প্রথম ছবির হিরো উত্তম কুমার। 'সুনয়নী'র জন্য ১ টাকাও পারিশ্রমিক নেননি। বলে-কয়ে পরিচালক সুখেন দাস শুধু তেলের খরচ হিসেবে প্রতিদিন ১০০টাকা দিতেন। কেন? কারণ শকুন্তলা বড়ুয়ার স্বামী ছিলেন জাঁদরেল সরকারী কর্মচারি। মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, আমার স্ত্রী অভিনয় করবে শখে, তবে তার জন্য ওঁর কোনও পারিশ্রমিকের দরকার নেই। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে-বউমা হিসেবে শকুন্তলার সিনেপাড়ায় আসার গল্পটা কিন্তু নেহাত সোজা ছিল না। দুই মেয়ে-স্বামী নিয়ে ভরা সংসার। স্বামী সপাট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, "সিনেমা করছ কর, কিন্তু বাড়িতে যে একজন তারকা থাকে, এটা যেন কখনও আমি বা সন্তানরা কিংবা পরিবারের কোনও সদস্যরা বুঝতে না পারে।" তার আগেও অবশ্য কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি শকুন্তলাকে। আটের দশকের 'হিট' নায়িকা হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে তাঁর বহু আত্মত্যাগ, পরিশ্রম। ঘর-সংসার সামলে উত্তম-সৌমিত্র থেকে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো তাবড় অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, কেমন ছিল সেসব দিন? 'পুরনো সেই দিনের কথা'য় জানালেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে। লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
উত্তমকুমারকে দেখলে বাড়ির বউ কিংবা মেয়েরা আর ফিরে আসবে না…- এমনটাই ভাবত তখনকার সমাজ। শকুন্তলা বড়ুয়ার স্বামীর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। গোড়ার দিকে তখনও জানতেন না অভিনেত্রী যে, তাঁর বিপরীতে কোন নায়ক রয়েছেন। অভিনয়ের কথা শুনেই স্বামী সপাটে বলে দিয়েছিলেন, "সিনেমা করলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে করো।" আর স্ত্রীয়ের বিপরীতে উত্তম কুমার অভিনয় করছেন শুনে তো আপত্তি আরও দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শকুন্তলা কোনওমতে গররাজি করালেন। পরিচালক সুখেন দাসও প্রায় নাছোড়বান্দা যে শকুন্তলা ছাড়া এই চরিত্র হবে না! শেষমেশ একটা চুক্তিপত্র তাঁর হাতে দিয়ে বললেন- স্বামীকে দিয়ে সই করিয়ে আনতে। সে হল আরেক বিপদ! স্বামী তো চুক্তিপত্র দেখেই বললেন- অশিক্ষিত নাকি সব? চুক্তি সই হয় দু'পক্ষের মতে। আমি তো ওদের কোনও শর্ত না-ই মেনে নিতে পারি.. বলতে বলতেই চুক্তিপত্রের একেকটা লাইন পড়ছেন আর ঘ্যাঁচ-ঘ্যাঁচ করে কাটছেন! তা দেখে শকুন্তলার তখন প্রায় লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড়। সেই চুক্তিপত্র নিয়ে গিয়ে তিনি পরিচালক সুখেনের হাতে দিলেন। আশা ছেড়েই দেওয়া হল। শেষমেশ, আবারও জোড়াজুড়ি করায় তখন গিয়ে শকুন্তলার স্বামী রাজি হন। জানিয়ে দেন, "কোনও চুক্তিপত্রে সই করাতে হবে না। আমি যখন বলছি, তখন ও সিনেমাটা করবে। Gentleman's word..।"
প্রথম হিরো উত্তর কুমার, খুব কাছ থেকে দেখেওছেন তাঁকে শকুন্তলা। কেমন ছিল তাঁদের সম্পর্ক? ভাই-বোন বললেও অত্যুক্তি হয় না। শকুন্তলা ছিলেন দাদা-অন্ত প্রাণ। উত্তমকুমারও স্নেহ করতেন তাঁকে। একজন নবাগত অভিনেত্রীকে তিনি যে পাঠ দিয়েছিলেন, তা শকুন্তলা আজও মনে রেখেছেন। বললেন, "দাদা ছিলেন হিমালয়। ওঁর ব্যক্তিত্ব ছিল দেখার মতো। কিন্তু তার জন্য মানুষটার কোনওদিনও এতটুকু অহংকার ছিল না। স্্টুডিওতে হাত দুটো পেছনে দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকতেন। সব টেকনিশিয়ানদের খোঁজ-খবর রাখতেন। এত আস্তে কথা বলতেন যে, কখনও কান পেতে শুনতে হত। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে আস্তে আস্তে উত্তর দিতেন। শুধু তাই নয়, অনেকবার দাদাকে দেখেছি, নতুনদেরকে শিখিয়ে দিতে। আজকাল কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে সেটা দেখি না। এখনকার হিরোদের দেখি সেটে ঢুকলে হাবভাব দেখিয়ে, চেঁচিয়ে জানান দিতে যে- আমি এসে গেছি। কিন্তু উত্তম কুমার কখনও সেটা করতেন না।"
"মেয়েরাই ঝাঁপিয়ে পড়ত উত্তম কুমারের ওপর। গায়ে গা ঘেঁষে ছবি তুলতে চাইত.. কতবার দেখেছি আমরা ছবি তুলছি। দাদার ঘাড়ের কাছ থেকে একজন এসে মাথা ঢুকিয়ে দিল পেছন থেকে। আমি তো বয়সকালে সুন্দরী ছিলাম, কোথায় আমার তো ওঁর ওপর কোনও অভিযোগ নেই। বরং, উত্তমদা ছিলেন অভিভাবকের মতো। আমি তো বলব, উত্তম কুমার নয়, মেয়েরাই নিজেদেরকে ওঁর কাছে এক্সপোজ করত। ওঁর বিকল্প আজও আসেনি ইন্ডাস্ট্রিতে।", বললেন অভিনেত্রী। অনেক সময়ে সুপ্রিয়াদেবীকে বলে শকুন্তলার জন্যও বাড়ি থেকে খাবার আনাতেন মহানায়ক।
অভিনয়ের আগে গান-ই ছিল শকুন্তলার প্রাণ। রেডিওতে গাইতেন। স্বয়ং উত্তম কুমারও তাঁর কণ্ঠের ভক্ত ছিলেন। কতবার ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে সুপ্রিয়াদেবীর সঙ্গে আড্ডা জমেছে হারমোনিয়াম নিয়ে। তবে মহানায়ক চলে যাওয়ার পরই সুপ্রিয়াদেবীর সঙ্গে বেশি ভাব জমেছিল তাঁর। সুপ্রিয়ার অনুরোধেই উত্তমের হারমোনিয়াম নিয়ে ওবাড়িতে গান গাইতেন অভিনেত্রী। আর সেই গানের মধ্য দিয়েই 'দাদা'কে খুঁজে পেতেন সুপ্রিয়াদেবী। অনেক সময়েই গান গাইতে চাইতেন না শকুন্তলা। তখন একপ্রকার জোর করেই সুপ্রিয়াদেবী বলতেন, "তুই এটা রিফিউজ করছিস! জানিস এই হারমোনিয়াম কে কে বাজিয়েছে? - আরডি বর্মন, শচীনকর্তা, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র, তোর দাদা তো আছেই। এঁরা ছাড়া এই হারমোনিয়ামে একমাত্র তুই-ই হাত দিয়েছিস।"
প্রিয় বেণুদির সঙ্গে রান্না নিয়েও গল্প হত। শকুন্তলা নিজেও দারুণ রাঁধুনি। ইন্ডাস্ট্রির অনেকেরই একথা জানা। খোদ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শকুন্তলার হাতের অরেঞ্জ চিকেন পছন্দ করতেন। "উত্তমদার জন্যেও অনেকবার আঁখনি পোলাও রেঁধেছি", বলছিলেন শকুন্তলা বড়ুয়া। তবে অনিল কাপুর তাঁর তৈরি 'রুই ভাপা' খেয়ে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন- "বিশ্বের এত জায়গায় এত মাছের পদ খেয়েছি, তবে এটা সেরা।" এর নেপথ্যেও রয়েছে মজার এক কাহিনী।
