শহরে আজ অন্য রব, রাত ঘিরতে প্রস্তুত মেয়েরা। আগামীকাল স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয়। তাঁর পাশাপাশি আগামীকাল টলিপাড়ায় ছবি রিলিজও বটে। অভিনেত্রী শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় বাবলি হয়ে ফিরছেন বড় পর্দায়। একদিকে যখন মেয়েরা এক নিচ্ছেন তাদের অধিকার বুঝে নিতে। তখনই, একদম ভিন্ন এক স্ট্রং - স্মার্ট নারীর গল্প বলতেই আসছেন শুভশ্রী।
বুদ্ধদেব গুহর গল্প বাবলি, সিনেমাটিক রূপ পেতে চলেছে। পরিচালনায় রাজ চক্রবর্তী। অভিনেত্রী, এই ছবিতে নায়িকার পাশাপাশি প্রযোজকও বটে। এককথায়, ইন্ডাস্ট্রির 'বস লেডি' নিজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি, নানা বিষয়ে কথা বললেন, IE - বাংলার সঙ্গে।
শুভশ্রী বাবলির কাছ থেকে কি শিখল?
এই রে এটা কিন্তু ভেবে দেখিনি। সত্যি বলতে গেলে আমি কিন্তু বাবলির মতই খুব মজাদার। কিন্তু বাবলি খুব প্রফেশনালি মজা করতে পারে যেটা আমি পারিনা। অভিরূপের পেছনে যেভাবে ও লাগে, আমি যাদেরকে ভালোবাসি আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমিও তাদের পেছনে লাগি, কিন্তু এটা সত্যি বাবলির কাছ থেকে শেখার। কিন্তু বাবলি শুভশ্রীর থেকে একদম আলাদা। ভীষণ স্ট্রং একটা ক্যারেক্টার। খুব উচ্চ শিক্ষিত। কিন্তু তার জীবনে কিছু কিছু ইনসিকিওরিটি রয়েছে। বাবলির বেশ কিছু বিষয়ের সঙ্গে কিন্তু আমি কানেক্ট করতে পারিনা। তাই বলতে পারি আরও ফার্ম ভাবে মজা করার বিষয়টা আমি শিখতে চাই।
পরিণীতার মেহুল হোক বা, ইন্দুবালা...শুভশ্রী যে লাগাতার স্ট্রং নারী চরিত্রগুলোতে অভিনয় করছে, সেটা কতটা আলাদা আগের কমার্শিয়াল ছবির থেকে?
অনেকটাই আলাদা। আমি আরেকটা যোগ করতে চাই সেটা হল বৌদি ক্যান্টিন। যতদিন গেছে তত দর্শকদের, সিনেমার প্রতি ভালোলাগা আরও বদলে গিয়েছে। ফলে আমাদের গল্প বলার ধরনটাও পাল্টে গেছে। এখন বর্তমানে হিরো হিরোইনের কনসেপ্টা পাল্টে গেছে। যে চরিত্রগুলো আমরা এখন করছি সেগুলো একদম ভিন্ন ধরনের। তাদের লুক একদম আলাদা রকমের হয়। আমি তো চাইবো যে টাইমে সঙ্গে সঙ্গে এরকম ইমপ্যাকটফুল চরিত্রগুলোতে অভিনয় করতে। যাতে সমাজের জন্য একটি ভালো বার্তা দিতে পারি, এবং আমার ক্যারিয়ারের জন্য যেন সেগুলো টাইমলেস হয়।
'Women in Indian Cinema' - এখন কি নারী কেন্দ্রিক সিনেমার সংখ্যা অনেক বেড়েছে?
ঠিক সেটা বলব না। কারণ নারীকেন্দ্রিক ছবি এর আগে অনেক হয়েছে। সেটা মাদার ইন্ডিয়া বলো, ছবির শেষ নেই। কিন্তু ওই যে বলে না, আমাদের জীবনেও একটা করে সময় আসে। সেরকমই নির্দিষ্ট একটা পর্যায়ে এসেছিল সিনেমার ক্ষেত্রে। যেখানে নারী কেন্দ্রিক ছবির সংখ্যা কিছুদিনের জন্য কম ছিল। হয়তো বা পরিচালকরা গল্প পারছিলেন না বা তারা হয়তো ভাবতে পারছিলেন না। সেই ফেসটা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। এবং এখন তো দারুন দারুন কাজ হচ্ছে।
ঔপন্যাসিক আর কোনও নারী চরিত্র আছে যেটা করতে ইচ্ছা হয়?
অনেক আছে। আমার একটু আনিস্যুয়াল লাভ স্টোরি খুব পছন্দের। চিত্রাঙ্গদা করার খুব ইচ্ছা আছে। রবি ঠাকুরের সৃষ্ট চরিত্রটি আমার ভীষণ পছন্দের। দেবদাস তো হয়ে গেছে, কিন্তু আবার যদি হয় তাহলে আমার করার খুব ইচ্ছে রয়েছে। শরৎচন্দ্রের 'পরিণীতা' নিয়ে যদি কোন ছবি হয় তবে, সত্যিই করতে চাই। ঝিনদের বন্দী আছে। অনেক আছে।
কোনটা সবথেকে কঠিন ট্রানজিশন জীবনের, অভিনেত্রী থেকে মা হওয়া, নাকি মা হওয়ার পর আবার অভিনয় জীবনে ফিরে যাওয়া?
আসলে কিন্তু কোনটাই নয় জানো। সবটাই নিজের মনের উপর নির্ধারিত। আমি তো অনেক ছোটবেলা থেকে অভিনয় করছি। ১৬ বছর বয়স থেকে আমার এই ইন্ডাস্ট্রিতে যাত্রা শুরু। আমি না সবটাই দেখেছি। মা হওয়াটা কিন্তু আমাদের জীবনের খুব ন্যাচারাল একটা বিষয়। আমরা এটা নিয়ে জন্মাই। যে মা হতে চায় না সেটা তার একদম নিজস্ব মতামত। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে অন্য প্রাণ একটা সৃষ্টি করার ক্ষমতা রয়েছে, সেটা কিন্তু নিতান্তই ছোট কথা নয়। আমার মনে হয়, কেউ যদি জীবনে নিজে থেকে কিছু করতে চায়, তখন কিন্তু বিষয়টা খুব সহজ হয়ে যায়, তখন আর কঠিন থাকে না।
অভিনেত্রী শুভশ্রী এবং প্রযোজক শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে কোন পার্থক্য?
অবশ্যই আছে। আমি লাইন লাগিয়ে বলে দিতে পারব। প্রযোজক হিসেবে এইটুকু বলতে পারি মাঝে মধ্যে অনেক কিছু ভুলে যাই। ( হাসি )... আস্তে আস্তে সবটা শিখে উঠতে হবে। আমার বহু বছর প্রযোজনার দিকে আগ্রহ ছিল। কিন্তু 'বাবলি' রিলিজের ক্ষেত্রেই বলছি, যখন পাতার পর কথা সই করতে হয় না, তখনই আমি বুঝতে পারি, যে এইতো আমি প্রযোজক। আমার কি অসহায় লাগে। ফ্লোরেও মাঝেমধ্যে মাথায় রাখতে হয় আমি প্রযোজক। সবথেকে বড় কথা হচ্ছে, প্রমোশনটা তো আমাকে সামলাতেই হবে কারণ এই ক্ষেত্রে সকলে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে তো আমার অভিনেত্রী স্বত্বাটা বেরিয়ে আসছে, না এখানে যাব না, না এটা করবো না। তারপর মনে পড়ছে আরে! এটাতো আমারই ছবি, আমিই তো প্রযোজক। ( হাসি )...
রাজ চক্রবর্তী সেটে ক্যাপ্টেন অফ দ্যা শিপ, বাড়ির গল্পটা কী?
না এখানে একটা টুইস্ট আছে। আমার বর সব সময় চায় যাতে আমি বাড়িতে ক্যাপ্টেন অফ দ্যা শিপ থাকি। কিন্তু আমি সেটা চাই না। পুরো সংসারটাতেই যখনই কোন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় হয়, আমি দেখেছি আমার ডিসিশানটাই প্রাধান্য পায়। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, প্রত্যেকটা মানুষের পয়েন্ট অফ ভিউ রাখা এবং দেখা খুব দরকার। আমি কোনদিনই বস হতে চাই না, লিডার হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। আমি সেটাই হতে চাই।
উল্টোদিকে আবির চট্টোপাধ্যায়, একজন দাপুটে অভিনেতা থাকা ভালো, কিন্তু পাশাপাশি খারাপ কিছু থাকে?
না না খারাপ কিছুই থাকে না। কারণ উল্টো দিকের মানুষটা যত ভালো অভিনয় করবে, তত আমার পক্ষে সহজ হবে সিনটা তৈরি করা। কারণ আল্টিমেটলি দর্শক পুরো গল্পটা দেখবেন। একজনের অভিনয় দেখতে তো তারা আসবেন না। সেটা মাথায় রাখা প্রত্যেকটা অভিনেতা অভিনেত্রী খুব দরকার। এবং এই ছবির ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি প্রত্যেকে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। আর আবীরদার কথা যখন উঠল একটা কথা বলতে চাই, আবির চট্টোপাধ্যায় একটা সিনে নিজেকে কিভাবে ধরে রাখতে হয় সেটা জানেন। সেটা আমি পারিনা। খুবই ইমোশনাল হয়তো একটা দৃশ্য, সেখানে অভিনয় করতে করতে আমি না ক্যারি ফরওয়ার্ড হয়ে যাই। যেটা আবিদার একদম হয় না।
বাবলির একটি সংলাপে আছে, 'আমাদের মত মোটাসোঁটা মেয়েদের নিয়ে লেখক গল্প লেখেন না'। একজন লিডিং মোস্ট অভিনেত্রী হিসেবে শুভশ্রীর এই প্রসঙ্গে ঠিক কী মনে হয়, মোটা মেয়েদের কি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ পাওয়ার সুযোগ সত্যিই কম?
দেখো আমার মনে হয় এই বিষয়গুলো এখন ভাঙতে শুরু করেছে। তার একটা কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে চারপাশে খুব সচেতনতা রয়েছে। বডি শেমিং ফ্যাট সেমিং, এগুলো নিয়ে এখন প্রকাশ্য আলোচনা হয়। খুব পজিটিভিটি একটা কিছুর দিকে আমরা বোধহয় এগিয়ে যাচ্ছি। কারন আমার মনে হয় একটা সময় যখন আমরা ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম, সেই সময় এই বিষয়গুলো নিয়ে কেউ কথা বলত না। যারা একটু চেহারার দিকে হেলদি ছিলেন, তাদেরকে দেখা যেত সমাজের এক কোণে লুকিয়ে থাকতে। বাবলির এই সংলাপটা এক সময় সত্যি ছিল। কিন্তু এখন সেটা খুব কমেছে। এখন যারা যে ফিল্ডে পারদর্শী, তারা কিন্তু সেখানে স্ব মহিমায় রয়েছেন।
আজকে নারীদের রাত সারা বাংলা জুড়ে, এবং তুমি তাতে থাকছ শুনলাম। একজন মা হিসেবে, একজন মেয়ে হিসেবে এই পরিস্থিতিটা কেমন তোমার কাছে? এবং মেয়েদের তুমি মোটিভেট কিভাবে করবে?
দেখো সত্যি কথা বলতে গেলে মোটিভেট করতে পারব কিনা জানিনা। কিন্তু একজন নারী হিসেবে আমি সেখানে যেতে চাই। দাঁড়াতে চাই আর পাঁচটা নারীর পাশে। অবশ্যই যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটা একটা উদ্দেশ্য। কিন্তু যেদিন এই ঘটনাটি ঘটেছে এবং আজকের মধ্যে আরও কতগুলি যে ধর্ষণ হয়ে গিয়েছে, সেটা কিন্তু আমরা কেউ জানিনা। আমার প্রশ্ন এখানেই যার কতদিন হবে। যে নির্মমভাবে মেয়েটিকেও হত্যা করা হয়েছে, তাদের একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যেন ভবিষ্যতে এরকম অন্যায় করার আগে হাজারবার কেউ ভাবে। মেয়েদের উপর আর মাপকাঠির দরকার নেই তো। আমাদের বাধা-বিপত্তি বেরিয়ে যে কাজ করতে হয়, সেটা এবার বন্ধ হওয়া উচিত। আমরা কেন রাত্রে বেরোচ্ছি, সেটা নিয়ে যদি প্রশ্ন তোলা হয়, এর থেকে কঠিন সময় বোধহয় আর কিচ্ছু নেই।