জনপ্রতিনিধি। অভিনেতা এখন নেতাও। ভোটের আগে শুটিংয়ের কাজ বন্ধ রেখে পুরোদমে দলীয় কাজে ব্যস্ত। তার ফাঁকেই চলছে 'মিসকল'-এর প্রমোশন। আর সেই প্রেক্ষিতেই ধরা গেল সোহম চক্রবর্তীকে (Soham Chakraborty)। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে দ্বিখণ্ডিত ইন্ডাস্ট্রি, একুশের ভোটবাক্স, বিরোধীপক্ষের আস্ফালন থেকে সহকর্মী রুদ্রনীল-হিরণের দলবদল, যাবতীয় বিষয়ে মুখ খুললেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার কাছে।
বিজেপি আমলে আমজনতাদের কী পরিস্থিতি?
দুর্বিষহ অবস্থা। যখন থেকে মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেই ডিমনিটাইজেশন থেকে শুরু করে অত্যাবশকীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, সাধারণ মানুষ থেকে কৃষকদের উপর অত্যাচার সবই তো দেখা যাচ্ছে। এত নারী স্বাধীনত নিয়ে কথা বলছে ওরা, ওরা বলছে পশ্চিমবঙ্গে নাকি নারীদের কোনও নিরাপত্ত নেই! আমার মনে হয়, আগে তাঁরা নিজের রাজ্যগুলো দেখুক। হাথরস দেখুক। তারপরই বাংলা সম্পর্কে আঙুল তুলুক।
শিবির বদলে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য ইন্ডাস্ট্রির অনেক বন্ধুত্বই তলানিতে ঠেকেছে। এপ্রসঙ্গে কী বলবেন?
অন্য রাজনৈতিক দলে যাওয়াটা সমস্যার নয়। কিন্তু খারাপ লাগে ভাবলে যে, যে বা যাঁরা এখানে বড় হল, মানুষ তাঁদের চিনল, জানল এই ইন্ডাস্ট্রির জন্য। কর্মপরিচিতি হল। কেউ কেউ পিঠ বাঁচাতেও যোগ দিল তৃণমূলে! এতসব করে যখন একটা সময়ে এসে সেই মানুষটার দিকেই আঙুল তুলছে, আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কালিমালিপ্ত করছে। আপত্তিটা সেখানেই।
রুদ্রনীল ঘোষকে টলিউড থেকে নিষিদ্ধ করার কথা বলেছিলেন। তাঁর কথায়, এটা বন্ধু সোহম নয়, নেতা সোহমের মন্তব্য। সেই প্রসঙ্গে কী মত?
ব্যক্তিগতভাবে আমরা একে-অপরের সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। একাধিক ছবি করেছি। রুদ্রনীল আমার থেকে সিনিয়র। সেখানেও ওঁকে আমি সম্মান করি। ব্যক্তি সোহম হিসেবে নয়, প্রতিবাদ করেছিলাম ইন্ডাস্ট্রির একজন হিসেবে। যাঁদের দিকে ও আঙুল তুলেছে, সেটা আমার খারাপ লেগেছে। 'টলিউডে মাফিয়ারাজ চলছে', ইন্ডাস্ট্রির একজন সদস্য হিসেবে এই অভিযোগটা তো আগেই তুলতে পারত। এখন কেন বলছে? আমার টেকনিশিয়ান দাদা-ভাইদের দিকে আঙুল তুলে বলেছে, 'তাঁরা নাকি বসে বসে খায়!' যা আমার যথেষ্ট অপমানজনক মনে হয়েছে। আমাদের ভ্যানিটি ভ্যান না থাকলে অন্তত বসার চেয়ারটা পাই, ওঁরা সেটাও পায় না। দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে। তাই ইন্ডাস্ট্রির একজন সদস্য হিসেবে আমার মনে হয়েছে, আজকে ওঁদের অপমান করা মানে, আমাকেও অপমান করা। এমনকী, রুদ্র নিজের ইন্ডাস্ট্রিকে অপমান করছে।
আজকে রুদ্রকে কিন্তু কেউ নেতা হিসেবে চেনে না। বাংলার মানুষ তাঁকে চেনে বড় মাপের অভিনেতা হিসেবে। আর সেই খারাপ লাগা থেকেই ব্যান করে দেওয়ার কথা বলা। একটা রাজনৈতিক দলকে যখন আমি রিপ্রেসেন্ট করছি, সেখানে দশজনের দায়িত্ব আমার। সেই প্রেক্ষিতে তাদের প্রতিনিধি কিংবা মুখপাত্র হিসেবেই আমার কথা বলা উচিত।
ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে দ্বিখণ্ডিত। শিবির বদলে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, দোষারোপ, সেখানে একসঙ্গে কাজ করতে অসুবিধে হবে না?
ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য একসঙ্গে সিনেমায় কাজ করতে তো কোনও অসুবিধে নেই। এই তো দিন কয়েক বাদেই 'মীরাক্কেল'-এ আমার আর রুদ্রর একসঙ্গে শুট আছে।
'স্টার ত্বত্ত্ব' ভোটে কতটা প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয়?
স্টার-ভ্যালু তো কাজ করেই। বাড়তি সুবিধে হল, কোনও দলের নেতা-মন্ত্রীদের যখন নির্বাচনীপ্রার্থী করা হয়, জনতার দরবারে তাঁদের পরিচয় করাতে হয়। কিন্তু সিনেপর্দার দৌলতে তারকারা তুলনামূলক বেশি পরিচিত। সেদিক থেকে রাজনৈতিক মঞ্চে তারকাদের কথা বলতে দেখলে, সেটা সাধারণ মানুষদের মধ্যে একটা প্রভাব সৃষ্টি করে। আমি মনে করি, তারকারা কোথাও গিয়ে যুবসমাজকে অনুপ্রেরণা জোগায়। তবে, সেটা শুধুমাত্র একটা অংশের মানুষের ক্ষেত্রে। আরেকটা অংশ কিন্তু শুধু তারকাদের দেখতে আসে। তারকা প্রভাবটা ৫ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে পড়ে। বাদবাকি মানুষ আজকাল রাজনৈতিক দিক থেকে বেশ সচেতন। ভোটবাক্সে কাকে ভোটটা দেবেন, সেটা তাঁরা নির্ণয় করেন, কে বা কারা তাঁদের পাশে আছেন কিংবা কোন দল তাঁদের জন্য কাজ করবেন, তা দেখে।
রাজ্য-রাজনীতিতে এত চাপানোতর চলছে, সেই প্রেক্ষিতে কি মনে হয় যে, বাংলার মানুষ 'ভোটার' হিসেবে কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে?
বিজেপি হঠাৎ করে বাংলায় এসে মানুষকে কনফিউজড করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলা ও বাঙালির আবেগ-সংস্কৃতি বুঝতে গিয়ে একটার পর একটা ভুল পদক্ষেপ করছে। ভুলভাল কথা বলছে। বাংলার মণীষীদেরও অপমানের শিকার হতে হচ্ছে। যেটা বাংলার মানুষ একেবারেই মেনে নেবে না। গেরুয়া দল যেভাবে বাঙালিকে বা বাংলাকে নিচুস্তরে দেখে, আমার সেখানেই আপত্তি। বাংলায় এসো, ঘোরো, উন্নয়ন করতে সাহায্য করো। তা নয়! বিজেপির লক্ষ্য, বাংলাকে দখল করা। বস, দখল করা যাবে না!
একুশের বিধানসভা নির্বাচন বাংলায় ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ…
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে ওঁদের শেখা উচিত যে, প্রকৃতপক্ষে একজন জনদরদী নেতৃত্ব কীরকম হতে পারে। 'বহিরাগত' বললে বিজেপির আঁতে ঘা লাগছে। তাহলে বিজেপি যখন এসে NRC, CAA'র দাবি করছে, তখন জনসাধারণের গায়ে লাগবে না কেন? আপনারা কে হে, যে দেশবাসী কিংবা দেশের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে আপনাদের! ওঁরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কে? বেশ করেছি বহিরাগত বলেছি। বাংলার যখনই বিপদ ঘটেছে, সে আমফান হোক কিংবা অতিমারী, কতটা সাহায্য করেছে কেন্দ্র? ভোটের আগে এসে অযথা পাবলিসিটি করে লাভ নেই।
হঠাৎ করে বাংলায় এসে রথে চড়ে বসেছেন। কেউ নিজেকে কৃষ্ণ ভাবছেন, কেউ জগন্নাথ দেব ভাবছেন। মানুষের আবেগ বুঝতে হলে পদযাত্রা করা উচিত, রথযাত্রা ছেড়ে। সাধারণ মানুষকে বুঝতে হলে তাঁদের দুয়ারে দুয়ারে যাওয়া উচিত। এরকম প্রতিহিংসাপরায়ণ একটা দল চেষ্টাই করে সারাক্ষণ মানুষকে গুলিয়ে দেওয়ার। কিন্তু সাধারণ মানুষ জানে যে কে তাঁদের পাশে থেকেছে দুঃখের সময়। রেশন, স্বাস্থ্য, পড়াশোনা সব ফ্রি। এটা কোন রাজ্যে আছে? বিজেপি যা ইচ্ছে বলছে বলুক, দিদির দূত হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে শুধু এই জিনিসগুলো তুলে ধরা আমাদের কর্তব্য। আর আমরা করছিও তাই। বাকিটা ভোটবাক্সই প্রমাণ করে দেবে।
বাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় এলে নারী নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হবে বলে মনে করছেন অনেকই। এটা নিয়ে কী মত?
রাজ্যের মানুষদের এটা ভাবা উচিত। কেউ মুখ খুললেই তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এটাকে ধিক্কার জানাই আমরা। মানুষকে কনফিউডজ করে দিচ্ছে বিজেপি। মানুষদের বোঝা উচিত যে, এরা সরকারে না এসেই দিনের পর দিন মণীষী থেকে শুরু করে বাংলার গর্ব-সম্মান নারীজাতিদের অপমান করছে। প্রকাশ্যেই সায়নী ঘোষ এবং দেবলীনাদিকে (দত্ত) খুন-ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে। তাহলে গণতন্ত্র কোথায়? "বাংলায় গণতান্ত্রিক অধিকার নেই" বলে বিজেপিদের অভিযোগ এবং এত আস্ফালন। এরা তো কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রত্যেকটা মুহূর্তে গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ করে গিয়েছে। এখনও করছে।
লকডাউনের সময় কেন্দ্রীয় সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের দায়িত্ব নিতে পারত না? পারত না প্রত্যেকটা রাজ্যকে বলতে যে, 'আমরা টাকা দিচ্ছি, শ্রমিকদের খাওয়া-থাকার বন্দোবস্ত করুন যতদিন না লকডাউন উঠছে'। আজকে এখানে এসে, নাটক করে কৃষকদের বাড়িতে পাত পেড়ে ভাত খাচ্ছে। পিছনে আবার বিসলেরির বোতল রেখে। সেই কৃষকদের উপরই চার মাস ধরে অত্যাচার চলছে। কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হচ্ছে, লাঠিচার্জ হচ্ছে। কিন্তু কোনও সমাধান নেই।
"দলে থেকে কাজ করতে পারছিলাম না", যাঁরাই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন সবারই এই এক অভিযোগ, কেন?
দেখাই যাক, তাঁরা যে দলে যাচ্ছেন, সেখানে গিয়ে কতটা কাজ করেন তাঁরা। নাকি এই মুহূর্তের জন্য বিজেপি তাঁদের শুধুমাত্র ব্যবহার করে ভোটের পরে আখের ছিবড়ে করে ফেলে দেবে। আবারও সেই 'অবাঙালি ত্বত্ত্বের' কথা মনে করাব মানুষকে!
হিরণ এবং আপনি যুব তৃণমূলের সভাপতির পদে ছিলেন। কিন্তু দল বদলের আগে তিনি তৃণমূলের বিরুদ্ধে কাজ না করার অভিযোগ তুলেছেন, এই বিষয়ে কী বলবেন?
বিজেপিতে যোগ দেওয়া হিরণের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু কাজ না করার অভিযোগ প্রসঙ্গে বলব, আমি নিজে যদি পড়াশোনা না করি, পৃথিবীর কোনও শিক্ষক আমাকে পাশ করাতে পারবে না।
ঘনিষ্ঠ মহলের কাছে, এমনও অভিযোগ রয়েছে যে, সোহম চক্রবর্তীকে তৃণমূলে অনেকটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যেটা হিরণকে দেওয়া হয়নি, সেই প্রসঙ্গে কী মত?
হিরণ যখন থেকে যুব তৃণমূলের সহ-সভাপতি, তার এক-দেড় বছর বাদে আমি যোগ দিই। একটাই কথা বলব, আমি দলে যে জায়গা পেয়েছি, আমার কাজের জন্য, নিষ্ঠার জন্য। আমাকে যে দায়িত্বগুলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছেন, সেগুলো খুব ভরসার জায়গা থেকেই দিয়েছেন। এবং আগামী দিনেও থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। তাঁদের এই বিশ্বাসটাই যেন আমি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারি, সেই চেষ্টাই করব।
সেই শিশুশিল্পী থেকে অভিনেতা সোহম এখন নেতা সোহমও…
সেটা ডেডিকেশন। পড়াশোনা শেষ করার পর বুঝলাম, আমার দ্বারা চাকরি-ব্যবসা কিছুই হবে না। ইন্ডাস্ট্রিতে বড় হয়েছি। এতগুলো ছবি করেছি শিশুশিল্পী হিসেবে, তাই অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বাছলাম। স্ট্রাগল তো করতেই হয়েছে। তবে, অদম্য জেদ ছিল। সেই জেদ আর অধ্যবসায়, আর এতগুলো মানুষের ভালবাসা, আশীর্বাদের জন্যই আজ এখানে। অভিনেতা আর নেতা দুটো সত্ত্বাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।