শকুন্তলার জামাই আশীষ বিদ্যার্থি আসলে নিজে শাশুড়ির হাতে রাঁধা মাছের এই পদ খুব ভালবাসেন। "টোয়েন্টি ফোর-এর শুট চলাকালীন আমি মুম্বইয়ে মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তো আশীষ বল- তুমি রুই মাছ-সর্ষে দিয়ে যে রান্নাটা করো ওটা প্লিজ করো, আমি সেটে নিয়ে যাব। তো আমি সেই পদ রেঁধে ওঁর সঙ্গে গেলাম সেটে। ও তো রসিকতা করেই সবাইকে আমার পরিচয় দিল- এই যে আমার শাশুড়ি। উনি বাংলা সিনেমার নিরূপা রায়। লাঞ্চ ব্রেকে সবাইকে নিজে হাতেই খাবার পরিবেশন করল আশীষ। আর সবার কাছে গিয়ে ক্যামেরা ধরে রিঅ্যাকশন নিচ্ছে যে রান্না কেমন হয়েছে। তখনই অনিল কাপুর আমার রাঁধা রুই ভাপার প্রশংসা করেন।"
ইন্ডাস্ট্রির লাইমলাইট থেকে দূরে থাকতে বরাবর-ই পছন্দ করেন শকুন্তলা বড়ুয়া। এখনও তাই। বাজারঘাট থেকে ব্যাঙ্কের কাজ নিজেই করেন। সাদামাটা জীবনযাপনেই অভ্যস্ত। তাই স্টুডিওপাড়া থেকে খুব কারও সঙ্গে একটা বন্ধুত্বও কোনওদিন-ই তৈরি হয়নি তাঁর। বললেন, "হাসি (সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়), বেণুদি (সুপ্রিয়াদেবী), সাবিত্রীদি (চট্টোপাধ্যায়), মাধবীদির (মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে আমার বরাবরই ভাল সম্পর্ক। আজও এর বাইরে খুব একটা কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখি না।"
ভূপেন হাজারিকা কি আপনাকে সত্যি-ই বিয়ে করতে চেয়েছিলেন? অভিনেত্রীর সপাট উত্তর, "যা শোনা যায়, তার সবটাই রটনা। ভূপেনদা আর আমি একসঙ্গে গান-বাজনা করতাম। ওঁর হাত ধরেই আমার সিনেপাড়ায় প্রবেশ বলা যায়। গিয়েছিলাম শুটিং দেখতে, ফিরলাম নায়িকা হয়ে। তবে উনি কোনওদিন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেননি। আমি যখন ওঁর বাড়িতে গান করতে যেতাম, তখন তো ওঁ কল্পনা লাজমির সঙ্গে লিভ-ইন সম্পর্কে রয়েছেন।"
প্রসঙ্গত, সদ্য 'টনিক' ছবিতে দেখা গিয়েছে শকুন্তলা বড়ুয়াকে। ইন্ডাস্ট্রির নবীন প্রজন্ম নিয়ে কী মত অভিনেত্রীর? তাঁর কথায়, "গত ২ বছর ধরে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রিতে অখন অনেক লোকের ভীড়। চূড়ান্ত পেশাদারিত্ব। একটা সময়ে তো অনেক নাম-ডাক করেছি, সেই জায়গা থেকে এখন আর নামতে ভাল লাগে না। তাই এখন কারও সঙ্গে চূড়ান্ত আপস করতে ভাল লাগে না। কম্প্রোমাইজ একটা জায়গা পর্যন্ত করা যায়। তারপর আর না! এখন তো কেউ গ্লিসারিন ছাড়া কাঁদতেই পারে না। এই তো সেদিন এক শুটিংয়ে গিয়ে মেকাপ আর্টিস্টকে ধমকেছি। একটা দুঃখ-কষ্টের দৃশ্য। যেখানে আমাকে কাঁদতে হবে। মনের উথাল-পাথাল অবস্থা। সেখানে কিনা পাট-পাট করে আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। চুলও বেঁধে দিয়েছে একেবারে গুছিয়ে। আরে এমন দৃশ্যে তো মেকাপের সেরকম দরকার-ই নেই। এই কথাটা বোধহয় ওদের মাথায় ঢোকে না। এত মেকী! তাই আমি নিজেই মেকাপ ঘেঁটে, চুল-শাড়ি সব এলোমেলো করে দিলাম। এটা ওদের নজরে পড়তেই ঠিক করতে এসেছিল। আমি সোজা ধমকে বের করে দিয়েছি।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন