সঞ্জয় লীলা বনশালির সিনেমা মানেই চোখ ধাঁধানো সেট, জমকালো পোশাক, লার্জার দ্যন লাইফ গোছের তারকাখচিত ফ্রেম। যেন শিল্পকলা, সৃজনশীলতার এক অনন্য প্রতীক তাঁর প্রতিটা ছবি। যেখানে শুধু সৃষ্টি-কলা নয়, সৌন্দর্য্যের এক অন্য সংজ্ঞাও ধরা পড়ে। পরিচালনার পাশাপাশি তিনি নিজে সেটের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি বিষয়ে কড়া নজর রাখেন। "বলিউডের আর কোনও পরিচালক সেটের বিষয়ে এতটা খুঁতখুঁতে কিনা, সন্দেহ!"- বলছেন 'গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াওয়াড়ি'র দুই শিল্প নির্দেশক অমিত রায় ও সুব্রত চক্রবর্তী।
ইতিমধ্যেই ১০০ কোটির ব্যবসা করে ফেলেছে সেই ছবি। তবে কামাথিপুরা যে গল্পের প্রেক্ষাপট, সেই পতিতাপল্লী তৈরি করা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল? 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা'কে নেপথ্যের কাহিনি শোনালেন 'গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াওয়াড়ি' সেটের দুই কারিগর অমিত-সুব্রত। লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ
২০২০ সাল। বনশালি তখন সদ্য সলমন খানের সঙ্গে নতুন একটা ছবির কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু হঠাৎই সেই সিনেমার কাজ থেমে যাওয়ায়, উনি ডাক পাঠালেন দুই সেট ডিজাইনারকে। অমিত-সুব্রতর কাছে খবর গেল, গাঙ্গুবাঈয়ের শুট শুরু করতে চান পরিচালক। এদিকে অমিত-সুব্রতর হাতে তখন সময়ও কম। রেকি-রিসার্চের পর দিন-রাত এক করে গোটা কামাথিপুরা পতিতাপল্লী তৈরি করতে সময় লেগে গেল ৪৫ দিন। গোরেগাঁও ফিল্ম সিটির (দাদাসাহেব ফালকে চিত্রনগরী) সুনীল ময়দানে মোট ৫ একর এলাকাজুড়ে সেট তৈরি করার কাজ খুব একটা সহজ ছিল না। প্রতিদিন ১৫০০ লোক কাজ করতেন সেটে।
১১ বছর ধরে বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন অমিত রায় ও সুব্রত চক্রবর্তী। শুরুটা খ্যাতনামা শিল্প নির্দেশক সমীর চন্দর হাত ধরে হলেও, ২০১১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সেই ঘরানা বহন করার দায়িত্ব বাঙালি এই দুই সেট ডিজাইনার-ই গর্বের সঙ্গে পালন করে আসছেন। তাই তো বিশাল ভরদ্বাজ, মণিরত্নমের মতো ডাকসাইটে পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার পর ডাক আসে বনশালির তরফে। 'পদ্মাবত'-এর সেট ডিজাইন করে 'পারফেকশনিস্ট পরিচালক' বনশালিকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন অমিত রায় ও সুব্রত চক্রবর্তী। অতঃপর 'গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াওয়াড়ি' করার সময়ও নিশ্চিন্তে তাঁদের কাঁধেই দায়িত্ব তুলে দিলেন পরিচালক।
গাঙ্গুবাঈয়ের সেট তৈরির আগে বনশালির সঙ্গে দু'বার আসল কামাথিপুরায় ঘুরে এসেছেন অমিত-সুব্রত। পরে ওই এলাকা সংলগ্ন ফলকল্যান্ড রোডেও রেকি করতে যান নিজেরা। সুব্রত জানালেন, কালের নিয়মে এখনকার কামাথিপুরার চেহারা বদলালেও সেই সময়কার বেশ কিছু ছবি রেফারেন্স হিসেবে কাজ করেছে। সিনেমায় পতিতাপল্লীর দোকানের সেটগুলোর ডিটেলিং করা ছিল আরও চ্যালেঞ্জিং। পঞ্চাশ-ষাটের দশকেও কামাথিপুরায় চাইনিজ দাঁতের ডাক্তারের চেম্বার, থিয়েটার.. এসব ছিল। এখনও ওগুলোর বেশ কয়েকটা অবশিষ্ট রয়েছে যদিও, গাঙ্গুবাঈয়ের সেটে সেটাও তৈরি করেছি। রেকি-ফটো রেফারেন্স ছাড়াও ওই এলাকার পুরনো বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিলাম যে, সেসময়ে কোঠাগুলোয় মেয়েদের রাখার জন্য কীরকম খাঁচা থাকত কিংবা বড় দালান ছিল। যেখানে অবসরে মহিলারা বসে আড্ডা দিতেন।
"বনশালি এমনভাবে গল্পটা পড়েন, মাথায় স্কেচ হয়ে যায় পুরো সেটটা। ওঁর সঙ্গে এখন একটা ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেটসজ্জা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে মাঝেমধ্যেই ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা তুলতেন। সেটের প্রত্যেকটা প্রপস, কালার নিয়ে নিখুঁত অবসারভেজশন ওঁর। সব বিষয়ে জ্ঞান রয়েছে। আর কিছু না বুঝলেও জিজ্ঞেস করতেন। তবে হ্যাঁ যেটা চাইছেন, সেটা না হওয়া অবধি ছাড়েন না", বলছিলেন সুব্রত।
অমিত জানালেন, "গাঙ্গুবাঈয়ের সেট ডিজাইনের ক্ষেত্রে আমাদের পুরো স্বাধীনতা দিয়ে বনশালি বলেছিলেন- তোমরাই পারবে বাস্তবের সঙ্গে শৈল্পিকভাবনাকে মিশিয়ে দিতে। ওঁর সঙ্গে আসলে কাজ করার মজাই আলাদা। কড়া ঠিকই, কিন্তু ভাল কাজ করলে ও-ই সবথেকে বেশি প্রশংসা করবে।"
গোটা সিনেমায় রঙের ব্যবহার নিয়েও বেজায় এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে। কামাথিপুরায় গাঙ্গুর কোঠার পর্দা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর তৈরির জন্য গোটা মুম্বইয়ের বিভিন্ন বস্তি এলাকা থেকে হাজার হাজার কাপড় কিনে আনা হত সেটসজ্জার জন্য। সেটাও ছিল দারুণ মজার ঘটনা। সুব্রতর কথায়, প্রতি সপ্তাহে মুম্বইয়ের সব বস্তি এমনকী ধারাভি থেকেও পুরনো রদ্দি কাপড় নিয়ে আসা হত কোঠার পর্দা, বিছানার চাদর-বালিশের কভার তৈরির জন্য। এরপর সেগুলোয় লাইট ফেলে দেখতাম কোনটা ভাল মানাচ্ছে। যেহেতু গল্পের প্রেক্ষাপট পঞ্চাশ-ষাটের দশক। তাই খুব একটা পপ কালার ব্যবহার করিনি। কারণ সেযুগে বেশি পপ-ফ্লুরোসেন্ট কালার ব্যবহার হত না। একেকদিন তো এরকমও গিয়েছে যে, হাজারটা পুরনো শাড়ি থেকে ৪০-৪৫টা বেছে নেওয়া হল। একেবারে কালঘাম ছোটার উপক্রম! সেসব কেটে কোনওটা আঠা দিয়ে, আবার কোনওটা চুয়িংগাম দিয়ে লাগিয়েছিলাম। আসলে গ্ল্যামারের পাশাপাশি পতিতাপল্লীর ঘুঁপচি ঘরগুলোর বাস্তব চেহারা ফুটিয়ে তোলাই ছিল মূল লক্ষ্য।
অমিতের কথায়, "বনশালি এমন একজন পরিচালক যাঁর ভাবনা শুরুই হয় সেখান থেকে বাকিরা যেখানে ভাবা শেষ করেন। ওঁর কাছে সেট গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হলেও, দৃশ্যায়ণের সময় যেন কখনও মূল চরিত্রকে ছাপিয়ে না যায়- এই বিষয়টায় পরিচালক হিসেবে খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে খেলেন তিনি। দারুণভাবে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারেন।
যেমন একটা দৃশ্যের কথা বলছি- গাঙ্গুবাই যেখানে সাদা শাড়ি পড়ে সাদা তাঁবুর মধ্যে ভরা সভায় ভাষণ দিচ্ছে। সেখানে তো রঙের কন্ট্রাস্টের কোনও জায়গাই নেই। দর্শকের অন্তত চোখ ধাঁধিয়ে যাবে না। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবেন, এমন দ্বিধায় ভুগবেন না। Sophisticated but realistic approach."
কথা প্রসঙ্গেই জানা গেল, লকডাউনের সময় মুম্বইয়ের বৃষ্টিতে যাতে সেট নষ্ট না হয়, ৫ একরের গোটা সেটটাকে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। তাতে খরচও হয়েছিল ১ কোটি টাকার ওপর। অমিত-সুব্রত জানালেন, "সেইসময়ে একটা খবর প্রকাশ্যে এসেছিল যে, গাঙ্গুবাঈয়ের সেট নষ্ট হয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার লোকসান হয়েছে। সেটা একেবারে ভুল। লকডাউনে কাজ বন্ধ থাকার সময়ও বারবার সেট দেখে এসেছি। তবে পুরো সেটটা ঢেকে ফেলার বুদ্ধিটা অনেকটা বাঁচিয়ে দিয়েছিল সেই যাত্রায়।"
কাজের সময় অমিত-সুব্রতর মাথায় একটাই কথা ঘুরত- ডিটেলিংয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু সাংঘাতিক নজর সঞ্জয় লীলা বনশালির। তাই সামান্য ফটোফ্রেম থেকে খাটের তলায় রাখা গণিকাদের ব্যবহৃত পুরনো ট্রাঙ্ক, সবেতেই পিরিয়ডিক একটা ধাঁচ রেখেছিলেন। আগেকার দিনে যেমন ফটোফ্রেমের কোণায় ডিজাইন থাকত, সেটাও হাতে করে নকশা কাটতে হয়েছে। কোঠার দেওয়ালগুলোতে মার্বেল পেপার লাগিয়ে তাঁর ওপর রং লেপে যে টেক্সচার আনা হয়েছিল, তা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন খোদ বনশালি। বিশেষ করে কোঠার শীলা মাসির ঘরের দেওয়ালের কাজ দেখে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। লাল শেড ব্যবহার করা হয়েছিল। সুব্রতর কথায়, "আসলে রেড লাইটের অর্থ- কোনও খদ্দের যখন ঘরে প্রবেশ করে, তখন বাইরে লালবাতি জ্বলে। সেই ভাবনা থেকেই লাল রঙের শেড ব্যবহার করা।"
যে কোনও পিরিয়ডিক সিনেমায় সেট নিঃসন্দেহে একটা আলাদা চরিত্রের কাজ করে। গাঙ্গুবাইয়ের ক্ষেত্রেও পঞ্চাশ-ষাটের জমানা ধরতে, কখনও রাস্তার ধারে গ্যাস লাইট লাগানো হয়েছিল। আবার কখনও সেময়ের ফারাক বোঝাতে বৈদ্যুতিন আলো, টেলিফোন ব্যবহার করা হয়েছে। সিনেমার একেকটা দৃশ্য খুব ভালভাবে খেয়াল করলেই সেটা বোঝা যাবে। কোঠার বাথরুমগুলোয় একেবারে দৈনন্দিন ছাপ আনার জন্য ক্ষয়ে যাওয়া সাবান লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকী কেমিক্যাল ব্যবহার করে রং করা দরজার কাঠে চিড় ধরানো হয়েছিল পুরনো, ক্ষয়ে যাওয়া এফেক্ট আনার জন্য। গোটা সিনেমাজুড়ে যেসমস্ত লিফলেট কিংবা পোস্টার, কাট-আউট দেখা গিয়েছে তার সবটাই হাতে আঁকা।
তবে শুধু মুম্বইয়ের কামাথিপুরা নয়, গাঙ্গুবাঈয়ের সেটসজ্জার সময় পুরনো কলকাতার অলি-গলিও দুই বাঙালি শিল্প নির্দেশকের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। কীভাবে? মজাচ্ছলেই সুব্রত চক্রবর্তী জানালেন, পুরনো কলকাতার বাড়ির দেওয়ালে যেমন স্টেনসিল প্যাটার্ন থাকত, সেটা দেখেই গাঙ্গুর কোঠাতেও ওরকম স্টেনসিলের কাজ করেছি।
তবে সিনেমার কাওয়ালি সঙ্গীত 'শিকায়ত' গানের সেট তৈরি করার নেপথ্যে আরেক মজার ঘটনা রয়েছে। অমিত-সুব্রত জানালেন, "হঠাৎ একদিন সেটে এসে বনশালির বায়না, এমন একটা ব্র্যাকড্রপ দরকার, যা আছে, আবার শুটের সময় খুব একটা চোখেও পড়বে না!" ৩ মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে চারটে করে ব্যাকড্রপ ডিজাইন করে প্রায় কালঘাম ছুটে যাওয়ার জোগাড়! একটাও পছন্দ হচ্ছে না পরিচালকের। শেষমেশ ক্যামেরা ঢাকার কালো কাপড় দিয়ে ব্যাকড্রপ ডিজাইন করা হল। তার ওপর হাতে পেইন্টিং করা। "সেটার ওপর সুদীপদা (চট্টোপাধ্যায়) যখন আলো ফেলে হুমা কুরেশির গানের দৃশ্যটা শুট করল, ওটা দারুণ ম্যাজিক্যাল মুহূর্ত ছিল", বললেন দুই বাঙালি শিল্প নির্দেশক।
গাঙ্গুবাই ভোটে জিতে যেখানে পুরো কামাথিপুরা ট্রাকে ঘুরেছিল, সেই ক্লাইম্যাস সিন এতটাই কঠিন ছিল যে রি-টেক করতে করতে শেষমেশ ৭ দিনের মাথায় মনের মতো শট পান বনশালি। তবে সেই কদিনে ওই দৃশ্যের সেট গোছাতে গোছাতে অমিত-সুব্রতর মাথায় হাত! বললেন, কত হাজার পেপার কাটিং করে যে ওই সাদা কাগজ ওপর থেকে ছড়ানো হত রোজ তার ইয়ত্তা নেই! প্রতিদিন একবার করে ওই দৃশ্যের শুট হচ্ছে, স্যরের পছন্দ হচ্ছে না। তো আবার পরদিন সকালে ৪০-৪৫ জন লোক লাগানো হচ্ছে ওই পড়ে থাকা কাগজের টুকরো পরিস্কার করার জন্য।
'গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াওয়াড়ি' সিনেমার মাধ্যমেই প্রয়াত বাবাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে একটা বুদ্ধি বের করেছিলেন বনশালি। কারণ, বাবা নবীন বনশালিও ছিলেন সিনে-পরিচালক। অমিত-সুব্রতর ওপর নির্দেশ ছিল, "১৯৫৭ সালে বাবার তৈরি সিনেমা 'জাহাজি লুটেরা' ছবির একটা পোস্টার তৈরি করো।" রেফারেন্স ঘেঁটে হুবহু সেইসময়কার হাতে আঁকা পোস্টার তৈরি করলেন তাঁরা। সিনেমার একাধিক দৃশ্যে কামাথিপুরার থিয়েটারের দেওয়ালে সেই পোস্টার দেখানো হয়েছে। "বাবার সৃষ্টিকে নিজের সিনেমার মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে পেরে ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন পরিচালক", বললেন, অমিত-সুব্রত।
যে জন্য এত পরিশ্রম। সেই 'গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াওয়াড়ি'র সেট তৈরি করতে খরচ হয়েছে মোট ১০ কোটি টাকার ওপরে। খোদ আলিয়া ভাট ও মহেশ ভাট অমিত-সুব্রতর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, "দাদা আপনারাই আসল হিরো।" মহেশ ভাটের সঙ্গে অবশ্য 'সড়ক ২'-তে কাজ করেছেন তাঁরা। মুম্বইতে দাপিয়ে কাজ করলেও শিকড়ের টান এখনও অটুট তাঁদের। তবে দুই বঙ্গসন্তানের আক্ষেপ, "মুম্বই নাম-যশ দিলেও তাঁদের কাজের প্রতি বাংলার লোকজন খুব একটা আগ্রহ দেখান না।"