Advertisment

'বাংলার আবার এপার ওপার কী?' কত আগেই বাঙালিকে জানান দিয়েছিলেন

বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ সেই 'ভাবা প্র্যাকটিস' করল বটে, কিন্তু ঋত্বিককে এপার থেকেই বলে যেতে হলো - "ওই যে আমাদের গ্রাম, ওখানেই আমাদের বাড়ি ছিল, কিন্তু কোনোদিন আমি আর ওখানে যেতে পারব না।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Ritwik Ghatak Bengali film maker. Express archive photo.

ঋত্বিক ঘটক। ছবি: এক্সপ্রেস আর্কাইভস

খ্যাপাটে, লোকটা বড্ড খ্যাপাটে, তা না হলে মানুষের জন্যে চিৎকার করে? বিনিময়ে শূন্যতা ছাড়া কিছুই এল না যার হাতে। কেবল লেকের ধারে পা ডুবিয়ে বসে নিজের লেখা লাইনগুলোই শুধু মাথায় আসে ভবার।

Advertisment

"মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।

এইভাবে, পৃথিবীর ইতিহাস বারবার

বদলে গেছে,

তবুও মানুষ, সবসময় বেঁচেছে।

মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।"

ভবা নদীর ওপারে তাকিয়ে থাকে। হাঁটুর উপর তুলে রাখা পায়জামাতে কাদা। ইছামতী নদীর ধারে তখন জ্যোৎস্না রাত। ভবার চোখ বাংলা মদের নেশায় লাল। হেঁটে যায় মাইলের পর মাইল। তাকে মানুষ দেখে, আবার কখনও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অথচ এই লোকটাই একসময় চিৎকার করে বলেছিল, "মাতামাতি! বাংলাকে ভেঙে চুরমার করে দিল, আর মাতামাতি! বিক্ষুব্ধ সময়ে মুজরো করব? এটা বদমাইসি! চাই, খুব বেশি করে চাই দুই বাংলার সংস্কৃতিকে এক ফ্রেমে আঁটতে। প্রতিবাদ করাটা দরকার। কিন্তু শালা বুঝল না কেউ।"

meghe dhaka tara মেঘে ঢাকা তারা-র একটি দৃশ্য। ছবি: এক্সপ্রেস আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন, ‘ধর্মযুদ্ধ’-এর মুখোমুখি রাজ চক্রবর্তী, প্রকাশ্যে ছবির লুক

সত্যিই ভবাকে কেউ বুঝতে পারেনি। ২০১৩-র কমেলশ্বর মুখোপাধ্যায়ের 'মেঘে ঢাকা তারা'-র সংলাপ- "দুর্গা ছবিটা কেউ বুঝল না রে, কেউ বুঝল না!" কে তিনি? যাঁর পরের পর ছবি ফ্লপ। 'অযান্ত্রিক' (১৯৫৮), 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' (১৯৫৮), 'তিতাস একটি নদীর নাম' (১৯৭৩)-কর্মাশিয়ালি কোনও ছবি দাঁড়াতে পারেনি। দেশভাগের যন্ত্রণা, আর এক দেশ থেকে রিফিউজি হয়ে আরেক দেশে আসা।

আজ এতদিন পর, কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শ্যামল কর্মকার এবং বাংলাদেশের পরিচালক আক্রম খান পেতে চলেছেন ঋত্বিক ঘটক সাম্মানিক পুরস্কার। বাংলাদেশে এই পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠান হবে তাঁর জন্মদিনেই। হ্যাঁ, আজ ঋত্বিক ঘটকের জন্মদিন।

publive-image 'সুবর্ণরেখা' ছবির একটি দৃশ্য

আরও পড়ুন: প্রসঙ্গ মিটু: আমি কাউকে কতটা অনুমতি দেব সেটা ভাবতে হবে

নাটকের সূত্রেই সিনেমায় প্রবেশ তাঁর। নিমাই ঘোষের 'ছিন্নমূল' ছবিতে সহকারি হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। সেই ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৫২ সালে প্রথম ছবি তৈরি, নাম 'নাগরিক'। কিন্তু মুক্তি পায়নি সে ছবি। ছয় বছর পর তৈরি করেন 'অযান্ত্রিক' ও 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'। ট্যাক্সি ড্রাইভার বিমল ও তার পুরনো গাড়ির মধ্যে সম্পর্ক নিয়েই তৈরি 'অযান্ত্রিক'। যন্ত্র সভ্যতায় কী ভীষণ একা মানুষ! ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রশংসতি হয়েছিল এই ছবি। এদিকে শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প অবলম্বনে তৈরি ছবি 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'।

এরপর মুক্তি পায় 'মেঘে ঢাকা তারা' (১৯৬০)। পূর্ববঙ্গের এক পরিবার। এদেশে আসার পর মেয়ে নীতার উপার্জনেই চলে সংসার। দারিদ্র্য কীভাবে মানুষকে নিংড়ে নেয়, তারই প্রতিলিপি এই ছবি। এরপর একে একে 'কোমল গান্ধার' (১৯৬১) ও 'সুবর্ণরেখা' (১৯৬২)। পুণে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটেও শিক্ষকতা করেছেন ঋত্বিক। ১৯৬৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করে।

আরও পড়ুন: কলকাতার শুটিং স্পটের ‘হেরিটেজ টুর’, বিশেষ চমক চলচ্চিত্র উৎসবের

অধুনা পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি-র ভয়ে মানুষ আত্মহত্যা করছেন, অথচ কত আগেই তিনি বাঙালিকে জানান দিয়েছিলেন, "বাংলার আবার এপার ওপার কী?" ১৯৫২ সালের 'নাগরিক'-তার অর্থ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল কাণ্ডারির মৃত্যুর পর। 'কোমল গান্ধার' ও 'সুবর্ণরেখা' - দারিদ্র, দেশভাগের কথা বলে। তবে সেই সময়ে ফ্লপ করেছিল ছবি।

নিজের তৈরি তথ্যচিত্রেও দেশভাগের যন্ত্রণা ছিল - 'আমার লেনিন', 'দ্য লাইফ অফ দ্য আদিবাসিজ', 'ফিয়ার', 'দুর্বার গতি পদ্মা'-রয়েছে সেই তালিকায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ সেই 'ভাবা প্র্যাকটিস' করল বটে, কিন্তু ঋত্বিককে এপার থেকেই বলে যেতে হলো - "ওই যে আমাদের গ্রাম, ওখানেই আমাদের বাড়ি ছিল, কিন্তু কোনোদিন আমি আর ওখানে যেতে পারব না।"

Bengali Cinema
Advertisment