একটা সময় এমন ছিল যখন কোনও ছবিতে স্রেফ একটি নাচ বা গানের দৃশ্য দেখতেই টিকিট কাটতেন অজস্র দর্শক, এবং সেই দৃশ্য শেষ হলেই বেরিয়ে আসতেন প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে। এমনই এক ছবি ছিল এন চন্দ্র পরিচালিত, এবং অনিল কাপুর ও মাধুরী দীক্ষিত অভিনীত 'তেজ়াব' (১৯৮৮)। তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ছবিটি। তার একটা বড় কারণ ছিল এর নানাবিধ উপাদান, যেগুলি নিখুঁতভাবে মিশিয়েছিলেন পরিচালক। বাজার চলতি হিন্দি ছবির সবরকম রসদের সঙ্গে মিলেছিল এক অদ্ভুত এনার্জি। অনিল কাপুরের সাধারণ মানুষ থেকে যোদ্ধা হয়ে ওঠার ফর্মুলা তাঁর কেরিয়ারে এক নতুন গ্রাফের সূচনা করেছিল।
সর্বোপরি ছিলেন মাধুরী দীক্ষিত, ছবি মুক্তি পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যাঁর লাস্যময় 'এক দো তিন' হয়ে উঠেছিল সারা দেশের আইকন, যার ফলে রাতারাতি সুপারস্টার হয়ে উঠেছিলেন মাধুরী, এবং যার ফলে আজও তাঁকে অনেকসময়ই বলা হয় 'এক দো তিন গার্ল'। এই গানটি ছিল এক গৌরবময় কেরিয়ারের সূচনা, এবং একাধিক বার সিনেমাহলে ঢুকে 'তেজ়াব' দেখার কারণ। কিন্তু গানটিতে প্রাণদান করেছিলেন যে মানুষটি, তিনি সরোজ খান, যিনি শুক্রবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মুম্বইতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এমন নয় যে মাধুরীর অভিনয় দক্ষতার অভাব ছিল। তবে যে সময়ে তিনি প্রথম সারিতে আসার চেষ্টা করছেন, সেসময়ে প্রতিযোগিতাও ছিল প্রবল, বিশেষ করে শ্রীদেবী তখন তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছেন। রাজশ্রী প্রোডাকশনস প্রযোজিত মাধুরীর প্রথম ছবি 'অবোধ' (১৯৮৪) তলিয়ে গিয়েছিল বক্স-অফিসে। এর পর আরও কিছু টুকটাক ছবি করলেও সেগুলি কোনোরকম ছাপ ফেলেনি দর্শকের মনে। এর পরেই এলো 'তেজ়াব', এবং মাধুরী সটান উঠে গেলেন একেবারে পাহাড়চূড়ায়।
আরও পড়ুন: ‘বন্ধু ও গুরু’, সরোজের প্রয়াণে বিধ্বস্ত মাধুরী দীক্ষিত
প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে তখনও শ্রীদেবী, যিনি 'হিম্মতওয়ালা' (১৯৮৩) ছবির দৌলতে নিজের জায়গা কায়েম করে নিয়েছিলেন। দক্ষিণে ততদিনে বড়সড় নাম হয়ে গিয়েছেন শ্রীদেবী, এবং বলিউডেও রাজত্ব করতে তিনি তখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শেখর কাপুরের 'মিঃ ইন্ডিয়া' (১৯৮৭) ছবিতে আমরা তাঁকে দেখি এক অতীব আনাড়ি সাংবাদিকের ভূমিকায়, কিন্তু যাঁর চরিত্রের উদ্ভট রূপায়ণকে ছাপিয়ে যায় একটি অনবদ্য নাচের দৃশ্য। 'এক দো তিন'-এর চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না শ্রীদেবীর 'হাওয়া হাওয়াই'। উটপাখির পালকে নজিরবিহীন ভাবে ছয়লাপ ওই দৃশ্যের নেপথ্যে যে জিনিয়াস, তিনি ফের একবার সেই সরোজ খান।
সরোজ তাঁর নিজের কর্মজীবন শুরু করেন 'ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার' হিসেবে, যাঁদের সারা জীবন কেটে যায় 'হিরোইনের' পেছনের সারিতে নেচে। ক্যামেরার নজর থাকে মুখ্য চরিত্রের ওপর, কিন্তু জায়গা ভরান পার্শ্ব নর্তক-নর্তকীরা। সেই জায়গা থেকে উঠে আসেন সরোজ, এবং ক্রমশ হয়ে ওঠেন বলিউডের প্রথম মহিলা মুখ্য কোরিওগ্রাফার, যে সময় শব্দটির অর্থই অনেকের কাছে স্পষ্ট ছিল না। নিজে অসামান্য নাচতেন, এবং তাঁর নির্দেশে মাধুরী এবং শ্রীদেবীর মতো প্রশিক্ষিত নর্তকীরা হয়ে উঠতেন লীলায়িত, অথচ এনার্জি এবং আবেগে ভরপুর, এতটাই যে ক্যামেরা সরতে পারত না তাঁদের ছেড়ে।
আরও পড়ুন: সরোজ খানের কোরিয়োগ্রাফ করা সেরা গানের তালিকা
আরও একটি 'সরোজ খান স্পেশ্যাল' জুটেছিল শ্রীদেবীর ভাগ্যে - 'চাঁদনী' ছবির গান 'মেরে হাথোঁ মে', যে গান আজও বাজানো হয় বিয়েশাদীতে। আদিত্য চোপড়ার 'দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে' (১৯৯৫) ছবিতে সরোজ খানের যাদু ছুঁয়ে যায় কাজলকে, যার ফল 'মেহন্দি লগা কে রখনা'। এবং ১৯৯৯ সালে সঞ্জয় লীলা বনশালির 'হম দিল দে চুকে সনম' ছবিতে ঐশ্বর্য রাইকে সরোজ উপহার দেন 'নিম্বুড়া'।
তবে নিজের সেরাটা সম্ভবত মাধুরীর জন্যই তুলে রাখতেন সরোজ। যতই 'এক দো তিন গার্ল' হন মাধুরী, তিনি 'ধক ধক গার্ল'-ও বটে। আবার ১৯৯৩ সালে সুভাষ ঘাইয়ের 'খলনায়ক' ছবিতে মাধুরীর মাধ্যমে সরোজ প্রশ্ন তোলেন, 'চোলি কে পিছে ক্যায়া হ্যায়'। প্রাথমিকভাবে নিন্দার ঝড় বয়ে যায় সারা দেশে - গানের কথায় ছিল অশ্লীলতার আভাস, মাধুরীর বক্ষের ওঠানামার ওপর ছিল ক্যামেরার নজর (তাঁর সঙ্গে যে নীনা গুপ্তাও নাচছিলেন, তা প্রায় কেউই খেয়াল করেননি)। সি-গ্রেড হয়েই থেকে যেতে পারত এই গান, তবে শেষমেশ প্রতিষ্ঠিত হয় আইকন হিসেবেই। মূল কারণ নাচের চটুল ছন্দের সঙ্গে মাধুরীর লালিত্যের মিশ্রণ।
তাঁর নিজের যুগের আবহই গড়ে তুলেছিল সরোজকে, এবং বলিউডে পর্দার আড়ালের নারী-বিরোধী, পুরুষশাসিত সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই তাঁকে করে তুলেছিল শক্তিশালী। তাঁর ঘনিষ্ঠরা বলেন, সবসময় মনের কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতেন সরোজ, এবং এই ভয়ডরহীন মনোভাবই প্রতিফলিত হতো তাঁর কাজেও। তাঁর কোরিওগ্রাফির গুনেই পার্শ্বচরিত্র থেকে প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠতেন নায়িকারা। কোনোদিন হয়তো সরোজ খানের তাৎপর্য সম্পর্কে পাতার পর পাতা ভরাবেন সিনেমার ইতিহাসবিদরা। আপাতত আমরা চিরবিদায় জানাই এক কিংবদন্তীকে, যিনি তাঁর ছন্দে নাচাতে পারতেন হিন্দি ছবির যে কোনও শীর্ষ নায়িকাকে। 'রে ডোলা রে ডোলা রে ডোলা রে ডোলা...'
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন