কাঠের চেয়ার, মাথার উপর এমন ভাবে ঝুলত সিলিং ফ্য়ান, যেন এখুনি মাথায় এসে পড়বে, এসি তো নৈব নৈব চ। কোথাও কোথাও আবার সাউন্ডের ঘড়ঘড়ানি আওয়াজ, তবু হৈ হৈ করে শেষ হত ম্য়াটিনি-ইভনিং-নাইট শো। রিয়ার স্টল আর ব্য়ালকনির মিষ্টি বিভাজন তো ছিলই। হলের বাইরে সিনেমার ইয়া বড় বড় সব পোস্টার। শুধু পোস্টারই নয়, নায়ক-নায়িকার, বিশেষত নায়কের, বিশাল মাপের কাটআউট। ভক্তদের ফুলের মালার ভিড়ে হিরোর মুখ ঢাকা পড়ে যেত। সময়ের চোরাস্রোতে সেইসব হলের ঝাঁপ বন্ধ হচ্ছে ধীরে ধীরে। যে কয়েকটা বেঁচেবর্তে দিন গুজরান করছে, সেগুলিও বার্ধক্য়ে ধুঁকছে। ঠিকই ধরেছেন, সিঙ্গল স্ক্রিনের কথা হচ্ছে। একসময় সিনেমা হল বলতে যা বোঝাত, সেসব সিঙ্গল স্ক্রিন এখন শুধুই 'গোল্ডেন মেমরি'।
সিঙ্গল স্ক্রিন জুড়ে রয়েছে হাজারো স্মৃতি। সেই স্মৃতির সরণি ধরে হাঁটলেন প্রসেনজিৎ, দেবশ্রী, চিরঞ্জিৎ, শতাব্দী, ইন্দ্রাণী, অভিষেক, রচনারা। সিঙ্গল স্ক্রিনে এঁদের ছবি মুক্তি পাওয়া মানেই ছিল উৎসব। পয়সা ছোড়া, হাততালি, তীক্ষ্ণ সিটি, দর্শকদের এমন অনেক পাগলামোর সাক্ষী এঁরা। বহুবছর বাদে সেই সাধের সিঙ্গল স্ক্রিন নিয়ে এবার স্মৃতির পাতা ওল্টালেন টলিউডের এই সেলেবরা।
প্রসেনজিৎ: অধিকাংশ সিঙ্গল স্ক্রিনেই আমার সব ছবি হিট হয়েছে। উত্তরা-পূরবী-বিজলীতে 'অমরসঙ্গী' টানা ৭৫ সপ্তাহ চলেছিল। 'আশা ও ভালবাসা' চলার সময় হলে দর্শকরা এমন পয়সা ছুড়েছিলেন যে হলের পর্দা ফেটে গিয়েছিল। আমার ছবি যখন চলত, দর্শকরা হলের মধ্য়ে এমন নাচতেন, যে প্রায়শই চেয়ার ভাঙত। 'পরিবার', 'মায়ের আঁচল', 'ক্রিমিনাল', 'বাদশা'...সব ছবি জুবিলি হয়েছে সিঙ্গল স্ক্রিনে। মফঃস্বলের বেশ কিছু হলে একবছর ধরে চলত আমার ছবি। রানাঘাট টকিজের মতো হলের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে, এরকম আরও অনেক হল ছিল। আজ বড্ড মিস করি ওই হলগুলোকে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, যে হলগুলো আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
দেবশ্রী রায়: আগে তিনটে করে শো হত, ম্য়াটিনি, ইভনিং, নাইট, আর সবকটাই হাউসফুল যেত। সিঙ্গল স্ক্রিন অন্য়ধরনের নস্টালজিয়া একটা। আমার মনে হয় এখনকার শিল্পীরা এটা মিস করছেন। 'আর কত রাত একা থাকব’, ‘আমি কলকাতার রসগোল্লা’, এই গানগুলো দেখার জন্য়ই তখন লোকে হলে যেত। গানগুলো দেখতে দেখতে পয়সা ছুড়তেন দর্শক। দর্শকদের এই পাগলামো একজন শিল্পীর কাছে আলাদা অনুভূতি। 'তোমার রক্তে আমার সোহাগ' ছবির সময় মনে আছে, একেকটা সংলাপ শুনেই হাততালি পড়ছে, এই অনুভূতিগুলো ভোলার নয়।
চিরঞ্জিৎ: তখন আমাদের ৭৫০ মতো হল ছিল, উত্তম-সুচিত্রা পরবর্তী সময়েও হলের সংখ্য়া বেড়েছিল। কিছু হলে শুধুমাত্র হিন্দি ছবি চলত। এখন সেই হলের সংখ্য়া ২১০-এ ঠেকেছে। হল কমে যাওয়ায় ছবির ব্য়বসায় প্রভাব পড়ছে। সিঙ্গল স্ক্রিনের একটা আলাদা মজা ছিল। হলে সিনেমা দেখা নিয়ে তখন রীতিমতো মারামারি হত দর্শকদের মধ্য়ে। 'অন্তরালে', 'প্রতীক', 'পাপী' ছবি দেখতে ব্য়াপক ভিড় হত সিঙ্গল স্ক্রিনে। বহুবার ভবানীপুরে আমার জন্য় ট্রাফিক জ্য়াম হয়েছে। 'বেদের মেয়ে জ্য়োৎস্না' একবছর ধরে টানা চলেছিল। একবছর ধরে ছবি চলায় হিন্দি কোনও ছবি বাংলায় মুক্তির জন্য় সেভাবে হল পাচ্ছিল না ওই সময়, এমনটা বলেছিলেন অনিল কাপুর। সিঙ্গল স্ক্রিনের দর্শকদের সেই উন্মাদনা খুব মিস করি। দেব, জিৎ আরও অনেক মজা পেত, যদি আজও সিঙ্গল স্ক্রিন রমরমিয়ে চলত।
শতাব্দী রায়: খুব মিস করি সিঙ্গল স্ক্রিনকে। সিঙ্গল স্ক্রিনে অনেক বেশি মানুষ একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখতে পেতেন, মাল্টিপ্লেক্সে তেমনটা হয় না। 'আপন আমার আপন' ২৩ সপ্তাহ ধরে চলেছিল। তখন সপ্তাহের হিসেব চলত, তিনটে করে শো থাকত। সিঙ্গল স্ক্রিনের দর্শকেদের উচ্ছ্বাস অনেক বেশি ছিল। এখন অবশ্য় মানুষের কাছে অনেক বিনোদনের মাধ্য়ম চলে এসেছে। তবে সেসময় সিঙ্গল স্ক্রিনে ছবি দেখার মজাটা আলাদা ছিল। এখনও অনেকে আমায় বলেন, যে 'লাল পান বিবি' দেখতে গিয়ে তাঁরা লাঠির মার খেয়েছিলেন, টিকিট পাননি, এত চাহিদা ছিল, এগুলো বেশ মজার। এখনও ধরুন নবীনা সিনেমা হলে দর্শকদের যে উন্মাদনা দেখা যায়, মাল্টিপ্লেক্সে তা দেখা যায় না।
আরও পড়ুন: Elite Cinema Closed: বন্ধ এলিট, বাঙালি আর সাব অলটার্ন নয়
ইন্দ্রাণী হালদার: মিনার-বিজলী-ছবিঘরে ছবি মুক্তি পাওয়া তখন খুব বড় ব্য়াপার ছিল। আমার যখন প্রথম ছবি মুক্তি পেয়েছিল, সেসময় আমার বড় কাটআউট হলের সামনে রাখা ছিল, ওটা দেখতে প্রায়ই রাতে আমি যেতাম ওখানে, খুব মজা লাগত। এখন মাল্টিপ্লেক্সের সামনে যেভাবে পোস্টার ডিসপ্লে করা হয়, সেখানে বোধহয় সিঙ্গল স্ক্রিনের মতো করে ইমপ্য়াক্ট পাওয়া যায় না। সিঙ্গল স্ক্রিনে ছবি মুক্তির যে উত্তেজনা ছিল, এখন সেটা আর দেখি না। সিঙ্গল স্ক্রিনের একটা অন্য়রকম ব্য়াপার ছিল। খারাপ লাগে, যে সিঙ্গল স্ক্রিনগুলো আজকাল আর সেভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না।
অভিষেক চট্টোপাাধ্য়ায়: এখন তো কোনও ছবিই চলে না। সবটাই গায়ের জোর দেখিয়ে বলা হয় হিট, সুপারহিট। 'আমাদের সংসার', 'আমার মা', 'সুজন সখি', 'গীতসংগীত'-এর মত আমার ছবি দর্পণা-পূর্ণ-প্রাচী বা মিনার-বিজলী-ছবিঘরের মতো বড় চেইন ছাড়াও ১৬-১৭টা হলে টানা ১০-১২ সপ্তাহ চলত। সেই মজাটাই এখন আর নেই। এখন তো সাতদিনও চলে না কোনও ছবি। ফাটবাজি অনেক বেড়েছে, কিন্তু যে মেজাজে আমরা বাংলা সিনেমা দেখে এসেছি, সেই মেজাজ নেই এখন আর। এখন তো কপি-পেস্টের ছবি হয়, ফলে দর্শক আগেই জেনে যান ছবির গল্প, তাই আর পয়সা ছোড়ার মতো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না। এখন হিরোর চরিত্রে অভিনয় করলে সিঙ্গল স্ক্রিনকে দারুণ ভাবে মিস করতাম। এখনকার শিল্পীরা সিঙ্গল স্ক্রিনের মজাটাই জানেন না।
রচনা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়: সে সময়টা অন্য়রকম ছিল, সেরকম ছবিও এখন আর হয় না। সিঙ্গল স্ক্রিনের আলাদা আভিজাত্য় ছিল। সিঙ্গল স্ক্রিনে বহু মানুষ একসঙ্গে সিনেমা দেখতেন। বহু মানুষের চিৎকার শুনতে পেতাম। আমার অনেক ছবি চলাকালীন দর্শকরা পয়সা ছুড়তেন, হাততালি দিতেন, সিটি দিতেন, এগুলো গোল্ডেন মেমরি হয়ে চিরকাল থেকে যাবে। এখন মানুষ আরাম চান, সিঙ্গল স্ক্রিনের মতো শক্ত চেয়ার ছেড়ে মাল্টিপ্লেক্সের আরামের চেয়ারে বসে সিনেমা দেখতে চান। আমি খুব লাকি যে, আমার ছবি সিঙ্গল স্ক্রিনেও মুক্তি পেয়েছে, আবার মাল্টিপ্লেক্সেও। তবে সিঙ্গল স্ক্রিনকে ফেরাতে হলে ফাইভ স্টার লুকে ফেরাতে হবে।