন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথাবর্তার সময়েও উনি চলে আসেন। আমার ধারণা, আমার মত হাজার হাজার মানুষ ওঁকে স্মরণ করেন। ওঁকে সারবছরই সবাই স্মরণ করেন।