‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’.. এই প্রবাদে আপনি কতটা বিশ্বাসী?
আমি বিশ্বাস করি, সংসার করা একটা টিম ওয়ার্কের মতো। গৃহিণীদের গুণাবলী সংসারের অন্য সদস্যরা যদি মর্যাদা না দেন, তাহলে তো সংসারের তাল-লয় সব ঘেঁটে যাবে। তাই না?
শ্রীমতীর যথাযথ সংজ্ঞা…
আমার মা খুব বিরক্ত হয়েই একটা কথা বলতেন যে, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব মায়েদের ঘাড়ে। যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। আমার কাছে শ্রীমতীর যথাযথ সংজ্ঞা সেটাই।
নারীর ক্ষমতায়নের লড়াইয়ের সঙ্গে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ভাল মানায় বলেই 'শ্রীমতী'তে?
সিনেমায় নারীর ক্ষমতায়নের কথা কিন্তু বলা হয়নি! ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, আমাদের সবার লড়াইটা নিজেদের সঙ্গে হওয়া উচিত। ভাল থাকা নিজের ওপর নির্ভর করে। কখনোই অন্যের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। এই লোকে কে কী বলবে?.. আমি কতটা সুন্দর, মোটা কিংবা আমার সাফল্য-ব্যক্তিত্ব, লোকে মার্কসিটে কত নম্বর বসালো, সেসবে কান না দিয়ে নিজের শর্তে, নিজের জন্য বাঁচা উচিত। শ্রীমতির গল্পটাও সেরকম। বাইরের লোক খোঁচা দিলেই নিজেকে বিব্রত করা থেকে দূরে থাকুন। ইঁদুর দৌড়ে নামা উচিত নয়। বাবা-মা ছোটবেলা থেকেই আমাকে শিখিয়েছেন, নিজের সামর্থ, ওজন বুঝে চলো। আমি একাই নিজের জন্য যথেষ্ট। সেই মেসেজ দিতেই 'শ্রীমতী'। শিল্পী হিসেবে নিজেকে আরও পরিণত করার চেষ্টা করি।
'শ্রীমতী'র সঙ্গে বাস্তবের স্বস্তিকার কতটা তফাৎ?
২ টো। প্রথমত, আমি একদম রান্না করতে পারি না। সবজি-পাতি তো দূরে থাক! ভাতের ফ্যানটাও গালতে পারি না। দ্বিতীয়ত, বাইরের লোক কে কী বলছে, সেগুলোকে ব্যক্তিগতজীবনে একেবারে পাত্তা দিই না। শ্রীমতি চ্যাটার্জি যেরকম অন্যের কথা শুনে প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে গিয়ে কাছের মানুষগুলোকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল।
সোহমের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা শুনব একটু..
সোহম যেহেতু একেবারে হার্ডকোর কমার্শিয়াল সিনেমায় অভিনয় করে, তো প্রথমটায় ওর সঙ্গে জুটি বাঁধার কথা শুনে, আমি একটু কিন্তু কিন্তু করছিলাম। কারণ আমার তো ২০০৮ সাল থেকেই কমার্শিয়াল সিনেমার ময়দান থেকে প্রস্থান ঘটেছে। তবে, পোস্ট প্রোডাকশনের সময় সিনেমাটা যতবার দেখেছি, ততবার মনে হয়েছে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমাদের দিব্যি মানিয়ে গিয়েছে। বেমানান লাগেনি। শ্রীমতির চরিত্রের জন্য ঠিক যেরকম রসায়ন দরকার ছিল, সোহম আর আমার জুটি সেটা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে।
ছবির ‘শ্রীমতী’র মতোই কি প্রিয়জনকে ভালবাসায় আঁকড়ে ধরেন?
প্রিয়জনের দিকটা আমার একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কালকেই ভাবছিলাম যে, দাদু-দিদা, ঠাকুরদা-ঠাকুমা, মামা-মাসি, বাবা-মা সবাই ওপরে চলে গিয়েছেন। আমার কাছে পরিবার বলতে বোন অজোপা, ওর ছেলে আর আমার মেয়ে। ওই 'আমি-তুই' করে ৪ জন। আমি ভীষণই ঘরকুনো মহিলা। বাইরে বেরিয়ে আড্ডা-ফূর্তি একেবারেই করি না। খুব ঘনিষ্ঠ মানুষ ছাড়া এখন আর হ্যাং আউট করতে ভাল লাগে না। তাঁদের আঁকড়ে থাকার অভ্যেসটা রয়ে গিয়েছে।
শুনেছি , ‘শ্রীমতী’র জন্য আপনার মা-ই আপনার অনুপ্রেরণা..
হ্যাঁ। আমাদের চোখের সামনে মা-মাসি-দিদা-ঠাকুমাদের যেভাবে ঘর-সংসার সামলাতে দেখেছি, ওঁরা কিন্তু সংসার বস্তুটা নিয়ে ভীষণ প্যাশনেট। রান্না ঘরের চাবি কিংবা বাড়ির চাবি কারো হাতে দিতে নারাজ। আমার বাড়িতেও তার অন্যথা ছিল না। হাজারবার মাকে বলেছি, শুট থেকে ফিরতে অনেক রাত হবে। আমাকে চাবিটা দিয়ে দাও। তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো। মা কোনওদিন জীবদ্দশায় সেটা করেননি। বলতেন- 'তুমি এসে ফোন করবে, আমি দরজা খুলে দেব।' রাত ২টো হলেও নিজে গেট খুলে দিয়েছেন।
বর্তমানে গৃহিণীদের ডিমোটিভেটিং জায়গা থেকেই আমরা দেখি। সংসার করা যে থ্যাংকলেস জব, সেটা ধরেই নেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের মা-মাসিদের দেখো, ওঁরা বিশাল উচ্চশিক্ষিত না হয়েও কিংবা অ্যাকাউন্টেন্সি না পড়েও কী সুন্দরভাবে সংসারের সব হিসেব রাখতেন। আমার মা তো একা হাতেই আমার নিজের এবং বাবার ২ জনের অ্যাকান্টস ম্যানেজ করতেন। সারাজীবন ধরে। সেই অভিজ্ঞতাগুলোই 'শ্রীমতি' করার সময়ে রেফারেন্স হিসেবে কাজে লাগিয়েছি।
মায়ের শাড়ি-গয়নাও পরেছেন এই ছবিতে…
হ্যাঁ। শুধু 'শ্রীমতি' নয়, 'দিল বেচারা', 'মোহমায়া' সব ছবি-সিরিজেই আমি মায়ের প্রচুর শাড়ি-গয়না ব্যবহার করেছি। আমার কেমন যেন মনে হয়, ওগুলো সাথে থাকা মানেই মায়ের স্পর্শ পাচ্ছি সবসময়ে। আসলে মা আমার কাজের সঙ্গে ভীষণভাবে ইনভলভড ছিলেন। আগামীতে আমি থাকি না থাকি, আমার কাজের সঙ্গে মায়ের এই জিনিসগুলো তো থেকে যাবে।
'বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান' কিন্তু হল দেওয়া হচ্ছে না… ইন্ডাস্ট্রির অন্দরের রাজনীতি কি ভাবায়?
শুধু আমি কেন, তাবড় তাবড় হিরোরাও বলছেন যে, বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান। 'আয় খুকু আয়' রিলিজের আগে বুম্বাদাও বলেছিলেন একাধিক সাক্ষাৎকারে। সেখানে বাংলা ছবির শো টাইমিংগুলো যদি এমন অদ্ভূত সময়ে রাখা হয়, তাহলে দর্শকরা দেখবেন কী করে, আর পাশে দাঁড়াবেন-ই বা কী করে?
আমি ভেবেছিলাম, করোনার পর মানুষ যখন হলমুখো হওয়ার চেষ্টা করছেন, সেখানে একটা সিনেমাকে অন্তত ২ সপ্তাহ সময় দেওয়া উচিত। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শো টাইমগুলো এমন ঘেঁটে দিচ্ছেন ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটাররা যে দর্শকরা ইচ্ছে থাকলেও পরের সপ্তাহে আর সিনেমাগুলো দেখতে পাচ্ছেন না। অফিস, কাজ, সংসার… সব ছেড়ে দুপুর কিংবা সকালের শোয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়াটা সম্ভব নয় কারও পক্ষেই। আমি নিজেও যাই না। সুতরাং, আমি সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে সেই প্রত্যাশা কেন রাখব? 'শ্রীমতি' র শো টাইমিংগুলো এমনভাবে রাখা হয়েছে যে অনেকেই আমাকে ব্যক্তিগত স্তরে জানাচ্ছেন যে, তাঁদের ইচ্ছে থাকলেও কাজ বাদ দিয়ে যাওয়াটা অসম্ভবপর।
টলিউডে নারীকেন্দ্রিক সিনেমা কি কোণঠাসা?
কয়েকজন মুষ্টিমেয় পরিচালক-প্রযোজকদের সিনেমা ছাড়া সবারই তো এই একই অভিযোগ। সেখানে নারী-পুরুষ বিষয়টা আর আলাদা করে কী উল্লেখ করব! তবে হ্যাঁ, আমরা যতই চিৎকার, লেখালেখি, সেমিনার করি না কেন নারীকেন্দ্রিক সিনেমা এখনও সেই তুলনায় কম তৈরি হয়। আর নারীকেন্দ্রিক সিনেমার ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া-ই হয় যে বাড়ির মা-মাসিরা ছাড়া অন্য কেই এই সিনেমা দেখতে যাবেন না।
বাংলা সিনে ইন্ডাস্ট্রিতে পারিশ্রমিকের নীরিখে অভিনেতাদের কি অভিনেত্রীদের থেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়?
আমার প্রাপ্য পারিশ্রমিক আমাকে দেওয়া না হলে আমি সেই কাজ করি না। ২২ বছর হয়ে গেছে ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছি, এখনও যদি প্রাপ্য পারিশ্রমিক নিয়ে দরদাম করতে হয়, সেটা নিশ্চয় ৬০ বছর বয়সে গিয়ে ঠিক হবে না। নায়িকারা এই স্কেলে পারিশ্রমিক দাবি করতে পারে না- এমন একটা ধ্যানধারণা তো রয়েইছে। এবার কে কীভাবে সেটার সঙ্গে সমঝোতা করবেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মেরিল স্ট্রিপও একবার সোচ্চার হয়েছিলেন যে- কেন নারীরা পুরুষের সমান পারিশ্রমিক পেতে পারেন না?
রাজ্যের বাইরের ইন্ডাস্ট্রিতে বাঙালি অভিনেত্রী বলে যে তকমা সেঁটে দেওয়া হয়, সেটায় আপনার আপত্তি রয়েছে…
আমরা সবাই ভারতীয়। অতঃপর এঁরা দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির, এঁরা বাংলা সিনে ইন্ডাস্ট্রির এমন ট্যাগ লাগিয়ে ভেদাভেদ করা উচিত নয়। শিল্পীর পরিচয় শিল্পী বলেই হওয়া উচিত। বলিউডের কিছু সংবাদমাধ্যমের অভ্যেস রয়েছে আঞ্চলিক তকমা সেঁটে দেওয়ার। আমি সেটা নিয়েই আপত্তি জানিয়েছিলাম।
ইচ্ছে করলেই নায়িকাদের সঙ্গে যখন তখন 'যাঁর-তাঁর' নামজুড়ে দেওয়া হয়.. সেই বিষয়ে কী বলবেন?
এটা পার্টিকুলার কিছু সংবাদমাধ্যমের অভ্যেস রয়েছে। সাধারণ মানুষের অত মাথাব্যথা রয়েছে বলে তো মনে হয় না। কারণ আমি যেখানেই যাই দর্শক-অনুরাগীদের কাছ থেকে ভালবাসা পাই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন