বাংলা বিনোদন জগতে সম্প্রতি যে ঘটনাটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তা হল রূপাঞ্জনা মিত্রের আনা একটি অভিযোগ। প্রাথমিকভাবে একটি সিনেমা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যে রূপাঞ্জনা মিত্র দুবছর আগে স্টার জলসা-র ধারাবাহিক 'ভূমিকন্যা'-য় কাজ করার সময় তিনি প্রযোজকের থেকে এমন কিছু ইঙ্গিত ও আচরণ পেয়েছিলেন যা শরীরী এবং তা যে কোনও নারীর পক্ষেই অসম্মানজনক। এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই ধারাবাহিকের প্রযোজক অরিন্দম শীল।
রূপাঞ্জনার অভিযোগ অনুযায়ী, ঘটনাটি ঘটেছিল ধারাবাহিকের শুটিং শুরু হওয়ার আগে এবং যেহেতু ওই ঘটনার কোনও প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না, তাই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র পক্ষ থেকে দুজনের কাছেই জানতে চাওয়া হয় ঠিক কী ঘটেছিল। স্বাভাবিকভাবেই দুজনের বক্তব্যের মধ্যে ব্যবধান থাকবে। এই প্রতিবেদনে দুজনের বক্তব্যই রাখা হল পাঠকদের উদ্দেশে।
আরও পড়ুন: প্রসঙ্গ মিটু: আমি কাউকে কতটা অনুমতি দেব সেটা ভাবতে হবে
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক, রূপাঞ্জনার বক্তব্য কারণ এই বিষয়ে প্রথম কথাটি তিনি বলেন এবং অভিযোগটি তাঁর দিক থেকেই আসে। অভিনেত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, 'ভূমিকন্যা'-র আগে অরিন্দম শীলের পরিচালনায় বা প্রযোজনায় তিনি কোনও কাজ করেননি। 'ভূমিকন্যা'-তে প্রথমে তাঁকে নেতি-র চরিত্রে কাস্টিং করা হয়। পরে চ্যানেলের পক্ষ থেকেই তাঁকে সনকার চরিত্রে চূড়ান্ত করা হয় কারণ তার আগে ওই চ্যানেলেরই ধারাবাহিক 'বেহুলা'-তে তিনি সনকার চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন।
ওই চরিত্রে কাস্টিংয়ের পরে তিনি অত্যন্ত উৎসাহিত ছিলেন এবং সেই কারণেই যখন প্রযোজক তাঁকে তাঁর অফিসে দেখা করতে বলেন, তখন পেশাগত প্রোটোকল মেনে তিনি সেখানে যান। কারণ একজন প্রযোজক বা পরিচালক যদি কোনও অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে শুটিং শুরু হওয়ার আগে তাঁর অফিসে দেখা করতে বলেন, তবে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অবশ্যই দেখা করেন।
রূপাঞ্জনার অভিযোগ, তিনি যাওয়ার আগে জানতেন না অফিসে আর কেউ নেই। ''আমি বলেছিলাম ৬টা নাগাদ যাব। উনি আমাকে বলেছিলেন আর একটু আগে এসো, পাঁচটা বা সাড়ে চারটে হলে খুব ভাল হয়। আমি জানতাম না ওই সময় অফিস ফাঁকা থাকবে। যাওয়ার পরে আমি দেখলাম অরিন্দম শীল তাঁর কেবিনে একাই বসে আছেন। পরে দেখলাম একজন বেয়ারা রয়েছেন। তাঁকে কিছু একটা কাজে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে উনি আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন'', বলেন রূপাঞ্জনা, ''আমি আসার পরে উনি আমাকে প্রথমেই আলিঙ্গন করেছিলেন। সেই আলিঙ্গনে যে কদর্য ইঙ্গিত ছিল, সেটা আমার অত্যন্ত আত্মসম্মানে লাগে। ওঁর কেবিনে অতিথিদের বসার জন্য একটি রিভলভিং চেয়ার রয়েছে। আমি সেখানে বসেছিলাম। উনি টেবিল থেকে উঠে আমার মাথায় এবং পিঠে অদ্ভুতভাবে হাত রাখেন। আমি তো একজন মা, আমি আমার বাচ্চাকে গুড টাচ-ব্যাড টাচ শেখাই। কাজেই কোন টাচের কী মানে, সেটা বোঝা যায়। এর পরে উনি পাশের কাউচে বসেন এবং বলেন ইউ কাম অ্যান্ড সিট বিসাইড মি। আমি যাইনি। আমি ওই চেয়ারেই বসেছিলাম। আমি যে উঠে যাব না ওঁর পাশে, সেটা উনি বুঝতে পেরেছিলেন। তার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওঁর স্ত্রী ওখানে আসেন। এবং অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকান। গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অস্বস্তিকর।''
আরও পড়ুন: প্রসঙ্গ মিটু: বাংলা নাটকে কোড অফ কনডাক্ট চাই
রূপাঞ্জনা কেন দুবছর পরে এই ঘটনাটির কথা তুললেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অরিন্দম শীল। এর উত্তরে অভিনেত্রী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে জানান, ''প্রত্যেকটা মানুষের ভিতর থেকে একটা ডাক আসে বড় কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার আগে। আমি সেই সময় চুপ করে ছিলাম বলে সব সময়েই চুপ করে থাকব সেটা তো নয়। আর আমি তো আগেই বলেছি যে আমি চ্যানেলের কনট্র্যাক্টে ছিলাম, আমি চাইনি এই বিষয়ে চ্যানেল কোনওভাবে জড়িয়ে যাক। এখন আমি আর কনট্র্যাক্টে নেই, তাই এখন কথাটা প্রকাশ করেছি। আমাকে অনেকেই টেক্সট করেছেন, ফোন করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আমরা যেটা পারিনি সেটা তুই করে দেখিয়েছিস। এই ধরনের প্র্যাকটিসগুলো তো এই ফিল্ডে অনেকদিন ধরে রয়েছে। এক প্রযোজক ছিলেন, নাম বলছি না। তিনি টেপ নিয়ে ঘুরতেন। সব অভিনেত্রীদের বুকের মাপ নিতেন। তিনি কিন্তু আজ ইন্ডাস্ট্রির বাইরে।''
অন্যদিকে অরিন্দম শীলের বক্তব্য, তিনি রূপাঞ্জনার আনা অভিযোগে অত্যন্ত আহত হয়েছেন কারণ তিনি কখনও কোনও নারীকে অসম্মান করেননি। সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে অরিন্দম শীল বলেছেন রূপাঞ্জনার এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পরিচালক-প্রযোজকের বক্তব্য, তিনি এমন কোনও কথা বলেননি। ওই সংবাদমাধ্যমটি তাঁর কথার ভুল ব্যাখ্যা করেছে এবং তাঁর জবানিতে ভুলভাবে কথাটি উপস্থাপিত হয়েছে।
''আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল এটা কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? আমি উত্তরে বলেছিলাম, যদি সেটা হয়ে থাকে, তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি কিন্তু এটা কখনও বলিনি যে রূপাঞ্জনা এই কারণেই কথাগুলি বলছেন'', ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে জানান অরিন্দম শীল। তাঁর বিরুদ্ধে আনা রূপাঞ্জনার অভিযোগ হল যেহেতু তিনি ওইদিন পরিচালকের মনোরঞ্জন করেননি, তাই পরিচালক গল্প ঘুরিয়ে দেন এবং তাঁর চরিত্রটির যতটা প্রাধান্য পাওয়ার কথা ছিল, ততটা দেওয়া হয়নি। প্রচারের পোস্টার থেকেও তাঁর ছবি বাদ দেওয়া হয়।
এই অভিযোগগুলির প্রসঙ্গে অরিন্দম শীল বলেন, ''প্রথমত রূপাঞ্জনার সঙ্গে কনট্র্যাক্ট ছিল চ্যানেলের। আমার সঙ্গে কোনও রকম শর্ত ছিল না। তাই প্রযোজক হিসেবে আমার মনোরঞ্জন করতে হবে এমন কোনও জায়গাই ছিল না। এর পরে ওর যা যা অভিযোগ যে গল্প ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে বা ওকে ঠিকমতো ব্যবহার করা হয়নি, সেই সব অভিযোগের উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ওগুলো চ্যানেলের কেউ বলতে পারবেন। বরং আমি সেই সময় এতটাই ছবির কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম যে 'ভূমিকন্যা'-তে কী হচ্ছিল সেই দিকে খুব একটা নজর দিতে পারিনি। সেই কারণে এত বড় লস হয় আমাদের। আর রূপাঞ্জনা তো ভাল কাজ করছিল, আমিও চেয়েছিলাম যে ও কাজ করুক। ও খুবই ভাল অভিনেত্রী।''
অভিনেত্রীর সঙ্গে ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ, তাঁকে শারীরিকভাবে স্পর্শ করার বিষয়ে তিনি বলেন, ''যদি সত্যিই সেদিন আমি ওকে অসম্মান করেই থাকি, তবে ও আমার অফিস থেকে বেরিয়ে কেন টেক্সট করল? কেন আমাকে জানাল যে ও চায় আমি ওকে গাইড করি। ও খুব হ্যাপি। আমি কি ওকে ফোর্স করেছিলাম? বা এর পরে যখন আমার বার্থডে পার্টিতে আসে, ওটা ইউনিটের দেওয়া একটা সারপ্রাইজ পার্টি ছিল। সেখানে আসতেও কি কেউ ওকে জোর করেছিল? ওর যদি এতটাই খারাপ লেগে থাকে তাহলে আমার সঙ্গে কোনও কমিউনিকেশন না রাখতে পারত। তার পরেও তো 'সত্যমেব জয়তে'-র ট্রেলার দেখে আমাকে জানিয়েছে ভাল লেগেছে। 'মিতিনমাসি'-র প্রিমিয়ারেও ইনভিটেশন পাঠানো হয়েছিল... আর ও যে কথাগুলো বলছে, আমি ওর পিঠে হাত দিয়েছি। আমি কিন্তু টেবিলের উল্টোদিকে বসে ছিলাম। আর সেদিন আমার অফিস মোটেই ফাঁকা ছিল না। আমার ইপি, অ্যাসিস্ট্যান্ট, অ্যাকাউট্যান্ট সবাই ছিল। আর আমার স্ত্রী ঢুকলেন কী করে যদি আমার ঘরের দরজা খোলা না থাকে?''
অরিন্দম শীলের এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে রূপাঞ্জনা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে জানান যে তিনি টেক্সট করেছিলেন, ওয়ার্কশপ করার কথা বলেছিলেন কারণ যে কোনও কাজের আগেই ওয়ার্কশপ করাটা জরুরি। তাই সেই কথা প্রযোজককে জানিয়েছিলেন। তবে তিনি আবারও জানিয়েছেন যে ওইদিন অফিসে আর কেউ ছিল না একজন ছাড়া যাঁকে পরে বাইরে পাঠানো হয়। জন্মদিনে যাওয়া প্রসঙ্গে অভিনেত্রী বলেন, ''আমি একা তো যাইনি। 'ভূমিকন্যা' ইউনিটের সবাই সেদিন গিয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম। ওটাও একটা পেশাগত জায়গা থেকেই। আর আমি ছিলাম মাত্র ২০ মিনিট। পেশাগত কিছু দায়িত্ব থাকে, আমি সেগুলো সব সময়েই মাথায় রাখি। আর উনি এক জায়গায় বলেছেন আমি নাকি ওঁর বন্ধু ছিলাম। আমি এটা স্পষ্ট করে দিই, আমি কোনওদিনই ওঁর বন্ধু ছিলাম না। উনি শুধুই আমার কলিগ।''
আরও পড়ুন: যা করেছি তাতে মিটুর দায়ে পড়ি নি: শত্রুঘ্ন সিনহা
অর্থাৎ দুই পক্ষই তাঁদের নিজের নিজের বক্তব্যে অনড় রয়েছেন। রূপাঞ্জনা বলছেন, তিনি অসম্মানিত বোধ করেছেন পরিচালকের হাবভাব, তাঁর আলিঙ্গন, আকস্মিক স্পর্শ ও কাউচে পাশে এসে বসার অনুরোধে। পরিচালক এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এর পরবর্তী পদক্ষেপ কি তবে প্রযোজকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ? রূপাঞ্জনা জানান, ''আমি চাই এই বিষয়টা নিয়ে আউট অ্যান্ড আউট যেতে কিন্তু আমার উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে সম্প্রতি। যিনি করেছেন তিনি অত্যন্ত ভদ্র মানুষ। তাঁকে অনেকদিন ধরে চিনি। তিনি চান আমরা সামনাসামনি কথা বলে বিষয়টা মিটিয়ে নিই। কিন্তু আমি এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।''
অরিন্দম শীল তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কিছু জানাননি। তাঁর বক্তব্য, ''সবাই তো খুব জাজমেন্টাল হয়ে যায়। আমাকে অনেকেই ফোন করছেন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কোনও মহিলা যদি এমন একটা কিছু বলেন, তাহলে সবাই সেটা প্রথমেই বিশ্বাস করে নেন। আমি আজ পর্যন্ত কোনও মহিলার অসম্মান করিনি, করতে পারব না। আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি।''