ফাঁকা প্রান্তর, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ধু-ধু করা হাইওয়ে, পাশেই ঝাঁ-চকচকে হুব্বা নামডাকওয়ালা এক রেস্তরাঁ- 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি'। হইচই-এর সুবাদে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়-এর সেই 'স্পেশ্যাল মেন্যু' থুড়ি সিরিজ চেখে দেখার সুযোগ হল বটে! কিন্তু রসনা আস্বাদনের পর কতটা তৃপ্তির ঢেকুর তোলা গেল? জেনে নেওয়া যাক। লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
সুন্দরপুর, প্রত্যন্ত গঞ্জ। সেখানেই এক ডাকসাইটে বিলাসবহুল রেস্তরাঁ। তবে সেই খানদানি হোটেলের খাবারের যা খ্যাতি, তার থেকেও প্রসিদ্ধ তাহার মালকিন মুসকান জুবেরি। অতীব রহস্যময়ী। রবীন্দ্রনাথ তার শয়নে-স্বপনে। নাইতে-উঠতে সবেতেই তিনি ভানুসিংহ-ভক্ত। রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরাও সেই লাস্যময়ীর অঙ্গুলিহেলনে চলেন। যার রেস্তরাঁ নিয়ে খবর করার অছিলায় শহর থেকে সাংবাদিকের পরিচয় দিয়ে আসেন এক ব্যক্তি। তিনি নিরুপম চন্দ। তার অনুমান মুসকান খুনী। অন্তত ৫ জন মানুষকে খুন করেছেন। আর সেই instinct-কে কাজে লাগিয়ে তদন্তে নেমে পড়েন। ঘটনাচক্রে প্রথমদিনই আলাপ হয় 'খবরি' আতর আলির সঙ্গে, যাকে কিনা সুন্দরপুরের 'স্থানীয় বিবিসি' বললেও অত্যুক্তি হয় না। কার ঘরে কয় কৌটো চাল রয়েছে থেকে কার খাটের তলায় কে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে, সব খবর সেই খোচরের নখদর্পনে থাকে। ব্যাস! অমনি নিরুপম-আতর মিলে শুরু করে জমিদার বাড়ির রহস্যময়ী মালকিন মুসকানের বিরুদ্ধে তদন্ত। পুলিশের কাছে ধরাও পড়ে। তারপরই ফাঁস হয় নিরুপমের আসল পরিচয় (সেটা এখানে না ভাঙাই বাঞ্ছনীয়)। তবে সিরিজের 'স্পয়লার' না দিলেও একটা কথা অবশ্যই উল্লেখ্য যে, রক্তচোষা ডাইনি থেকে কালাজাদু, খুন, রেস্তরাঁর মাংসের স্বাদ, ক্যানিবালিজম… ট্রেলারে এহেন রহস্য-রোমাঞ্চ, গা ছমছমে থ্রিলার এলিমেন্টের স্বাদ দেওয়া সত্ত্বেও 'আশা জাগিয়ে শেষমেশ করলে তুমি মোরে নিরাশ'!
অভিব্যক্তি কিংবা সংলাপ কেতাদুরস্থ হলেও পরিবেশনে খানিক তাল কাটল মুশকান জুবেরির। যে ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত নায়িকা আজমেরী বাঁধন হক। তাঁর চরিত্রটিই REKKA অর্থাৎ 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি' (Robindronath Ekhane Kawkhono Khete Aashenni) সিরিজের রহস্যের মূল উপকরণ। হেঁশেলে গুছিয়ে সব উপকরণ-ই ছিল, কিন্তু কড়াইতে পড়তেই সম্ভবত গুলিয়ে ফেলেছেন পরিচালক। যার বিরুদ্ধে পাঁচ-পাঁচটা খুনের অভিযোগ, গোটা সিরিজটা যে রহস্য জিইয়ে রেখে টেনে যাওয়া হয়েছে, সেই মহিলা কীভাবে খুনগুলো করলেন, সেসবের যোগসূত্র-ই বা কী? সেই রহস্যোদঘাটনের স্বাদ আর পাওয়া গেল না।
অনিবার্ণ ভট্টাচার্য, রাহুল বোস, অঞ্জন দত্ত, আজমেরী বাঁধনের মতো একাধিক দক্ষ অভিনেতারা থাকলেও রহস্যের শিথীল বুনোটে সবটাই ডুবেছে বলা চলে। জমিদার বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের খেতে না আসার গল্প সিরিজে এমনভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে, শেষমেশ সেটার কোনও তাৎপর্যই পাওয়া গেল না। ট্রেলার দেখে দর্শক যদি REKKA'র গল্পে ক্যানিবালিজমের রহস্য-রোমাঞ্চ খুঁজতে যান, তাহলে হতাশ হতে হবে। কারণ, পরিস্থিতির কোপে নরখাদক বিষয়টি দেখানো হলেও তা মনে খুব একটা স্পর্শ করার মতো নয়। সিরিজে রাহুল বোসকে খানিক জবুথবু মনে হল। অভিনেত্রী আজমেরীর চলন-বলন, সংলাপে চমক থাকলেও চরিত্রের গভীরতা নেই। অঞ্জন দত্ত পরিমিত। তবে 'কেল্লাফতেহ' করেছেন আতর আলি অনির্বাণ। ওপার বাংলার ভাষা তাঁর মুখে যেমন দিব্যি মানিয়েছে, তেমনি খাসা চরিত্রের পরিবেশনও। মোট নয়টি পর্ব রয়েছে সিরিজে। একেকটির দৈর্ঘ্য ২৫-৩০ মিনিট। খুব দীর্ঘ নয়। সৃজিত মুখোধ্যায় পরিচালিত দ্বিতীয় সিরিজ 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি' দেখে নিতেই পারেন। তবে কিছু 'এক্স-ফ্যাক্টর'ও রয়েছে এই সিরিজের। কেন দেখবেন?
গোটা সিরিজে দেখার মতো কয়েকটি দৃশ্য রয়েছে। যেখানে বরফাবৃত পর্বতচূড়ায় প্ল্যান ক্র্যাশ-পরবর্তী দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে কিন্তু পরিচালক হলিউডি একটা ছাপ রেখেছেন। একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। পাশাপাশি রাতের অন্ধকারে কবর খোঁড়ার দৃশ্য কিংবা খাটের তলা থেকে যখন আতর আলি নরকঙ্কাল উদ্ধার করে, টর্চের আলোয় সেই দৃশ্য খুব নৈপুণ্যের সঙ্গে দেখিয়েছেন পরিচালক। উল্লেখ্য, এই সিরিজের গল্পে রহস্যের বুনোট হালকা হলেও লাইট, সেট ডিজাইন নিয়ে সৃজিত যে এক্সপেরিমেন্টটা করেছেন বেশ কয়েকটি দৃশ্যে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। তাই এই সিরিজটি দেখে নিতেই পারেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন